E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আজ কুষ্টিয়ার বংশীতলা দিবস

২০১৫ সেপ্টেম্বর ০৫ ১৫:৫৬:০৬
আজ কুষ্টিয়ার বংশীতলা দিবস

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি : আজ ৫ সেপ্টেম্বর শনিবার কুষ্টিয়ার বংশীতলা দিবস। কুষ্টিয়াবাসীর জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বীরত্বে গাঁথা এক ইতিহাসের দিন আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার বংশীতলায় পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ সংঘঠিত হয়।

জীবনের মায়া ত্যাগ করে মা মাটি ও দেশের মানুষকে সেদিন মুক্ত করতে কুষ্টিয়ার দামাল ছেলেরা লড়েছিল চির শত্রু পাকবাহিনীর সাথে। কয়েক ঘন্টা ধরে চলে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে পাকহানাদাররা তাদের বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়েও অপ্রত্যাশিতভাবে পরাজিত হয়।

বংশীতলার এ যুদ্ধে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, ৮ জনের লাশের দাফন স্থানীয়রা করেন দূর্বাচারাসহ বিভিন্ন জায়গায়। মোবারক আলী মোল্লাসহ ৩ জনের লাশ নিয়ে যায় পাকহানাদাররা। পর দিন আরো ২ জনের লাশ পাওয়া যায় এখানকার মাঠের জঙ্গলে। কারো কারো মতে আরো বেশি। স্বাধীনতার ৪৪ বছর অতিবাহিত হলেও এই যুদ্ধে নিহত শহীদ মোবারক আলী মোল্লা রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পায়নি আজো। পরিবারের পক্ষ থেকে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, ঢাকা কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডে কয়েক বার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ যোগাযোগ করেও কোন কাজ হয়নি।

অন্যদিকে কালের ধারায় ১৩ শহীদ পরিবারের খোঁজও রাখেনি কেউ। নাম মাত্র ভাতা আর বিজয় দিবসে কিছু উপঢৌকন ছাড়া কিছুই পায়নি শহীদ পরিবারগুলো। এ যুদ্ধে শহীদদের নিয়ে নানানভাবে ইতিহাস বিকৃতি হয়েছে। যুদ্ধের পরের দিন বংশিতলা থেকে উদ্ধারকৃত শহীদ মেজবার আলীর লাশ এবং দাফনকৃত কবরের জায়গা দখল নিয়ে হয়েছে নানা নাটকীয়তা। কেন এই মিথ্যাচার তা আজো অজ্ঞাতই রয়ে গেল। শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নির্মিত স্মৃতি সৌধে বরাবরই ১১ জনের নামের তালিকা থাকলেও স্মৃতিসৌধ সংস্কারের পর নতুন করে মেজবার আলী, সুরুজ লাল ও চাঁদ আলীসহ ১৩ জন শহীদের নামের তালিকা ঠাই পেয়েছে।

এজন্য এ যুদ্ধে নিহত শহীদ পরিবার, যুদ্ধে অংশগ্রণকারী মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নাছিম উদ্দিন আহমেদসহ সকল কমান্ডারকে সাধুবাদ জানিয়েছে।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নাছিম উদ্দিন আহমেদ জানান, ‘ইতিহাস সত্যের সন্ধ্যানে ধাবিত হয়, মিথ্যাচারকে প্রশ্রয় দেয়না। মিথ্যাচার করলে জাতি ক্ষমা করেনা’। মহান মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়ার ইতিহাসের এই বীরত্বের গাঁথা দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে কোন বড় ধরনের কর্মসূচী না থাকলেও স্থানীয়ভাবে শহীদ পরিবারের পক্ষে শহীদ মোবারক আলী মোল্লার ছেলে আলতাফ হোসেন মোল্লা, জেলা ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাসহ এলাকাবাসী শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা ও মাগফেরাত কামনা করে প্রতি বছরই স্মৃতিসৌধ চত্বরে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল করে থাকেন।

এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। আজ শনিবার বাদ আসর জেলা ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারসহ এলাকাবাসী শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছেন। অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন এই ঐতিহাসিক যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের প্রশাসক বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহিদ হোসেন জাফর।

