E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কুপি বাতির রাজ্যে আলোর ঝলকানি

২০১৯ এপ্রিল ১৬ ২২:২৮:১৮
কুপি বাতির রাজ্যে আলোর ঝলকানি

মো: আব্দুল কাইয়ুম, মৌলভীবাজার : পর্যটন জেলা মৌলভীবাজারের চায়ের রাজধানী হিসেবে খ্যাত, শ্রীমঙ্গল উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষা দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় অবস্থিত, চারিদিকে প্রকৃতির মনোরমসব দৃশ্য বেষ্টিত জনপদ নাহার চা বাগান। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় বিশ কিলোমিটারের দূরত্বে ফিনলে চা বাগান গেট পর্যন্ত পিচঢালা রাস্তা দিয়ে প্রকৃতির নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকন করতে করতে প্রায় পোনে একঘন্টার পথ বেয়ে শুরু হবে নাহারে পৌঁছার একমাত্র পথ। আকাঁবাঁকা প্রাহাড়ী উঁচুনিচু টিলা পেড়িয়ে আরো প্রায় ৪০ মিনিটের দুর্গম পথ বেয়েই নাহার চাবাগানে পৌঁছার গন্তব্য পথ। 

সাবেক আয়কর উপদেষ্টা গোলাম সারোয়ার এর মালিকানাধিন নাহার চা বাগানটি ২০০৮ সালে বিক্রি করা হয় দেশের বিখ্যাত শিল্প প্রতিষ্ঠান সিটি গ্র“পের কাছে। পিছিয়ে পড়া দুর্গম এলাকায় অবস্থিত এই বাগানটি চা বাগান হলেও ২০০৫ সালের পূর্ব পর্যন্তএটি কখনো লাভের মুখ দেখেনি। ২০০৬ সালের দিকে আয়কর উপদেষ্টা গোলাম সারোয়ার এর মালিকানাধিন থাকা অবস্থায় বাগানের ব্যবস্থাপক হিসেবে দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন মৌলভীবাজার সদর উপজেলার জগৎসি গ্রামের পীযুষ ভট্টাচার্য। মূলত গত একযোগের ব্যবধানে নাহার চাবাগানের বৈপ্লবিক এই পরিবর্তনের পিছনে বর্তমান ব্যবস্থাপক পীযুষ ভট্রাচার্যেরই অবদান সবচেয়ে বেশি এমনটি জানা গেছে বাগানের একাধিক চা শ্রমিকের সাথে কথা বলে।

জানা যায় ২০০৬ সালের দিকে বাগানের ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন পীযুষ ভট্রাচার্য। একটি চা বাগান হিসেবে সবদিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া এই বাগানের দ্বায়িত্ব গ্রহণ অনেকটাই পিচ্ছিল ও চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায় পীযুষ ভট্রাচার্যের জন্য।

কারন অন্যান্য চাবাগান গুলোতে যেখানে ব্যবস্থাপকের জন্য বাঙলোসহ উন্নত সব ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকে , সেখানে শুরুতেই নাহার চা বাগানের ব্যবস্থাপকের থাকার ক্ষেত্রে কোন বাঙলো ছিলনা। মান্দাতা আমলের একটি টিন সেডের ঘরই ব্যবস্থাপকের বাঙলো হিসেবে একমাত্র ভরসা। মাত্র ৭ বস্তা সিমেন্ট দিয়ে পুরাতন ভাঙ্গাচুরা সংস্কার করে বাগান মালিকের গাড়ি রাখার একমাত্র গ্যারেজকে ব্যবস্থাপকের বাঙলো হিসেবে প্রস্তুত করেন বর্তমান ব্যবস্থাপক। ছিলনা রাতের অন্ধকারে আলো জ্বালাবার কোন ব্যবস্থা, মাত্র ১৬ টাকা দামের দুটি কুপি বাতিই এই গহীণ অরেণ্যে আলো জ্বালাবার একমাত্র ব্যবস্থা। দুটি কুপি বাতি জ্বালিয়েই সেখানেই তার বসবাস। তীব্র ঝুঁকি এবং চাকুরী জীবনের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিদ্যুৎ ,গ্যাস, জেনারেটর ও মোবাইল নেটওয়ার্কসহ আধুনিক সব ব্যবস্থা থেকে বিচ্চিন্ন জনপদে অবস্তিত এই চাবাগানের দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন তিনি। শুরু হয় কঠিন এক পথচলার দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের যাত্রাপথ।

