E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে বিজয় পতাকা উড়েছিল ঝালকাঠির রাজাপুরে

২০১৪ নভেম্বর ২৩ ১৭:৫৫:০১
মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে বিজয় পতাকা উড়েছিল ঝালকাঠির রাজাপুরে

ঝালকাঠি থেকে আসিফ মানিক : আজ ২৩ নভেম্বর। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ৯নং সেক্টর বরিশাল ডিভিশনের মধ্যে সর্বপ্রথম বিজয় পতাকা উড়েছিল ঝালকাঠি মহাকুমার রাজাপুর থানায়। রাজাপুরের অকুতভয়ে মুক্তিযোদ্ধা দল একটানা দুইদিন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ২৩ নভেম্বর পাক হানাদার বাহীনী হটিয়ে রাজাপুর সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করে দখল করে রাজাপুর থানা। এই দিনে বাংলাদেশের প্রথম বিজয় পতাকা উড়িয়ে বিজয় উল্লাসে মিছিল করে রাজাপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

ঝালকাঠি জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রয়াত কমান্ডার সৈয়দ শামসুল আলম জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য অস্থায়ী সরকারের নির্দেশে যুদ্ধে সর্বাধিনায়ক দেশের ৫৫ হাজার ৫৯৮ বর্গমাইল এলাকাকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করেন। দক্ষিণাঞ্চল ছিল ৯ নং সেক্টর। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর জলিল। সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর। তার বাড়ি রাজাপুর থানার সাঙ্গর গ্রামে। তাকে বরিশাল অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘটিত করার দায়িত্ব দেন সেক্টর কমান্ডার। তিনি বরিশাল ডিভিশনের সকল থানার মুক্তিযোদ্ধাদের থানা কমান্ডক্যাম্প গঠন করে যোদ্ধাদের তালিকা করে প্রশিক্ষণ দেন।

সমগ্র অঞ্চলের ক্যাম্পের খবর নেয়া ও যুদ্ধের নির্দেশ প্রদানের জন্য কন্ট্রোল রুম করা হয় বরিশালে নুরুল ইসলাম মঞ্জুর বাসায়। রাজাপুর থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয় (হাবি:) কেরামত আবুল কালামকে। এ থানায় মুক্তিবাহিনী দল যুদ্ধ প্রশিক্ষন নিয়ে শক্তিশালী মুক্তি ফৌজ গঠন করে। ২৫ মার্চ থেকে হানাদার বাহিনীর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, দেশীয় রাজাকার, আলবদর বাহিনীদের লুট-পাট ও অমানুষিক নির্যাতনের প্রতিরোধ প্রাচীর গড়ে তোলে রাজাপুরের মুক্তিযোদ্ধারা।


যুদ্ধকালে রাজাপুর থানার প্রথম শহীদ হন মোহাম্মদ আলী সিকদার। তার বাড়ী জীবন দাসকাঠী গ্রামে। গালুয়া গ্রামের দু:সাহসী যুবক আবুল কালাম বাবলু তার বাহিনী নিয়ে আঙ্গারিয়া গ্রামে পাক হানাদারদের ঘাটির উপর আক্রমন চালায়। সে কারনে পাকবাহিনীরা বাবলুকে ধরে নিয়ে নির্মম অত্যাচার করে জ্যান্ত মাটিতে পুতে হত্যা করে।পাক হানাদার দের নৃসংশহত্যার খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিযোদ্ধারা জ্বলসে ওঠে পাল্টা প্রতিশোধ নিতে। ওদিকে রাজাকারদের নীল নকশায় পাক বাহিনীরা প্রতিনিয়ত গ্রামের নিরীহ মানুষ, যুবকদের ধরে নদীর তীরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। মরা মানুষের লাশে রাজাপুরের খাল গুলো ছিল পূর্ণ।


