E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কেতনার বিলে আজও নির্মিত হয়নি স্মৃতিসৌধ

২০১৫ মে ১৫ ১৪:৪৫:১১
কেতনার বিলে আজও নির্মিত হয়নি স্মৃতিসৌধ

তপন বসু, আগৈলঝাড়া থেকে : দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ গণহত্যা দিবস আজ শুক্রবার। ১৯৭১ সালের এইদিনে বরিশালের উত্তর জনপদের তৎকালীন গৌরনদী ও বর্তমান আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার গ্রামের ইউনিয়নরে মধ্যবর্তী রাজিহার ও রাংতা উভয় গ্রামের সীমানায় কেতনার বিলের অবস্থান। কেতনার বিলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আটটি গ্রামের দেড় সহস্রাধিক নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে।

দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বড় এ গণহত্যার স্থানে স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিসৌধ। ফলে এসব শহীদের শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু মুছে গেছে। এছাড়া শহীদের তালিকায়ও স্থান পায়নি কেউ। এমনকি দীর্ঘদিনেও সরকারী ভাবে দিবসটি পালন উপলক্ষ্যে নেয়া হয়নি কোন কর্মসূচী। এবছর প্রথমবারের মত স্থানীয়ভাবে রাংতা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আজ শুক্রবার বিকেল তিনটায় ‘গণহত্যা দিবস-৭১’ উপলক্ষ্যে স্মরণ সভা, শহীদদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনায় দোয়া-মিলাদ ও প্রার্থণা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও দিবসটি উদ্যাপন উপলক্ষ্যে এবারই সর্বপ্রথম প্রকাশিত হচ্ছে ‘স্মরণিকা-৭১’।

যা ঘটেছিল সেদিন : ৭১ সালের ১ জৈষ্ঠ্য দোনারকান্দির বাসিন্দা চিত্ত বল্লভের নেতৃত্বে স্থানীয় লোকজন ঢাল শুড়কী নিয়ে পাক হানাদারদের মুখোমুখী ঝাঁপিয়ে পড়ে চারজন পাক সেনাকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় গৌরনদী কলেজের পাক সেনাদের ক্যাম্পের শতাধিক পাকসেনা ক্ষিপ্ত হয়। তারা স্থানীয় আলবদর ও রাজাকারদের সহযোগীতায় কসবার হযরত মল্লিক দূত কুমার পীর সাহেবের মাজার সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে চাঁদশীর পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে জনতার ওপর এলএমজির ব্রাশ ফায়ার করে পাখির মতো মানুষ মারতে থাকে। পাক সেনাদের ভয়ে সেদিন চাঁদশী, রাংতা, রাজিহার, চেঙ্গুটিয়া, টরকী, কান্দিরপাড়, রাংতাসহ আটটি গ্রামের গ্রামের কেতনার বিলের ধান ও পাট ক্ষেতের মধ্যে আশ্রয় নেয়। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগীতায় পাকিস্তানী সৈন্যরা কেতনার বিলে লুকিয়ে থাকা নিরিহ গ্রামবাসীদের ওপর গুলি করতে থাকে। এতে ওইদিন অন্তত দেড় সহস্রাধিক নিরীহ গ্রামবাসী প্রাণ হারায়।

সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী রাজিহারের কাশিনাথ পাত্রের পুত্র অমূল্য পাত্র জানান, ওইসময় প্রাণ বাঁচাতে পালানো মানুষের ভীড়ে লাশ সৎকার বা কবর দেয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার পরেও মৃত্যু কুপ নামেখ্যাত পাত্র বাড়ির বেঁচে যাওয়া হরলাল পাত্র ও অমূল্য পাত্রর নেতৃত্বে হরলালের পুত্র সুশীল পাত্র, কেষ্ট পাত্র, রাধা কান্ত পাত্রসহ কয়েকজনে পরেরদিন তাদের হারানো স্বজনসহ প্রায় দেড় শতাধিক লোকের লাশ এনে তাদের পাত্র বাড়ির কয়েকটি স্থানে বড় বড় গর্ত করে একত্রে মাটি চাঁপা দিয়ে রাখা হয়। যার গর্তের সংখ্যা ছিলো ছয়টি। বাকি লাশগুলো কেতনার বিলে শেয়াল, কুকুরের খাবার হয়ে যায়। বেশীরভাগ লাশ পচে গলে পড়ে থাকে বিলের মধ্যেই। শেয়াল, কুকুরে ওইসব লাশের গন্ধ ছড়াতো। কাশীনাথ পাত্রের আরেক পুত্র জগদ্বিশ পাত্র জানান, জীবন বাঁচাতে তার বাবা সেদিন পালাতে চেয়েও পারেননি। তার বাবার গায়ে ৫টি গুলি লেগেছিল। একই সাথে স্থানীয় রাজাকাররা লাশের শরীর থেকে খুলে নেয় মুল্যবান স্বর্নালংকার ও হাতিয়ে নেয় অর্থ।

নিহত যারা : কেতনার বিলের গণহত্যার মধ্যে একমাত্র রাজিহারের “পাত্র” বংশেরই কাশী নাথ পাত্র, বিনোদ পাত্র, বিনোদের স্ত্রী সোনেকা পাত্র, মেয়ে গীতা পাত্র, কানন পাত্র, মঙ্গল পাত্র, মঙ্গলের মা হরিদাসি পাত্র, মেয়ে অঞ্জলী পাত্র, দেবু পাত্রর স্ত্রী গীতা পাত্র, মোহন পাত্র, মেয়ে ক্ষেন্তি পাত্র, কার্তিক পাত্রর স্ত্রী শ্যামলী পাত্র তার ১২ দিনের শিশু অমৃত পাত্র, মেয়ে মঞ্জু পাত্র, মতি পাত্র, লক্ষ্মি কান্তর স্ত্রী সুমালা পাত্র, নিবারন বিশ্বাসসহ একই বাড়ির ১৯ জন প্রান হারিয়েছিলেন। এরমধ্যে ১২ দিনের শিশু অমৃতকে বুটে পৃষ্ঠ করে ও নিবারনকে ব্যানেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে নরপশু পাক সেনারা।

ক্ষোভ প্রকাশ : শহীদের স্বজন ধীরেন পাত্র, জগদীশ পাত্রসহ অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তাদের স্বজনরা ওইদিন পাক সেনাদের গুলিতে শহীদ হলেও আজো তাদের পরিবারকে শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এছাড়া ওইসব শহীদের স্মৃতি চিহ্ন সংরক্ষনে আজো কেতনার বিলে নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিসৌধ। কেতনার বিলে পাক সেনাদের নির্মম বুলেটে শহীদ হওয়া পাঁচ শতাধিক শহীদের স্মৃতি চিহ্ন সংরক্ষনের জন্য শহীদ পরিবারসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দরা প্রধানমন্ত্রী সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জোর দাবি করেছেন।

(টিবি/এএস/মে ১৫, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

১৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test