E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

একটি হাওয়াই গোপন রিপোর্ট এবং ঠাকুরঘরে কে রে, আমি কলা খাই না

২০১৬ এপ্রিল ০৫ ১৪:২৭:৪৭
একটি হাওয়াই গোপন রিপোর্ট এবং ঠাকুরঘরে কে রে, আমি কলা খাই না

প্রবীর সিকদার : হামলার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ফরিদপুরে নৃশংস হামলার শিকার হয়েছেন আওয়ামীলীগ নেতা এডভোকেট বদিউজ্জামান বাবুল। এর আগেও একই ধরণের হামলার শিকার হয়েছেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ও মুক্তিযুদ্ধের সাব সেক্টর কমান্ডার, প্রবীণ আওয়ামীলীগ নেতা ক্যাপ্টেন নূর মোহাম্মদ বাবুল, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শওকত আলি জাহিদ, কৈজুরির অন্ধ বঙ্গবন্ধুভক্ত মজিবর রহমান ওরফে শেখ সাহেব, ফরিদপুর জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলক সেন প্রমুখ। সব হামলার ধরণ ও কারণ এক ও অভিন্ন।

এই সব হামলার ঘটনা ক্ষমতা বা রাজনীতির কেন্দ্রের অনেককেই ভাবিয়ে তুলেছে। বদিউজ্জামান বাবুলের ওপর নৃশংস হামলার পর দাবি উঠছে যথাযথ তদন্তের। কে করবে এই তদন্ত ? ফরিদপুরের বর্তমান প্রশাসন ? ফরিদপুরের যেকোনো অশিক্ষিত চায়ের দোকানী বা রিক্সাচালকও এই প্রশ্নে এক গাল হেসে বলবেন, ফরিদপুরের বর্তমান সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের নিয়ন্ত্রকদের বহাল রেখে কোনও হামলার ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত সম্ভব নয়। যদিও ধারণা করা হচ্ছে, বদিউজ্জামান বাবুল হত্যা প্রচেষ্টার ঘটনা ধামাচাপা দিতে আইওয়াশ ধরণের একখানা তদন্ত করবেন কিংবা করছেন ফরিদপুরের বর্তমান সরকারি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রকরাই; কেননা প্রবল ক্ষমতাধরদের সূতার টানই যেখানে আসল এবং শেষ কথা।

এই যখন অবস্থা তখন আমার হাতে এসেছে স্বাক্ষর বিহীন তিন পৃষ্ঠার একটি হাওয়াই গোপন রিপোর্ট। এই রিপোর্টটি কে বা কারা তৈরি করেছেন, কার উদ্দেশে তৈরি করেছেন সেটি স্পষ্ট নয়। তবে এটা স্পষ্ট যে, ওই হাওয়াই গোপন রিপোর্টটি ফরিদপুরকে নিয়েই করা, যা ফরমায়েশি এবং প্রবল ক্ষমতাধরদের রক্ষার একটি দুর্বল বা আহাম্মকি অপচেষ্টা। তবে কি ফরিদপুর নিয়ে বিব্রত ঢাকার কোনও ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ফরিদপুরের দায়িত্বশীল কোনও মহলের কাছে ফরিদপুর নিয়ে কোনও ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে! ওই ব্যাখ্যায় কি ফরিদপুরের কোনও পরাক্রমশালী ও তার ঘটন অঘটন পটীয়সী অনুসারীদের নাম রয়েছে! যদিও আমার এই বলাটি আমার নিজস্ব ধারণাপ্রসূত। আর ওই ধারণার কারণ, ওই হাওয়াই রিপোর্টে বলা হয়েছে, আওয়ামীলীগ নেতা বদিউজ্জামান বাবুলের ওপর হামলার পর সাবেক এফবিসিসিআই সভাপতি একে আজাদের সমর্থকরা অপপ্রচার করেছে যে, ওই হামলার নেপথ্যে নাকি রয়েছেন ফরিদপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর, যিনি এক মন্ত্রীর ভাই। বাবুলের ওপর হামলার পর আমি ব্যক্তিগতভাবে বাবর সাহেবের নাম শুনিনি। আমি শুনেছি জনৈক 'পাঁঠা সোহাগ'- এর নাম। ফরিদপুর পুলিশ 'পাঁঠা সোহাগ'কে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারতো, কিন্তু করেনি। আর সেই পুলিশ গ্রেফতার তো দূরে থাকুক, ওই ঘটনা নিয়ে বাবর সাহেবকে জিজ্ঞেস করবে, সেটা স্বপ্নেও ভাবা যায় না! আর তাইতো ওই হাওয়াই গোপন রিপোর্টে এক মন্ত্রী ও তার ভাইকে দেবতার আসনে বসিয়ে চূড়ান্ত আক্রোশ প্রকাশ করা হয়েছে ফরিদপুরের ত্যাগী সব আওয়ামীলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে, যারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর চরম দুর্দিনে ফরিদপুরে আওয়ামীলীগকে রক্ষা করেছেন এবং অবর্ণনীয় নির্যাতন সয়ে তিলে তিলে আওয়ামীলীগকে আজকের পর্যায়ে এনেছেন। পরিতাপের বিষয় আজ সেই ফরিদপুর আওয়ামীলীগ বিএনপি-জামায়াত থেকে আসা হাইব্রিডদের নিয়ন্ত্রণে। অবশ্য একটি সূত্র ধারণা করছে, ওই হাওয়াই গোপন রিপোর্টে বাবুলের ওপর হামলাকারী হিসেবে আরো দুটি নাম সংযুক্ত হতে পারে। স্থানীয় এক গডফাদার নিয়ন্ত্রিত একটি দৈনিক পত্রিকার একটি খবর সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেই নাম দুটি হচ্ছে, এক ডজন সাজানো মামলায় দীর্ঘদিন কারানির্যাতন ভোগকারী আওয়ামীলীগ নেতা মোকাররম মিয়া বাবু ও ক্ষমতার দাপট খাটিয়ে বিতাড়ন করা ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কবিরুল ইসলাম সিদ্দিকি। ওই সূত্রটি আরো বলেছে, গোপন রিপোর্ট ফাঁস হয়ে যাওয়ায় রিপোর্টের ভাষা ও তথ্যে সুবিধামত পরিবর্তন আনা হতে পারে।

