E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আজ পটুয়াখালী মুক্ত দিবস

২০১৫ ডিসেম্বর ০৮ ১২:২০:৫৪
আজ পটুয়াখালী মুক্ত দিবস

পটুয়াখালী প্রতিনিধি : আজ (৮ ডিসেম্বর) পটুয়াখালী মুক্ত দিবস। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর একাত্তরের এই দিনে পাকহানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয় পটুয়াখালী জেলা। তবে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পার হলেও মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক সংখ্যা নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি। আর যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে শহীদদের গণকবরসহ স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো আজও রয়েছে অরক্ষিত।

সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায় পটুয়াখালী শহরের তিনটি গণ কবরের একই চেহারা। এর মধ্যে পুরাতন জেল খানা কবরটির অবস্থা অন্যগুলোর তুলনায় একটু পরিচ্ছন্ন হলেও বাকী গণকবর দুটির একটি জেলা প্রশাসকের বাস ভবনের দক্ষিন পার্শে এবং অন্যটি কালিকাপুর মাতব্বর বাড়ীতে অনেকটা পরিত্যাক্ত কবরের মত পরে রয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে দায়সারা ভাবে কিছু লোক এ সব গণ কবরগুলোতে ফুল দিতে গেলেও বর্তমানে ঝোপ জঙ্গলে পরিনত এসব গনকবরগুলো রক্ষনাবেক্ষনের কোন লোক নেই। একই অবস্থা স্মৃতি স্তম্ভগুলোরও। সংরক্ষনের অভাবে জেলা পরিষদের আওতাধিন মুক্তিযোদ্ধা সৃতি স্তম্ভ এবং সংস্কৃতি মন্ত্রনালয় কতৃক নির্মিত সৃতি স্তম্ভটি এখন গবাদী পশুর বিচরন ক্ষেত্রে পরিনত হয়েছে। বিকেলে এখানে শিশুরা খেলা-ধুলা করে এবং রাতে বসে মাদক সেবীদের আড্ডা। বিশেষ দিনগুলো ছাড়া এগুলোর পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে নির্বিকার প্রশাসন। এমন কি জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদও এ ব্যাপারে নিরব ভুমিকা পালন করছে।

