E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দুঃখ-বেদনার স্মৃতি :সাঁথিয়ার ধুলাউড়ি গণহত্যা দিবস আজ

২০১৪ নভেম্বর ২৭ ১৫:০৫:৪০
দুঃখ-বেদনার স্মৃতি :সাঁথিয়ার ধুলাউড়ি গণহত্যা দিবস আজ

শামীম হাসান মিলন: বাঙ্গালির হাজার বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি গৌরব ময় অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাঙ্গালির মত করে পৃথিবীর কোন জাতি সল্প সময়ে এত বড় রক্ত দেয়নি। স্

বাধীনতা অর্জনের গৌরবের ঈর্ষনীয় দাবীদার বাংলাদেশের অন্যন্য এলাকার মত পাবনার সাঁথিয়াবাসীও। মুক্তিযুদ্ধে সাঁথিয়াবাসীর যেমন গৌরব ও বীরত্বের ইতিহাস আছে। পাশাপাশি রয়েছে বেদনাহত স্মৃতিময় দিন। এমন একটি বেদনা বিধুর মর্মস্পর্শী দিন ১৯৭১ সালের ২৭ শে নভেম্বর। আজ থেকে ৪০ বছর আগে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক ঘটে যাওয়া পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ধুলাউড়ী হত্যাযজ্ঞের করুন কাহিনী শুনে যে কোন হৃদয়বান মানুষের চোখের কোনে দুফোটা জল জমে উঠবেই উঠবে।

আজ ২৭ শে নভেম্বর সেই ভয়াল হত্যাযজ্ঞের দিন। সারাদেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় দু’শ মুক্তিযোদ্ধা এসে অবস্থান নিয়েছে সাঁথিয়া থানার ধুলাউড়ি গ্রামে। একই গ্রামে সকলের অবস্থান করা নিরাপদ নয় ভেবে মুক্তিযোদ্ধারা ভাগাভাগি করে পার্শবর্তী বিল সলঙ্গী, রামকান্তপুর,পাইকশা, নাড়িয়াগোদাই প্রভৃতি গ্রামে রাত যাপনের ব্যাবস্থা করে। এদিকে দীর্ঘ কয়েকমাস দেশের বিভিন্নস্থানে একটানা যুদ্ধ করে সবাই ক্লান্ত শ্রান্ত। সাঁথিয়া থানা সদর থেকে প্রায় ৮/১০ কিলোমিটার ভেতরে জায়গাটি তাদের ধারনায় কিছুটা নিরাপদ মনে হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল রাত পোহালে পরবর্তী আক্রমনের জন্য সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি নেবে। এদিকে কিছুদিন আগে (সেপ্টেম্বর মাসে) মুক্তিযোদ্ধারা সাঁথিয়া হাইস্কুলে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমন করে ৯ জন রাজাকার হত্যা করে এবং অস্ত্রলুট করে নেয়। মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক রাজাকার হত্যা ও অস্ত্রলুট হওয়ায় দালালরা খুবই তৎপর ছিল ও পাকসেনারা সাঁথিয়ার ওপর নজর রাখছিল।

