E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

১৪ মে : বাড়িয়া গণহত্যা দিবস

বাড়িয়ায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য আবেদন

২০১৫ মে ১৪ ০০:২৯:১১
বাড়িয়ায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য আবেদন

মোঃ মুজিবুর রহমান : মহান স্বাধীনতা আমাদের প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য সম্পদ। পাকিস্তানি বাহিনী কর্র্তৃক পরিচালিত প্রতিটি গণহত্যার লক্ষ্য ছিল এই অমূল্য সম্পদকে ধ্বংস করা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করা।

সেই সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার লক্ষ্য স্থির করে গণহত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে এবং এ গণহত্যা দেশের সর্বত্র চলেছে মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাস।

২৬ মার্চ ১৯৭১ যখন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তখনো ঢাকাসহ কয়েকটি জেলাতে গণহত্যা চলছিল। অন্যদিকে শুরু হয় বাঙালির প্রতিরোধ। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত।

ইতিহাসের প্রবাহমান ধারায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ঘটনাবহুল। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ী। সে সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি (পিস) কমিটির লোকেরা করেছে বিধ্বংসী ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড।

বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী সারাদেশে গণহত্যা শুরু করলে তার প্রভাব এসে পড়ে তৎকালীন জয়দেবপুরে (বর্তমানে গাজীপুর)। তৎকালীন জয়দেবপুরে (বর্তমান গাজীপুর) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি (পিস) কমিটির লোকেরা মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ করে।

গাজীপুরে গণহত্যার জঘন্য নজির স্থাপিত হয় মে মাসের ১৪ তারিখে বাড়িয়াতে। অন্যদিকে একাত্তরের ১৯ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত হয় এই জয়দেবপুরেই। ১৯ মার্চের পর সারাদেশে স্লোগান ওঠে “জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।”

১৪ মে, ১৯৭১। অন্যান্য দিনের মতো ওইদিনও গাজীপুরের বাড়িয়া গ্রামের নারী পুরুষদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চলছিল। এমন অবস্থায় গ্রামে ঢুকে স্থানীয় কতিপয় রাজাকারের সহায়তায় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ চালায়। তারা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে প্রায় দু’শত নারী-পুরুষ-শিশু হত্যা করে। এদিকে তদের আক্রমণে কয়েকশত লোক আহত হয়। গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজ চালানো হয়। এ গণহত্যা গাজীপুরের অন্যান্য স্থানের চেয়ে ব্যাপক।

১৯৭১ সালের ১৪ মে শুক্রবার দুপুর একটার দিকে স্থানীয় রাজাকার আউয়াল, হাকিম উদ্দিন ও মজিদ মিয়াসহ কিছু রাজাকারের সহায়তায় গাজীপুর শহরের জয়দেবপুর ভাওয়াল রাজবাড়ী ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রায় পাঁচ শত পাকিস্তানি সৈন্য বাড়িয়া গ্রামে আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামে ঢুকেই চারদিকে ছড়িয়ে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। তাদের নির্বিচারে গুলিবর্ষণে বাড়িয়া ও পার্শ্ববর্তী কামারিয়া গ্রামের গ্রামবাসীসহ গ্রামে আশ্রিত প্রায় দু’শত নারী- পুরুষ- শিশু শহীদ হয়। তাছাড়া কয়েক শত মানুষ আহত হয়।

মানুষ হত্যা করেই পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা ক্ষান্ত হয়নি। তারা গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। আবার নারী নির্যাতনসহ ব্যাপক লুটপাট চালায় তারা। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা হয়ে কিছু লোক বেলাই বিল পার হয়ে আশেপাশের গ্রামে আশ্রয় নেবার চেষ্টাকালেও তাদের উপর গুলি বর্ষণ করা হয়। পলায়নরত এসব লোকজনদের সঙ্গে থাকা জিনিসপত্রও লুট করে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা।

হিন্দু অধ্যুষিত বাড়িয়া গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ ও নির্বিচারে গ্রামবাসীদের হত্যার খবর আশে পাশে ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় লোকজনদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এতে আশে পাশের গ্রামের লোকজন আরো দূরবর্তী নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।

বাড়িয়া গ্রাম ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০০ ভাগ হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম ছিল। মুক্তিযোদ্ধা এম এ সামাদ সরকার সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের বেশ কয়েকজনের একটি তালিকা দিয়েছেন। তালিকা থেকে প্রাপ্ত শহীদদের নাম হচ্ছে- ছায়া রাণী দে, বিজয় চন্দ্র দাস, জয়ধনী দাস, সহদেব দাস, হরিচরণ দাস, অক্ষয় চন্দ্র দাস, নগেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী, কর্পূলা রাণী দাস, সচীন্দ্র চন্দ্র দাস, কোকাই রাম দাস ,বিপুলা রাণী দাস, শরৎ চন্দ্র দাস, হিরণী বালা দাস, যামিণী রাণী দাস, চাঁন মোহন দাস, মোনমোহন দাস, সাহেরা বেগম, অদূদ ভূইয়া, ওয়ারেজ ভূইয়া, বাকির ভূইয়া, হরেন্দ্র চন্দ্র শীল, মমতাজ বেগম, মানদা সুন্দরী শীল, ভানু চন্দ্র শীল, মনীন্দ্র চন্দ্র শীল , মালতী রাণী শীল, প্রেমবালা শীল, সত্যরঞ্জন দাস, চারুবালা শীল, বেনু বালা শীল, সাধনা রাণী শীল, অবনী চন্দ্র দাস, বুলু চন্দ্র দাস, ফুলু রাণী দাস, সন্ধ্যা রাণী দাস, জয়দেব চন্দ্র দাস, দেবেন্দ্র চন্দ্র দাস, ইন্দ্রমোহন দাস, যোগেন্দ্র চন্দ্র দাস, বিলাসমণি দাস, নিদা রাণী দাস, নারায়ণ চন্দ্র দাস, সুন্দরী রাণী দাস, কাজলী রাণী দাস, সুদমণি দাস, মানিকী রাণী দাস, সারদা রাণী মণ্ডল, হাছনী রাণী দাস, পার্বতী রাণী দাস, রজনী কান্ত দাস, সবিতা রাণী দাস, বিনতা রাণী দাস, মোঃ চাঁন মিয়া, মোঃ কফিলউদ্দিন, মোঃ রমিজউদ্দিন, আসমত উল্লাহ সরকার, রাজ্জাক মোল্লা।

