E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মার্কিন চিত্র পরিচালক লেয়ার লেভিন

২০১৭ এপ্রিল ০৮ ২০:০৭:২৭
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মার্কিন চিত্র পরিচালক লেয়ার লেভিন

আম্বিয়া অন্তরা


সৌভাগ্যবশত একজন মহান মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। তাঁর নাম লেয়ার লেভিন। আমেরিকান একজন চলচ্চিত্র পরিচালক ও আলোকচিত্র শিল্পী। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যুদ্ধ চলাকালে কিছু দুর্লভ চিত্রধারন করেছিলেন। গত ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জ্যাক্সন হাইটস, পি এস-৬৯, নিউইয়র্কে মুক্তধারার অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছিলেন।

চলচ্চিত্র পরিচালক ও আলোকচিত্র শিল্পী লেয়ার লেভিন, যিনি ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর ছুটে এসেছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। বাঙালিদের উপর তখন থেকেই তাঁর একটা মায়া লেগে যায়। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর একদিন তিনি তার উকিল মর্টেন হ্যামবার্গ-এর কাছ থেকে জানতে পারেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও শরণার্থীদের দুর্দশার কথা। এরই মধ্য নিউইয়র্ককে ১ আগস্ট ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ তাঁকে অনুপ্রাণিত করে।

উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সচেতনতা এবং ত্রাণ তহবিল বাড়ানোসহ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নৃশংসতার খবর বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টায় অনুষ্ঠিত ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এখন ইতিহাসের একটি অংশ। এতে অংশ নিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন, ওস্তাদ রবি শঙ্কর, বব ডিলান, লিয়ন রাসেল, রিঙ্গো স্টার, ওস্তাদ আলী আকবর খান, ওস্তাদ আল্লা রাক্ষা, বিলি পিস্টনের মত খ্যাতিমান সব শিল্পীরা।

লেয়ার লেভিন এদের প্রায় সকলকে চিনতেন। কেননা তিনি তখন শর্ট ফিল্ম, ডকুমেন্টারি বানানোর পেশা ও নেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে লেয়ার লেভিন ও তার স্ত্রী তাদের প্রথম সন্তানকে বরণ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। তারপরও তিনি চুপচাপ বসে থাকতে পারলেন না। স্ত্রীকে একা রেখে চলে এসেছিলেন পশ্চিম বাংলায়। বাঙালিদের কথা সেলুলয়েডে ধারণ করার জন্য দুই মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন।

এভাবে কাজের মধ্যে ডুবে থেকেই একদিন লেয়ার লেভিন ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র ট্রাকটি দেখে ফেলেন এবং সেইদিন থেকেই তিনি এই গানের দলের সঙ্গে ঘুরতে থাকেন শরণার্থী ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। অক্লান্ত পরিশ্রমী এই আলোকচিত্র শিল্পী ১০ নভেম্বর ১৯৭১ তাঁর ত্রিশ তম জন্মদিন পালন করেন গোলাবারুদের গন্ধের ভেতর বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে।

‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র শিল্পীবৃন্দের গানগুলো যে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিচ্ছে, সেদিন হয়তো তিনি এতটা বুঝতে পারেননি। তবুও যারা মানব প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন তাঁরা ভালো করেই বুঝতে পারেন অতীতের দিনগুলো ফিরে দেখার মধ্যে কতটা ভালোবাসা কতটা আবেগ লুকিয়ে থাকে, আর সেটা যদি হয় ইতিহাস লিখনের সময়! তাই হয়তো তিনি মুক্ত হবার অদম্য শক্তির ভাষা তুলে যেতে লাগলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এমন সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে যারা জড়িত থাকেন তাদের থাকে দুটি প্রত্যাশা। প্রথমত, তাৎক্ষণিক মনোযোগ আদায়ের জন্য এই শৈল্পিক সৃষ্টিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা; দ্বিতীয়ত, অতীতের বাতিঘর নিখুঁত ভাবে জ্বালিয়ে রাখা, যাতে বর্তমানে দাঁড়িয়ে আলোকিত হবার অভাব না থাকে।

লেভিনের আশা ছিল, পাকিস্তানিদের সহিংসতার কথা আমেরিকাবাসীদের জানাতে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা। যা কিনা প্রথম প্রত্যাশা মেটানোর কাজ হত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য বা যোগান না পাওয়াতে লেয়ার লেভিনের ২২ ঘণ্টার ধারণকৃত ফুটেজ পড়ে থাকলো তাঁর বাড়ির বেসমেন্টে। অর্থাৎ তিনি তার পরিশ্রমের ফসল ঘরে তুলতে পারেননি ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও। আশ্চর্যজনক ভাবে যা ঘটে গেল, তা হল শূন্য থেকেই অর্থাৎ প্রথম ধাপটি না পেরিয়েই প্রত্যাশার দ্বিতীয় কাজটি শুরু করে দেন তারেক মাসুদ ও তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ।

মাহমুদুর রহমান বেণুর কাছ থেকে তারেক মাসুদ জানতে পারেন লেয়ার লেভিনের কথা। তারপর থেকেই শুরু হয় লেভিনকে খোঁজার পালা। অবশেষে ১৯৯০ সালে আসে সেই শুভক্ষণ। তারেক মাসুদ ও তার স্ত্রী ক্যাথরিন গিয়ে সরাসরি হানা দেন লেয়ার লেভিনের বাড়িতে। মূলত ক্যাথরিন মাসুদই লেয়ার লেভিনকে রাজী করিয়ে এবং প্রয়োজনীয় চুক্তি সই করে ২০ বছর পর উদ্ধার করে আনেন মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় তাদের কাজ। আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় এক অবিস্মরণীয় কীর্তি 'মুক্তির গান'-এ।

লেয়ার লেভিনের দুঃসাহসী কাজ আমাদেরকে আজো অনুপ্রাণিত করে। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদকে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা অনন্য এক অধ্যায়কে অন্ধকার গুহা থেকে টেনে বের করে আলোর মুখ দেখানোর জন্য। আমাদের তরুণরা লাল-সবুজ পতাকার আশ্রয়স্থল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বের গভীরতা নতুন এক মাত্রায় অনুভব করে।

বলতে দ্বিধা নেই, স্বাধীনতা পরবর্তী আমাদের অর্জন যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ব্যর্থতাও। এরপরও সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনাময় একটি দেশ এ কথা বারবার উচ্চারিত হয়ে এলেও আমরা সেই সম্ভাবনাটুকু কাজে লাগাতে পারিনি যথোপযুক্তভাবে। অশিক্ষা, দুর্নীতি, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, জঙ্গিবাদসহ নানা সমস্যার ফলে কাংখিত উন্নতি হয়নি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির।

স্বাধীনতার সুফল বাংলার ঘরে ঘরে পৌছাতে প্রয়োজন দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে রাস্ট্রে ও সমাজে সুশাসন । তরুণদেরকে সুশিক্ষিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলে হবে। তবেই শুধু ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান সার্থক হবে, সার্থক হবে লেয়ার লেভিনদের মতো মহৎপ্রাণ মানুষের দুঃসাহসী সৃষ্টি কর্ম।

লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী। তথ্য সূত্র : অনলাইন।

পাঠকের মতামত:

৩০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test