E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির ঘোষণা

আশায় বুক বাঁধলেন সোহাগপুর বিধবা পল্লীর বীরঙ্গনারা

২০১৪ নভেম্বর ০২ ১৭:৫৫:৩৬
আশায় বুক বাঁধলেন সোহাগপুর বিধবা পল্লীর বীরঙ্গনারা

শেরপুর প্রতিনিধি : বীরঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের এমন ঘোষণায় শেরপুরের  নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর বিধবাপল্লীর বীরঙ্গনারা আশায় বুক বেঁধেছেন। প্রত্যাশা সরকার তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের দুঃসহ যন্ত্রণার ভার কিছুটা হলেও লাঘব করবেন।

শেরপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা গ্রাম সোহাগপুর। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই এ গ্রামে রাজাকার-আল বদরদের সহায়তায় প্রায় পাক সেনারা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ১৮৭ জন পুরুষকে। ধর্ষণ করে ১৩ জন গৃহবধূকে। স্বামী, সন্তান এবং সম্ভ্রম হারানোর সেই বিভীষিকা নিয়ে এখনও কোনমতে বেঁচে আছেন তারা। তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, অসুখে চিকিৎসা নেই। নেই স্বীকৃতি। মাসিক ট্রাষ্ট ব্যাংক থেকে এক হাজার টাকা, ব্র্যাক থেকে ৪০০ টাকা ও বয়স্ক ভাতার ৩০০ টাকা ভাতায় কোন মতে চলে তাদের জীবন তরী। সরেজমিনে এসব শহীদ জায়া ও বীরঙ্গনাদের সঙ্গে আলাপ চারিতায় জানা যায়, দুঃখের আগুনে পোড়া তাদের জীবন কাহিনী।

কোলে কোলে বিয়ে হওয়ার পর স্বামী কাঞ্ছা মিয়ার সঙ্গে সিরাজগঞ্জ থেকে এসে সোহাগপুর গ্রামের বেণুপাড়ায় বসত গড়েছিলেন আছিরন। স্বামীর কৃষিকাজ আর ঘরে হাঁস. মুরগী, গরু-ছাগল পালনের আয়ে ভালই চলছিল তাদের ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে নিয়ে সংসার। সেদিন সকাল বেলা। স্বামী কাঞ্ছা মিয়া বাড়ির অদূরের ক্ষেতে চারজন কামলা নিয়ে গিয়েছিলেন আমন ধানের চারা ভাঙতে। সেখানেই সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী। আছিরন তখন মাঠে গরুকে ঘাস খাওয়াচ্ছিলেন। হঠাৎ গুলির শব্দে ভীত আছিরন বাড়ির পথে পা বাড়াতেই পেছন থেকে তাড়া করে পাক সেনাদের কয়েকজন তাকে ধরে ঘরে এনে হাত পা বেঁধে ফেলে শুরু করে পাশবিক নির্যাতন।

তার ভাষায়, ‘কয়জন আমার উপর অত্যাচার করছে কইতে পারি না। আমি বেহুশ হইয়্যা গেছিলাম। হুশ হওয়ার পর খবর পাইলাম স্বামীরে মাইরা বন্দে ফালাইয়্যা রাখছে। দৌড়াইয়া গেলাম । দেখলাম খালি লাশ আর লাশ। ছড়াইয়্যা ছিটাইয়্যা পইড়্যা রইছে। শুধুমাত্র গিলাপে জড়াইয়্যা কোনমতে স্বামীর লাশ মাটি চাপা দেওয়ার পর আমি পাগল অইয়্যা গেলাম।’ তিনি জানান, পাশবিক অত্যাচারের কারণে তখন খালি রক্ত ঝড়তো। তিনমাস চিকিৎসা করার পর সেটা ভাল হয়। তিনি বলেন, ‘অরা শুধু আমার স্বামী ও ইজ্জত নিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই। গরুছাগল, ঘরের জেহারপাতি, জমানো ৯ হাজার ট্যাহা সব লুট করে নিয়া যায়। দিনে রাইতে রাজাকার বদরদের অত্যাচার সহ্য না করতে পাইর‌্যা শেষ পর্যন্ত পোলাপান লইয়্যা মানুষের বাড়িতে রাইত কাটাই। দেশ স্বাধীন অইলে স্বামীর ভিট্য়া ফিরি। জমিটুকু অন্য মাইনষে দখল কইরা নেয়। কাম কইর‌্যা, ভিক্ষা কইরা , পোলাপনগুলারে বড় করি। ওরাও এখন বিয়াশাদী কইর‌্যা আলাদা সংসার পাতছে। আমারে দেহনের কেউ নাই।’

গুলির আওয়াজে তিনবছরের শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়েছিলেন জবেদা। সেখানেই কোলের বাচ্চাকে ফেলে দিয়ে তার উপর পাশবিক অত্যাচার করে দু’জন পাক সেনা। হত্যা করে স্বামী বাবর আলীকে। জবেদা বেওয়া জানান, ইজ্জত হারানোর কষ্ট, স্বামী হারানোর কষ্ট, সন্তান হারানোর কষ্ট বুকের ভেতর আগুন হইয়্যা জ্বলতাছে। আমার দুইট্যা সন্তান ভাতের অভাবে মরছে। আমি নিজে ২২ দিন শুধু সামান্য আটার জাউ খাইয়্যা বাইচ্যা আছিলাম। সন্তান হারানোর পর দ্বিতীয় বিয়া অইছিল। হেই স্বামীও মইর‌্যা গেছে। করফুলি বেওয়া জানান, মান হারানোর পর স্বামীর গুলি খাওয়া লাশ কাঁথা দিয়া ঢাইক্যা গোয়ালঘরে রাইখ্যা ভয়ে পলাইয়্যা গেছিলাম। চাইর-পাঁচদিন পর আইস্যা শেয়াল, কুকুরে খাওয়া স্বামীর হাড়গোড় টুকাইয়্যা কোনমতে মাটি চাপা দিয়া রাখি।

শুধু আছিরণ, জবেদা বেওয়া, করফুলি বেওয়া নয়। সোহাগপুর বিধবা পল্লীর জরিতন বেওয়া, সমলা বেওয়া, অজুফা বেওয়া, আমেনা বেওয়া, জোবেদা বেওয়া, হাসনা বানু, হাফিজা বেওয়া, সাহেরা বেওয়া, ও মহিরণ বেওয়া প্রত্যেকেই স্বামী হারিয়েছেন। সম্ভ্রম হারিয়েছেন। স্বাধীনতা অর্জনের পর তারা পার করেছেন ৪৩ টি বছর। প্রত্যেকের শরীরে এখন বার্ধক্য এসে ভর করেছে। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। পাশে নেই সন্তানরাও।

বীরঙ্গনারা পাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। এমন ঘোষণা শুনে তাদের কষ্টের জীবনে যেন একটুখানি আনন্দের ছোঁয়া লেগেছে। তারা বলছেন, সরকার যদি শেষ জীবনে এই সন্মানটুকু দেয়, তাইলে আমরা মইর‌্যাও শান্তি পামু।

(এইচবি/এএস/নভেম্বর ০২, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test