ফিরে দেখা ৭১
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণের পর ৬ দফা ও ১১ দফা দাবী আদায়ের সংগ্রামকে চাঙ্গা করার উদ্দেশে সারা দেশের ন্যায় বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলায়ও সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করে প্রতিবাদ সভা, মিছিল, অসহযোগ আন্দোলন, প্রতিরোধ যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। প্রতিরোধ যুদ্ধের সময় বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গাতে অস্থায়ী রাজধানী এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় (মুজিবনগরে) অস্থায়ী রাজধানী থাকায় এ জেলা প্রতিরোধ যুদ্ধে ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

২৫ মার্চ রাতে ২৫০ জন পাক সৈন্য আকষ্মিকভাবে কুষ্টিয়ায় প্রবেশ করে। তারা শহরে প্রবেশ করেই কারফিউ জারী, ধর পাকড়, অত্যাচার, নির্যাতন ও যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে ধর্ষণ শুরু করে। এ সংবাদ সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক নেতাকর্মী, জনসাধারণ সবার মধ্যে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। প্রতিকার ও প্রতিরোধের আগুন জ্বলে ওঠে সবার মধ্যে। এ কারনে পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ফলে ১ সেপ্টেম্বর ভারত থেকে ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিয়ে কুষ্টিয়া জেলার সীমান্ত এলাকায় প্রবেশ করে। এ দলের বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন কুষ্টিয়া সদর থানার দামাল ছেলেরা।

কুষ্টিয়া শহরের আশপাশ ছিল এদের গন্তব্যস্থল। ১ সেপ্টেম্বর বিকেলের দিকে কুষ্টিয়া সদর থানার বৃত্তিপাড়া হতে পাক সৈন্য ও মিলিশিয়া পুলিশ বাহিনীর একটি দল দহকুলা গ্রামের মধ্যে দিয়ে আলামপুর গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের উপর হামলার জন্য আসে। পরদিন অনেক পাক সৈন্য ও মিলিশিয়া পুলিশ আলামপুর গ্রামে আসে। তারা এ গ্রামের অনেক বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয় এবং আলামপুর গ্রামে আসে। পাকবাহিনী এ গ্রামের অনেক বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয় এবং আলামপুর গ্রামের কয়েকজন সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে যায়।

এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই ৫ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া সদর থানার বংশীতলা ও দূর্বাচারা গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা পাক সৈন্যের হামলা প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে খুব সকালে প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন স্থানে সুবিধামত জায়গায় অবস্থান নিয়ে পাক সৈন্যের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

কিন্তু সকাল ১০ টা পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা কোন পাক সৈন্যে দেখতে না পেয়ে তারা মনে করেন আজ আর পাক সৈন্য আসবে না। তাই তখন মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই যে যার মত নাস্তা খেতে যান এবং কেউ কেউ এদিক সেদিক ঘোরাফেরার মধ্যে ছিলেন। আর এ দলের মুক্তিযোদ্ধা ও লাইট মেশিন গানম্যান আব্দুল কুদ্দুস তার সহকারী সেকেম আলীকে নিয়ে বংশীতলা গ্রামের চৌরাস্তার মোড়ে গিয়ে আমগাছের গুড়ির পাশে অবস্থান নেয়।

এমন সময় তারা দেখতে পান যে পাক সৈন্যরা পায়ে হেটে দূর্বাচারার দিকে আসছে। পাক সেনারা যখন আব্দুল কুদ্দুসের খুব কাছাকাছি চলে আসে তখন আব্দুল কুদ্দুস লাইট মেশিন গান দিয়ে তাদের উপর বিরামহীনভাবে ব্রাশ ফায়ার করতে শুরু করে। হঠাৎ করে খুব কাছ থেকে পাক সৈন্যের উপর লাইট মেশিন গানের ব্রাশ ফায়ার শুরু হওয়ায় তারা তাৎক্ষণিকভাবে পাল্টা আক্রমনের সুযোগ পায়নি। রাস্তার দু‘ধারে অথৈ পানি থাকায় অবস্থান নিতে ও পালাতে পারেনি। আব্দুল কুদ্দুসের ব্রাশ ফায়ারে ঘটনাস্থলেই অনেক পাক সৈন্য নিহত ও আহত হয়। বিরামহীনভাবে গুলিবর্ষণের ফলে লাইট মেশিন গানের ব্যারেল গরম হয়ে ফায়ার বন্ধ হয়ে যায় এবং এ সময়ে পাক সৈন্যের একটি গুলি এসে আব্দুল কুদ্দুসের পায়ে লাগে।