প্রিয় পাঠকদের উদ্দেশ্যে আমি সেই হাওয়াই গোপন রিপোর্ট হুবহু তুলে ধরছি:

গোপনীয়

বিষয় : ফরিদপুর জেলা আওয়ামীলীগে গ্রুপিং ও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি।

ফরিদপুর জেলা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্ম জেলা এবং আওয়ামীলীগের একটি শক্ত অবস্থানের জেলা হিসেবে গণ্য হলেও ১৯৭৩ সালের পরবর্তী সময় হতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামীলীগের মধ্যে আন্তঃকোন্দল ও গ্রুপিং এর কারণে ফরিদপুর সদর আসনে আওয়ামীলীগ সমর্থিত কোন এমপি নির্বাচিত হতে পারেননি। ২০০৮ সনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর সদর আসনে জনাব ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বিপুল ভোটে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বি বিএনপি'র সাবেক মন্ত্রী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ এবং বিএনপি সমর্থিত জোটের জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। ২০০৯ হতে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। ফলে তিনি ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন। তিনি এলাকায় সৎ ব্যক্তি ও ফরিদপুরের উন্নয়নের রূপকার হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়। তাঁরই ছোট ভাই জনাব খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর বিগত উপজেলা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে ফরিদপুরের উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। পক্ষান্তরে আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য জনাব বিপুল চন্দ্র ঘোষ এবং জেলা আওয়ামীলীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক জনাব সৈয়দ মাসুদ ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে জনাব ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের প্রবল বিরোধিতা করেন, যার ফলে এ দু'টি নির্বাচনেই ফরিদপুর সদর আসনে আওয়ামীলীগ পরাজিত হয়। ২০০৮ সালে নির্বাচিত হয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পরেও উল্লেখিত জনাব বিপুল ঘোষ ও জনাব সৈয়দ মাসুদসহ সদর আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি জনাব খলিফা কামাল মুষ্টিমেয় ক'জন লোক নিয়ে জনাব ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এর বিরোধিতা করেছেন, অথচ আওয়ামীলীগের রাজনীতির পক্ষে এবং ২০১২-২০১৫ সাল পর্যন্ত কতিপয় রাজনৈতিক দলের হিংসাত্মক কর্মসূচীর বিরুদ্ধে দলীয় কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপে কখনো তাদের দেখা যায়নি।

২০১৪ সালের নির্বাচনে ফরিদপুর থেকে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য এফবিসিসিআই এর সাবেক সভাপতি জনাব একে আজাদ চেষ্টা করেছেন বলে জানা যায়, কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়ে পরবর্তীতে বিপুল ঘোষ ও সৈয়দ মাসুদগণের সাথে যোগ দেন এবং মন্ত্রী মহোদয়ের বিরোধীদেরকে তিনি নিয়মিত প্রচুর অর্থ প্রদান করেন বলে ব্যপক জনশ্রুতি আছে। এ ছাড়াও বিএনপি নেতা জনাব চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের সাথেও ঢাকাতে অত্যন্ত সুসম্পর্ক বজায় রাখছেন বলে জানা যায়। মাননীয় মন্ত্রী, মাননীয় সংসদ উপনেতা এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহর মধ্যে বিভেদ তৈরী করে রাখতে জনাব একে আজাদ সর্বদা তৎপর থাকেন।