এ সময় সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর দক্ষিণ অঞ্চলের স্বরূপকাঠি থানার মুক্তিযোদ্ধা দের নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধ করছিলেন। রাজাপুর পাক হানাদার দের বর্বরোচিত অত্যাচারের তান্ডবের খবর পেয়ে তিনি বিচলিত হন। নিজ দেশের টানে তিনি ঝালকাঠি জেলার শত্রুমুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে সমর অস্ত্র নিয়ে বাড়ি এসে ক্যাম্প কমান্ডারদের সাথে বৈঠক করেন।


মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি শহীদদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোজ খবর নেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনদের প্রতিশোধ নিতে রনকৌশল শিখান। রাজাপুর থানার প্রতি ঘরের যুবকদের মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করে বৃহৎ দল গঠন করেন। রাজাপুর থানার জীবনদাসকাঠী গ্রামের শহীদ মোহাম্মদ আলী সিকদারের বাড়ীর সম্মুখে একটি বোর্ড স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি করেন। স্কুল মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন দেন। জীবনদাসকাঠী বোর্ড স্কুলকে তিনি সাব সেক্টর কমান্ড দপ্তর করেন।

এখান থেকে ঝালকাঠি মহাকুমার যুদ্ধ পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হত। জীবনদাসকাঠীর এই ক্যাম্পটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিশালী ঘাটি। রাজাপুর এলাকায় অবস্থানরত হানাদার বাহিনীরর ক্যাম্পে প্রতি রাতে কমান্ডো হামলা চালিয়ে ক্যাম্প দখল করে নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। পাক বাহিনী রাজাকার বাহিনী ধরে এনে মুক্তিবাহিনীর সাব সেক্টর ক্যাম্পে আটক রাখে। জীবনদাসকাঠী বোর্ড স্কুলের একটি কক্ষ ছিল ওদের জন্য কারাগার। একের পর এক সফল কমান্ডো হামলায় পাক দোসররা ভয়ে গ্রাম অঞ্চল থেকে পালিয়ে রাজাপুর থানায় অবস্থান নেয়। ১৪ই নভেম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তেজদীপ্ত হয়ে ওঠে।

থানা শহর ছাড়া সমগ্র এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে থাকে। চারদিক থেকে পাক বাহিনীদের ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধারা। বিজয়ের চরম পর্বে মুক্তিযোদ্ধারা থানা আক্রমনের পরিকল্পনা নেয়। প্রথমবার থানা দখল অপারেশন ব্যার্থ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। একটানা কয়েকদিনের সংঘর্ষে আব্দুর রাজ্জাক, হারুন-অর-রশিদ, আ: রহমান, নির্মল, হোসেন আলী যুদ্ধে শহীদ হন। ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর যুদ্ধাহত হন। তার পায়ে গুলি লাগে। এতে দমে যায়নি মুক্তিযোদ্ধারা। সহকর্মী, ভাই, স্বজনদের রক্ত ঝড়ানোর দেশ স্বাধীন করার সংকল্পে অনড় থাকে। ২২ নভেম্বর পূনরায় মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমন চালায় রাজাপুর থানা দখল করতে। সম্মুখ যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর টনক নড়ে।

এ যুদ্ধে অনেক পাক সেনা-পুলিশ নিহত হয়। যুদ্ধ চলে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত। ২ দিনের মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্নিরুপ দেখে দিশেহারা হয়ে পাকবাহিনীর অধিনায়ক সহ সকল রাজাকার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন করে। শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা থানার প্রধান ক্যাম্প দখল করে পাক বাহিনীদের কারাবন্দি করে। অস্ত্র নিয়ে বিজয় মিছিল করে। প্রতিটি ঘরে উড়েছে বাংলাদেশের পতাকা। রাজাপুর হয় শত্রুমুক্ত। অসাধারণ এই কৃতিত্ত্বের জন্য ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর বীর উত্তম পদক পান।

(এসএম/এএস/নভেম্বর ২৩, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test