এ ফাঁকেই পাক সৈন্যরা সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। অবস্থা বুঝে আব্দুল কুদ্দুস ও সেকেম আলী পাক সৈন্যের নাগালের বাইরে চলে যায়। এ সময় দূর্বাচারা গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা গোলাগুলির শব্দ শুনে অগ্রসর হয়ে বংশীতলা গ্রামের কাছে চলে যায়। পাক সৈন্যরা বংশীতলা গ্রাম হতে দূর্বাচারা গ্রামের দিকে অগ্রসর হবার প্রাক্কালে মুক্তিযোদ্ধা ও পাক সৈন্যের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়।

এখানেও বেশ কিছু পাক সৈন্য নিহত ও আহত হয়। পাকিস্তানী বাহিনী পিছন থেকে তাদের আর্টিলারি গ্রুপ ২ ও ৩ মর্টার এবং রকেট ল্যান্সারের গোলা মুক্তিযোদ্ধাদের উপর নিক্ষেপ করতে শুরু করে এবং বংশীতলা হতে অনুমান ৩ মাইল দুরে কুষ্টিয়া টেক্সটাইল মিলে স্থাপিত পাক সৈন্যের ক্যাম্প হতেও যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে লক্ষহীনভাবে হেভি গানের গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে।

এ সময় দূর্বাচারার মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইসলাম অত্যান্ত সাহসিকতার সাথে পাক সৈন্যের অফিসার ক্যাপ্টেন জামিলকে হত্যা করেন। তাজুল ইসলাম এখান থেকে তার দলের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ফেরার সময় অন্য গোলার মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাক সৈন্যও চলে যায়। কয়েক ঘন্টা ধরে যুদ্ধ হয়। বংশীতলার যুদ্ধে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা কম-বেশি আহত হন এবং ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা পাক সৈন্যের হাতে ধরা পড়েন।

এ ৫ জনের মধ্যে ৩ জনের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানায়। বাকি ২ জনের বাড়ি হরিণাকুন্ডু থানায়। বংশীতলার যুদ্ধে পাক সৈন্যের সঙ্গে ১২ জন রাজাকার এসেছিল। তার মধ্যে ৬ জন যুদ্ধক্ষেত্র হতে পালিয়ে যায়। বাকি ৬ জন রাজাকার পাক সৈন্যের সঙ্গে ক্যাম্পে ফিরে যায়। পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী বংশীতলা যুদ্ধে অপ্রত্যাশিতভাবে পরাজিত হয়।

বংশীতলার এ যুদ্ধে ১৩ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ৮ জনের লাশ স্থানীয়রা দূর্বাচারাসহ বিভিন্ন জায়গায় দাফন করেন। মোবারক আলী মোল্লাসহ ৩ জনের লাশ নিয়ে যায় পাকহানাদাররা। পরের দিন আরো ২ জনের লাশ পাওয়া যায় এখানকার মাঠে জঙ্গলে। কারো কারো মতে আরো বেশি। এ যুদ্ধে শহীদরা হলেন, তাজুল ইসলাম, খোরশেদ আলম দীল, সেখ দিদার আলী (বীরপ্রতিক), ইয়াকুব আলী, গোলাম মোস্তফা রাজ্জাক, চাঁদ আলী মোল্লা, মোবারক আলী মোল্লা, আব্দুল মান্নান, মিরাজুল ইসলাম, সুরুজ লাল, মেজবার আলী, সাবান আলী ও কিয়মুদ্দিন।

শহীদদের পরিবারের লোকজন অভিযোগ করে জানিয়েছে, প্রতিবছর বংশীতলা দিবস, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে শহীদদের কবরে সম্মান জাননো হয়। বিশেষ দিনেই শহীদরা শ্রদ্ধা পায়, তাছাড়া অন্য কোন সময় তাদের কথা কেউই মনে রাখেনা।

কবরগুলোকে আরও সংস্কার করার জন্য প্রতিবছরই অনুদান আসে কিন্তু একশ্রেণীর মানুষ তা আত্মসাৎ করায় শুধু মাত্র পাকা নির্মাণেই কোন ভাবে আটকে আছে শহীদের কবর। শহীদদের পরিবারের লোকজন আক্ষেপ করে বলেন, যাদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে এ স্বাধীন দেশ, অথচ তাদের প্রতি অবহেলা আর অবজ্ঞা ছাড়া কিছুই জোটেনা।

(কেকে/এএস/সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test