মুক্তিযোদ্ধা বাদল ব্যানার্জী জানান, ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টা। পাকহানাদার বাহিনী অতর্কিত বিমান হামলা চালায় পটুয়াখালী শহরের কালিকাপুর এলাকায়। সেইসাথে ছত্রীসেনা নামিয়ে দখল করে নেয় পটুয়াখালী জেলা শহর। এসময় তারা নির্মমভাবে গণহত্যা চালিয়ে হত্যা করে শত শত নিরস্ত্র মানুষকে। শহরের বানিজ্যিক এলাকা পুরান বাজার অগ্নি সংযোগ করে শত শত দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি পুরিয়ে ভষ্মিভূত করে। এ সময় পাক হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকার-আলবদর-আলসামসরা চালায় লুটপাট। এলাকা ছাড়া করে হাজার হাজার নর-নারী, শিশু-কিশোর-কিশোরীকে। একাত্তরের দীর্ঘ ৮ মাস ধরে চলে জেলার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার পালা। মুক্তিযোদ্ধারা একে একে দখল করে নেয় পটুয়াখালী জেলা সদর ছাড়া সাব-সেক্টরের আওতায় অন্য সকল থানা। অবস্থা বেগতিক বুঝে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ৭ ডিসেম্বর রাতে পটুয়াখালী শহরে কারফিউ জারী করে দোতালা লঞ্চযোগে পলায়ন করে পাকসেনারা। এ সময় বগা এলাকায় লোহালিয়া নদীতে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিহত করার চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অত্যাধুনিক প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ না থাকায় পাক সেনারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ৮ ডিসেম্বর’৭১, সকাল সাড়ে ১০টা মিত্রবাহিনী পটুয়াখালীতে বিমান আক্রমন চালিয়ে লাউকাঠী খাদ্যগুদাম ঘাটে পাকিস্তানী পতাকাবাহী খাদ্য বোঝাই একটি কার্গো শেল নিক্ষেপ করে ডুবিয়ে দেয়। পাক-হানাদারদের সহযোগি রাজাকার-আলবদররা অস্ত্র ফেলে পালাতে শুরু করে। বিকেলে শহীদ আলাউদ্দিন শিশুপার্কে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে পটুয়াখালীর নিয়ন্ত্রনভার গ্রহণ করে।
মুক্তিযোদ্ধা মানস কান্তি দত্ত জানান, একাত্তরের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে শহিদ আলাউদ্দিন শিশুপার্কে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এরপর জেলার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের প্রতিহত করলে ৭ ডিসেম্বর রাতে হানাদাররা পটুয়াখালী ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু আফসোস যারা জীবন বাজী রেখে দেশকে স্বাধীন করল তাদের কথা মনে রাখেনি কেউ। পুরাতন জেলখানার গনকবরটি কেবলমাত্র চারপাশে দেয়াল নির্মান করে রাখা হয়েছে, এটাই কি শহীদদের প্রতি আমাদের সম্মানবোধ? এখন দায়সাড়া ভাবে সকল কিছু চলে এ জন্যই কি দেশটি স্বাধীন করা হয়েছিল? এটাই কি শহীদদের প্রাপ্য? তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যথেষ্ট বিভ্রান্তি রয়েছে, এসব বিভ্রান্তি দূর করতে সরকারি উদ্যোগ নেয়া দরকার। এছাড়া পটুয়াখালী মুক্ত দিবসটিকে সরকারি উদ্দ্যোগে পালনের দাবী জানান তিনি।
মুক্তিযোদ্ধা স.ম. দেলোয়ার হোসেন দিলিপ জানান, মুক্তিযোদ্দাদের স্মৃতি রক্ষার্থে গণকবরসহ স্মৃতি স্তম্ভগুলে সংরক্ষন করা প্রয়োজন এগুলো এখন পরিনত হয়েছে গবাদী পশুদের বিচরন ক্ষেত্র ও মাদক সেবিদের আখড়ায়। আমরা এ ব্যাপারে প্রশাসনের সাথে কথা বলেছি যাতে তারা এগুলের পবিত্রতা রক্ষায় নজর দেয় এবং পটুয়াখালী হানাদার মুক্ত দিবসটিকে সরকারি ভাবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পটুয়াখালী জেলা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার নির্মল কুমার রক্ষিত জানান, একাত্তরের ২৫ মার্চ ঢাকায় হানাদারের আক্রমনের খবর পেয়ে ২৬ মার্চ থেকে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে শুরু হয় প্রতিরোধ। বর্তামান সরকারি মহিলা কলেজ এলাকায় স্থাপন করা হয় মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষন ক্যাম্প। তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবদুল আউয়ালের সহয়তায় পুলিশ লাইন অস্ত্রাগার থেকে রাইফেল এনে তা তুলে দেয়া হয় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। জেলার মাদারবুনিয়া, কালিশুরী, পাতাবুনিয়া, মৌকরন ও দুমকী এলাকায় পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে মুক্তিযোদ্ধারা। ১৮ নভেম্বর গলাচিপার পানপট্টিতে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজয় ঘটে পাক হানাদারদের । মুক্তিয্দ্ধু চলাকালীন সময়ে স্বাধীনতাকামীদের ধরে এনে পটুয়াখালী পুরান জেল খানায় গুলি করে হত্যা করা হত। জেল খানার দক্ষিন পশ্চিম কর্নারে মৃত ও অর্ধমৃতদের কবর দেয়া হত। অজতœ আর অবহেলায় পড়ে আছে এ কবরগুরো । স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরে আজও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবরগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি এটা অত্যন্ত দুঃখের। তবে সরকার যে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সম মর্যাদা প্রদান করতে যাচ্ছে এটা অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ বলে মনে করেন তিনি।

স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও যদি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে এমন সব বিতর্ক অব্যাহত থাকে তবে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস কি ভাবে জানবে? সে প্রশ্ন সবার।

(এসডি/এইচআর/ডিসেম্বর ০৮, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test