গত ২২-০৩-২০১৬ খ্রি: তারিখে ফরিদপুর জেলায় ব্যাপক উৎসাহ উদ্দিপনার মধ্যে দিয়ে ফরিদপুর জেলা আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত কাউন্সিলে জনাব সুবল চন্দ্র সাহা সভাপতি এবং জনাব সৈয়দ মাসুদ সেক্রেটারী নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার পর জনাব সৈয়দ মাসুদ জেলা আওয়ামীলীগের নতুন সভাপতি কিংবা দলের অন্য নেতাদের না জানিয়ে গত ৩০-০৩-২০১৬ খ্রি: তারিখ ০২ টি মাইক্রোবাসযোগে মাত্র ৮/১০ জন লোক নিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর মাজারে গমন করেন। তার এ আচরণে জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতিসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ কর্মীদের মাঝে হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। কারণ সকলের প্রত্যাশা ছিল নবনির্বাচিত সভাপতি ও সেক্রেটারী দলের সকল নেতাকর্মী নিয়ে মাজার জিয়ারতে যাবেন।

গত ৩০-০৩-২০১৬ খ্রি: তারিখ রাত ০৯.০০ টার সময় জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট জনাব বদিউজ্জামান বাবুল তাঁর নিজ চেম্বার হতে বাসায় ফেরার পথে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতিকারীরা তাকে হামলা করে ধারালো অস্ত্রদ্বারা কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে। তাঁকে উদ্ধার করে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে ঢাকায় প্রেরণ করা হলে তিনি বর্তমানে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঘটনার সাথে সাথে ফরিদপুর শহরে একে আজাদ এর সমর্থক কিছু লোক অপপ্রচার চালাতে থাকে যে, মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের আপন ভাই জনাব মোহতেশাম হোসেন বাবর এর নির্দেশে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তাদের এ অপপ্রচার মিথ্যা ও বানোয়াট বলে প্রতীয়মান হয় এ কারণে যে, জনাব মোহতেশাম হোসেন বাবর বর্তমানে ফরিদপুরের রাজনীতিতে শুধু আওয়ামীলীগ নয় সকল মতের ও দলের লোকজনের নিকট ব্যাপক জনপ্রিয়।

২০১৪ সালে উপজেলা নির্বাচনে তিনি ৮৮,০০০ ভোট পেয়ে বিজয় লাভ করেন ও উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পূর্বেও বিশিষ্ট সমাজ সেবক হিসেবে ফরিদপুরের রাজনীতিতে উন্নয়নের ছোঁয়া আনেন এবং বিগত বছরগুলোতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আওয়ামীলীগকে তৃণমূল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির হৃদয়ে ঠাঁই করে দিতে সক্ষম হন। বিশ্বস্তসূত্রে জানা যায় একটি মহল যাদের সাথে জনাব একে আজাদের ও জনাব সৈয়দ মাসুদ এর সুসম্পর্ক রয়েছে এবং যারা মাননীয় মন্ত্রীর বিরোধী বলে পরিচিত তারাই ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে এ হামলার ঘটনা ঘটিয়ে জনাব খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর এর সমর্থকগণের উপর চাপানোর অপচেষ্টা করছেন যাতে ফরিদপুর আওয়ামীলীগে আগের মত কোন্দল শুরু হয় এবং ভবিষ্যতেও নির্বাচনে সদর আসনে আওয়ামীলীগ জয়লাভ করতে না পারে। তাছাড়া ফরিদপুর বিভাগীয় শহর ও সিটি কর্পোরেশন ঘোষণা হতে পারে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের সমর্থিত কোন শক্তিশালী প্রার্থীর মনোনয়ন বাধাগ্রস্থ করার জন্য এগুলো তাদের পরিকল্পিত পদক্ষেপ বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়।

এহেন অবস্থায় ফরিদপুর আওয়ামীলীগের রাজনীতিকে সংহত করার জন্য একে আজাদের বিপুল অর্থের কুপ্রভাব এবং কুটকৌশল থেকে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক জনাব সৈয়দ মাসুদ, বিপুল ঘোষ, খলিফা কামাল, মাহবুবুর রহমান খান, শামীম হক গণকে দূরে রাখতে আওয়ামীলীগের হাই কমান্ডের জরুরী হস্তক্ষেপ ও নির্দেশনা আশু প্রয়োজন।

এই হাওয়াই গোপন রিপোর্ট নিয়ে কি এমন আর বলার আছে! এই হাওয়াই রিপোর্টটি যতবার পড়েছি, ততবারই আমার মনে পড়েছে বহু পুরনো একটি লাইন, 'ঠাকুরঘরে কে রে, আমি কলা খাই না'।



(পিএস/অ/এপ্রিল ০৫, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test