জানা যায়, গ্রামের পার্শ্বে বিলের মধ্যে একটি পাওয়ার পাম্পে পানির মোটা পাইপ দেখে পাকিস্তানি বাহিনী কামান মনে করে এটির উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে। বাড়িয়া ও কামারিয়া গ্রামে ১৫১ জন শহীদের তালিকা করা হলেও শহীদদের সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

জয়দেবপুরের রাজবাড়িতে ক্যান্টনমেন্ট থাকায় পাকিস্তানি বাহিনী সহজেই তিতারকুল দিয়ে চিলাই নদী পার হয়ে বাড়িয়াতে হত্যাযজ্ঞ চালাতে পেরেছে। দুপুর একটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী তাণ্ডবলীলা চালায় বাড়িয়া ও কামারিয়া গ্রামের অধিবাসীদের ওপর।

সেদিন রাত সাড়ে সাতটার দিকে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছিল। জয়দেবপুর ভাওয়াল রাজবাড়ি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাড়িয়া গ্রামের দূরত্ব ছিল ৮ কিলোমিটার। পাকিস্তানি বাহিনী আসার কথা শুনে গ্রামবাসীর অনেকেই বাড়ি থেকে পালিয়ে বিলে নেমে যায়। কচুরিপানার মধ্যে শুধু মাথাটা বের করে দিয়ে কোনরকমে লুকিয়ে ছিল। এরই মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী সেখানে গুলি করে। গুলিতে সেখানেই অনেকে মারা যায়।

আজ ১৪ মে, বৃহস্পতিবার। গাজীপুরের বাড়িয়া গণহত্যা দিবস। কিন্তু একাত্তরের ১৯ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের দিনটি যেমনভাবে পালন হয়ে থাকে তেমনভাবে ১৪ মে আঞ্চলিকভাবে তেমন তাৎপর্য বা গুরুত্ব সহকারে পালন করা হয় না।

এদিকে গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য তরুণ রাজনীতিবিদ মোঃ জাহিদ আহসান রাসেল একেবারে নিজ উদ্যোগে টঙ্গীতে ৫ মার্চ এবং জয়দেবপুরের ১৯ মার্চ-এর শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে দিয়েছেন। সেরকম বাড়িয়াতে যে গণহত্যা হয় তার জন্য কোনো স্মৃতিস্তম্ভ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

উল্লেখ্য, গাজীপুরের বাড়িয়া এলাকাটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির নির্বাচনী এলাকার আওতাধীন। তরুণ রাজনীতিবিদ মোঃ জাহিদ আহসান রাসেল এমপির ন্যায় এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য বাড়িয়া এলাকার (বাড়িয়া ইউনিয়ন) রাজনীতিবিদ, গাজীপুর জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ করা যেতে পারে।

গাজীপুরের বাড়িয়া গণহত্যা দিবসটি পালনের দিক থেকে ঘাটতি রয়েছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ রয়েছে। মনে রাখা দরকার, মানবতাবিরোধী এমন কোনো আচরণ নেই, যা বাড়িয়াতে প্রয়োগ করেনি বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি (পিস) কমিটির লোকেরা।

পরিতাপের বিষয়, ওই গ্রামের বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানে না তাদের গ্রামের গণহত্যার (মানবতাবিরোধী অপরাধ) বিস্তারিত বিবরণ। এই প্রজন্মের অনেকেই তাদের গ্রামের গণহত্যার তারিখটিও সঠিকভাবে বলতে পারে না- এ রকম অনেক অভিযোগই রয়েছে। এগুলোর সমাধান হিসেবে আশু পদক্ষেপ দেখতে চাই।

স্থানীয় সূত্র থেকে জানা যায়, বাড়িয়ার গণহত্যার জন্য যারা অপরাধী তারা অনেকেই মারা গেছেন। আবার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতেও অনেকে নিহত হয়েছেন। যার ফলে তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব হচ্ছে না বলে সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের বিদগ্ধ মন্তব্য।

তবু দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করি, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গণহত্যার বিষয়ে সচেতন করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ করতে হবে। সেই সঙ্গে এ গণহত্যা বিষয়ে তাদেরকে বিস্তারিত জানাতে হবে।

পাশাপাশি এই লেখার মাধ্যমে আবেদন- নিবেদন করছি বাড়িয়া গ্রামে একটি স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণের যা জানান দেবে ১৪ মে’র গণহত্যার বিবরণ। প্রজন্মান্তর জানতে পারবে সেই সময়ের কাহিনী।

লেখক: কলেজ শিক্ষক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও আর্কাইভস ৭১-এর প্রতিষ্ঠাতা।

(পিএস/মে ১৪, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

১৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test