২৭ শে নবেম্বর। রাত আনুমানিক ৩ টা। চারদিকে গা ছমছম করা থমথমে ভাব, ভুতুরে নিরবতা। দূরে কুকুরের করুন সুরের গোংরানি, যেন অশুভ ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ গুলির শব্দ। দালালের সহায়তায় পাঁচশ পাকসেনা খুবই কৌশলে ধুলাইড়ি গ্রাম ঘিরে ফেলেছে। কথিত আছে পার্শ্ববতী বেড়া থানার জোড়দহ গ্রামের আসাদ নামের জনৈক দালাল ছিল এই নির্মম হত্যা কান্ডের পথ প্রদর্শক। ডিউটিরত মুক্তিযোদ্ধারা সময় মত তাদের সহযোদ্ধা বা গ্রামবাসীকে সতর্ক করার কোন সুযোগ পায়নি। ভোররাত থেকে শুরু হয় পাকসেনাদের তান্ডব লীলা। একাধারে চলতে থাকে হত্যা, লুটপাট, ধর্ষন ও অগ্নি সংযোগ। অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধা ও ঘুমন্ত গ্রামবাসীকে হতবিহবল হয়ে প্রান ভয়ে দিক বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। বাড়ি বাড়ি থেকে যুবতী মেয়েদের ধরে এনে একটি বড় আম গাছের নিচে নিয়ে এসে উপুর্যুপরি ধর্ষন করে গা হতে গহনা পত্র খুলে রেখে লাথি মেরে পাশ্ববর্তী খালে ফেলে দেয়। মুক্তিযোদ্ধা ও বহু গ্রামবাসীকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে ঘুমন্ত অবস্থায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। রশি দিয়ে একত্রে বেধে ইচ্ছামত নদীর পারে নিয়ে এসে ব্রাশ ফায়ারে নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। ওইদিনের হত্যাকান্ডে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা সহ ১১ জন গ্রামবাসীর লাশ সনাক্ত করা যায়। এরা হচ্ছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা খবির উদ্দিন(পদ্মবিলা), আখতার হোসেন (ইসলামপুর) দ্বারা হোসেন (রঘুনাথপুর), চাঁদ বিশ্বাস (রঘুনাথপুর), মহসীন আলী (কাজিপুর), শাহজাহান আলী (চরতাঁরাপুর), মকছেদ আলী (বামুনডাঙ্গা), মুসলিম উদ্দিন (চরতাঁরাপুর)। হত্যার শিকার গ্রামবাসীরা হচ্ছেন, আবুল কাশেম ফকির , ডাঃ আঃ আওয়াল, জহুরুল ইসলাম ফকির, আঃ রশিদ ফকির, আঃ গফুর, আঃ সামাদ বান্যে, নইম উদ্দিন খলিফা, ওয়াজেদ আলী, কোবাদ বিশ্বাস, আখতার হোসেন তালুকদার, মাহখনবি প্রমূখ।

হত্যা যজ্ঞ শেষে পাকসেনারা বেলা ১২ টার দিকে ফেরার পথে নাড়িয়াগোদাই, ধোপাদহ, হলুদঘর, অগ্নি সংযোগ করতে সাঁথিয়া থানায় আসে। আসার সময় রুদ্রগাতি গ্রামের আঃ ছামাদকে ধরে নিয়ে এসে সাঁথিয়া থানার সামনে বেলগাছে ঝুলিয়ে (পা ওপরে মাথা নিচে) বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে সারা গায়ে লবণ ভরে দিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করে । হত্যার পর পাকসেনারা তার পুরুষাঙ্গ কেটে মুখে পুরে দিয়ে রাখে। সেদিনের সে নির্যাতনের কথা মনে হলে এখনও সাঁথিয়াবাসী ক্ষোভে, দুঃখে ফেটে পরে। সে দিন পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হওয়া ৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের গাঁয়ের চাঁদর দিয়ে জড়িয়ে কোন মতে ধুলাউড়ি ফকির পাড়া প্রাইমারী স্কুলের সামনে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। আরও রাখা হয় ব্রাশ ফায়ারে নিহত গ্রামবাসীকে। সেটি এখন গণকবর হিসাবে পরিচিত। সে দিনের ব্রাশ ফায়ারে বেঁচে যাওয়া শাহজাহান (পাকসেনারা বেয়নেট দিয়ে যার গলা কেটে দিয়েছিল) বর্তমানে গলাকাটা শাহজাহান হিসেবে পরিচিতি নিয়ে বেঁচে আছেন। ”৭১Ñএ ধুলাউড়ির সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞ এখনো সাঁথিয়াবাসীর কাছে দুঃখ ও বেদনার স্মৃতি হয়ে আছে। তাদের দাবী ধুলাউড়ির শহীদদের স্মরণে ধুলাউড়িতে একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মান করা হোক। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও দিবসটি যথাযথভাবে পালনের উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহন করা হয়েছে।

(এসএইচএম/এসসি/নভেম্বর২৭,২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test