E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

শিক্ষা যোদ্ধা বেল্লাল

২০১৮ ফেব্রুয়ারি ০৭ ১৬:১১:৪২
শিক্ষা যোদ্ধা বেল্লাল

মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : বাবা-মা, স্বজনসহ প্রতিবেশীরা যখন আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, বেল্লাল ঠিক তখনই নিজের সাথে যুদ্ধ শুরু করে। দুই হাত নেই, অপুষ্টি ও প্রতিবন্ধকতায় শারীরিকবৃদ্ধিও থমকে দাড়ায় সেই কৈশরেই। কিন্তু অদম্য ইচ্ছা শক্তি ও মায়ের চোখের জল মুছে মুখে হাসি ফিরিয়ে আনতে পায়ের আঙ্গুলে কলম তুলে নেয় সে। মায়ের পরশ ও ভালবাসায় তাঁর কাঁধে ভর করেই লিখতে শুরু করে অ আ ক খ।

বর্ণমালা শিক্ষায় একটু পিছিয়ে পড়লেও স্কুল পরীক্ষা কিংবা সমাপনী পরীক্ষায় সে অণ্য সবার চেয়ে ছিলো এগিয়ে। কখনো বাবার কোলে, কখনো মায়ের কোলে করে সে প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে। শিক্ষা যোদ্ধা মো. বেল্লাল হোসেন এখন দাখিল পরীক্ষার্থী।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের উমেদপুর গ্রামের এই শিক্ষা যোদ্ধা বেল্লাল এখন অণ্য অভিভাবকও শিক্ষার্থীদের কাছে এক প্রেরণা। কলাপাড়ার নেছারুদ্দীন সিনিয়র মাদ্রাসা কেন্দ্রে এই শিক্ষার্থীর পরীক্ষার খাতায় লেখার জণ্য বিশেষ চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুন্দর পায়ের লেখা, ভুল কিংবা কাটাকাটি নেই পরীক্ষার খাতায়। পরীক্ষা হলের দায়িত্বরত শিক্ষক, পরিদর্শক ও শিক্ষার্থীরাও মুগ্ধ তার পায়ের লেখা দেখে।

উমেদপুর গ্রামের দিনমজুর মো. খলিল আকন এর চার সন্তানের সবার ছোট এই বেল্লাল। নিজে লেখাপড়া করতে না পাড়লেও সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে শ্রম বিক্রির টাকায় কখনো আধাপেট, কখনো বা সন্তানদের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিয়ে নিজেরা অভুক্ত থেকেছেন। এই টানাপোড়নের সংসারে অস্বাভাবিকতা ( প্রতিবন্ধকতা) নিয়ে জন্ম নেয় শিশু বেল্লাল।

প্রতিবেশী থেকে শুরু করে স্বজনরাও এই শিশুকে নিয়ে নানা ধরণের কুসংস্কার ছড়াতে থাকে। কারণ বেল্লালের দুই হাত নেই। এ কারণে একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে বেল্লালকে ঘরেই লুকিয়ে রাখে অসহায় বাবা-মা। বেল্লালের বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আরেকভাই এখন বরিশাল বিএম কলেজ এ অধ্যায়নরত।

বেল্লাল এর মা হোসেনেয়ারা বেগম বলেন, “ ওর জন্মের পরই চিন্তা করতাম, কি হইবে অর (বেল্লাল)। আমরা দুইজনই একদিন থাকমু না এই পৃথিবীতে তহন কে দ্যাখবে অরে। কোলে কোলে কইল্যা শাড়ির আঁচল দিয়া ঢাইক্কা (ঢেকে) অরে নিয়া বাইরে যাইতাম। মানুষ দ্যাখলে হাসতো। মানুষের হাসি দেইখ্যা ঘরে আইয়া কানতাম,আর কইতাম আল্লাহ কেন আমারে এই দুঃখ দিলা।”

তিনি বলেন, “বয়স পাঁচ-ছয় হওয়ার পর ঘরের পিড়িতে অরে দাড়া করাইয়া পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে চক দিয়া পিছনে হেলান দিয়া অরে লেখা শিক্ষাইছি। বেল্লালের মেধা ভালো অল্পতেই সব ল্যাকতে পরতো। মুখস্থ্য বিদ্যাও ভালো। তাই ঠিক করি স্কুলে দিমু। আমরা দু’জন(মা- বাবা) কোলে কইর‌্যা স্কুলে নিয়া এক কিলোমিটার দূরে স্কুল-মাদ্রাসায় যাইতাম। স্যারেরাও অরে ভালোবাসতো।” এভাবেই পিএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় বেল্লাল জিপিএ-৫ পেয়েছে। এখন দাখিল পরীক্ষা দিচ্ছে। কিন্তু তার শিক্ষা জীবন নিয়ে চিন্তিত এ শিক্ষা যোদ্ধার বাবা-মা।

বেল্লাল জানায়,বাবা-মায়ের কারণে লেখাপড়াও শিখছি। কিন্তু পরিবারের যে অবস্থা তাতে আর কতদূর পড়তে পারবো জানি না। কারণ বাবার তো বয়স হইছে, কে চালাইবে আমার লেখাপড়া। আমি শিক্ষক হতে চাই, সরকারি চাকুরী করতে চাই। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। কিন্তু যদি লেখাপড়াই না করতে পারি তাহলে তাঁদের স্বপ্ন পূরণ করবো কিভাবে।

তার পিতা খলিল আকন বলেন, “ ইচ্ছা থাকলে যে মানুষ সব পারে আমার বেল্লাল সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে। আগে মানুষ ওকে দেখে হাসতো, আজ সবাই বেল্লালকে ভালোবাসে। কতো মানুষ ওকে দেখতে আসে। লেখাপড়া করে বলেই বেল্লাল সবার প্রিয়। কিন্তু আমার বয়স হয়েছে, জানি না আর কতোদিন ওকে লেখাপড়া করাইতে পারবো। আমার আর্থিক অবস্থা ভালো নয় ,বেল্লাল প্রতিবন্ধী তাই তার লেখাপড়ার সহায়তার জন্য সবার সাহায্য সহযোগিতা চাই। আমার সংসারের অভাব অনটনের কারণে বেল্লালের জন্মের পর ভালোভাবে চিকিৎসা করতে পারিনি।

উমেদপুর দাখিল মাদ্রাসার সুপার মো.হাবিবুর রহমান জানান, বেল্লাল অনেক মেধাবী। মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সবাই তাকে ভালোবাসে। কোন ধরণের খরচ ছাড়াই তাকে লেখাপড়া করিয়েছে শিক্ষকরা। কিন্তু কলেজে উঠলে তো অনেক খরচ। ওর বাবা অনেক গরীব। মানুষের সহযোগিতা না পেলে হয়তো এখানেই থেমে যাবে বেল্লালের শিক্ষা জীবন।

(এমকেআর/এসপি/ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test