E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

একাত্তরের ঘাতক লাল মিয়ার ফাঁসি চাই

২০১৭ মে ০৮ ১২:৩২:১৭
একাত্তরের ঘাতক লাল মিয়ার ফাঁসি চাই

প্রবীর সিকদার


৮ মে, ১৯৭১। আমার বাবা স্কুল শিক্ষক পরেশ চন্দ্র সিকদার, দাদু মনোরঞ্জন পোদ্দারকে ধরে নিয়ে গেল সশস্ত্র রাজাকার ও বিহারীরা। আর আমি বাবা-দাদুকে পাইনি। কোথায় কোন অবস্থায় তাদের খুন করা হয়েছে তা আর জানা যায়নি। কোনও হদিস মেলেনি তাদের লাশেরও। ওই দিনই ঘাতক শিরোমণি লাল মিয়ার নির্দেশে সলিম সেখ ও তার কয়েক সহযোগী দুর্বৃত্ত আমার চোখের সামনে রামদা দিয়ে কুপিয়ে, লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে আর উপর্যুপুরি ছুরিকাঘাতে নৃশংসভাবে খুন করে আমার কাকা দীনেশ চন্দ্র সিকদার, জীবেশ চন্দ্র সিকদার, দুলাল চন্দ্র সিকদার, বিভূতি সিকদার, মামা আনন্দ পোদ্দার, পরিবারের সবচেয়ে প্রবীণ অভিভাবক অজিত সিকদার সহ আমার অন্তত ১১ স্বজনকে।  নৃশংস এই ঘটনাটি ফরিদপুর জেলার কানাইপুর সিকদার বাড়ির। ওই দিন কানাইপুরে ধীরেন্দ্র নাথ সাহা, অজিত পোদ্দার, অশোক সিকদার, নিতাই চন্দ্র পোদ্দার, নিমাই চন্দ্র পোদ্দার, খগেন্দ্র নাথ পোদ্দার, নৃপেন্দ্র নাথ পোদ্দার, আনন্দ দত্ত, মন্মথ সেনসহ আরও অন্তত ২০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। রক্তাক্ত ও মৃত্যু পথযাত্রী স্কুল শিক্ষক কাকা দীনেশ চন্দ্র সিকদার ওই অবস্থাতেও আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন এবং কেঁদে কেঁদেই বলেছিলেন, সাবধানে থাকিস, আমরা তো আর তোকে মানুষ করে যেতে পারলাম না! কাকার তাজা রক্তে ভিজে গিয়েছিল আমার শার্ট। সেদিন বেয়োনেট উঁচিয়ে রাজাকার-বিহারীরা আমাকে কাঁদতেও দেয়নি।

ওই কালো দিনটি তথা ৮ মে ‘কানাইপুর গণহত্যা দিবস’ নামে পরিচিত হলেও কেউ দিবসটি পালন করেন না। কিন্তু ওই নৃশংস গণহত্যার নায়ক রাজাকার ফজলু মুন্সীর নামে এলাকায় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় বিনা বাধায়, বেশ দাপটের সাথেই।

কানাইপুর গণহত্যার মূল নায়ক ফজলু মুন্সী ও তার ছেলে লাল মিয়া। ফরিদপুরের রাজাকার শিরোমনি আলাউদ্দিন খাঁর সহযোগিতায় সশস্ত্র বিহারী এনে সেই দিন এই নৃশংস গণহত্যার ঘটনা ঘটায় ফজলু মুন্সী ও লাল মিয়া। একাত্তরের ঘাতক লাল মিয়া আমার বাবা ও কাকার ছাত্র। সেদিন লাল মিয়ার সাথে আমার কাকা দীনেশ সিকদারের একটা আপস রফা হয়েছিল; ওরা আমাদের কাউকে বাঁচিয়ে রাখবে না, সকলকে একসাথে খুন করবে। প্রাথমিকভাবে আমাদের সকলকে একসাথে খুন করবার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে লাল মিয়া কথা রাখেনি। আমাকে ও আমার পরিবারের নারী-শিশু সদস্যদের আলাদা করে পাশে বসিয়ে রেখে সবাইকে নৃশংস কায়দায় খুন করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ওরা ও ওদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল রাষ্ট্র। তখন ওরা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। জেনারেল জিয়া সেই মামলাকে গলাটিপে হত্যা করার পর ফজলু মুন্সী ‘পীর ফজলুল হক’ পরিচয়ে দাপটের সাথে এলাকায় ফিরে আসে। সঙ্গে ফেরে তার ছেলে ঘাতক লাল মিয়াও। বেশ দাপটের সাথে ‘মিনি পাকিস্তান’ এর স্বাদ নিতে নিতেই মারা যায় ফজলু মুন্সী। এখনও বহাল তার ছেলে লাল মিয়া। একাত্তরের ঘাতক-রাজাকার ও কথিত পীর ফজলু মুন্সীর বাড়িতে ধুমধামের সাথে বার্ষিক ওরস হয়, শত শত মানুষ শরিক হয় ওই ওরসে।

এই বাংলাদেশের জন্য আমি আমার বাবাকে ‘বাবা’ বলে ডাকতে পারিনি। শৈশবে পাইনি স্বজনদের আদর। বাংলাদেশটির জন্য আমার এই উদ্বাস্তু জীবন। রাজাকারের ইতিবৃত্ত লেখার অপরাধে বোমা হামলায় উড়ে গেছে আমার পা, স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়েছে আমার একটি হাত; শরীরে বয়ে বেড়াতে হয় বোমা-গুলির অসংখ্য টুকরো, যা আমাকে আমৃত্যু যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। তারপরও কি আমি একাত্তরের দুর্ধর্ষ খুনি-রাজাকার লাল মিয়ার ফাঁসি দাবি করতে পারবো না!

বিচার পাই কিংবা না পাই, আমি উচ্চস্বরে দাবি করছি এবং দাবি করে যাবো, একাত্তরের নরঘাতক লাল মিয়ার ফাঁসি চাই।

পাঠকের মতামত:

২৯ মার্চ ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test