নাহার চাবাগানের বর্তমান ব্যবস্থাপক পীযুষ ভট্রাচার্যের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে খোলামেলা আলোচনা থেকে এসব তথ্য জানা যায়। অনেকটা আবেগতারিত হয়ে এই চাবাগানে তার একযোগের সাফল্যগাঁথা সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি জানান মাত্র ১৬ টাকা মূল্যের দুটি কুপি বাতি দিয়ে কাজ শুরু করি। চা শ্রমিকদের জন্য জরাজীর্র্ণ ছনপাতা দিয়ে তৈরি মাত্র ৭টি ঘর ছিল। শ্রমিকদের জন্য কোন রেশন ব্যবস্থা ছিলনা, মাত্র ১৯ টাকা বেতনে দৈনিক কাজ করতো এখানকার কর্মরত চা শ্রমিকরা।

তিনি বলেন এই বাগানের দ্বায়িত্ব গ্রহনকালে আমাকে বলা হল পুরাতন টিন সেড দিয়ে তৈরি একটি জরাজীর্র্ণ ঘরে থাকার জন্য, বিষয়টা আমার কাছে বিব্রতকর হওয়ায় আমি এটাকে বাদ দিয়ে গাড়ি রাখার জন্য তৈরি করা একটি গ্যারেজকেই ব্যবস্থাপকের বাঙলো হিসেবে বেছে নেই। দেশের সব প্রান্থে মোবাইল, ইন্টারনেটে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলেও এই বাগানে কোন মোবাইল নেওয়ার্ক, ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় আমি দীর্ঘদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকার পর অবশেষে কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলে তারা গ্রামীণ শক্তির সোলার প্যানেলের ব্যবস্থা করলে সেখানে মোবাইল চার্য দিয়ে যোগাযোগ শুরু হয় । তবে এই এলাকাটি মোবাইল নেটওয়ার্কেও আওতাভুক্ত না থাকায় নেটওয়ার্ক পেতে শুরু থেকেই সমস্যা তৈরি হয়।

নাহার চা বাগান ঘুরে জানা যায়, শুরুতে ১৫১ একর ভূমিতে চা উৎপাদন হলেও বর্তমান ব্যবস্থাপক পীযূষ ভট্রাচার্যের অনেক চেষ্টার পর আরো ২২৯ একর ভুমিসহ পতিত ভূমি উদ্ধারে সক্ষম হলে বর্তমানে তা বেড়ে ৩৮০ একরে দাঁড়ায় (১৫৪ হেক্টর)। তবে নাহার চাবাগানের সর্বমোট ভূমি ৮৬৪.৮৫ একর হলেও তার মধ্যে চা প্লান্টেশন ৩৮০ একর আছে বলে জানান পীযুষ ভট্রাচার্য।

নাহার চা বাগানে পৌঁছার কোন পাকা রাস্তাঘাট না থাকায় একমাত্র ফিনলে চা বাগানের মালিকানাধিন রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে হয় চা শ্রমিকসহ বাগানের স্টাফদের। বর্ষা মৌসুমে কাঁদামাটির কারনে বাগানের যানবাহন চলাচলে মারাতœক বিঘœ তৈরি হলে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসের মধ্যে ২ থেকে ৩ কিলোমিটার রাস্তা এ্যাস্কাভেটর দিয়ে সমান করে যান চলাচলের উপযোগী করা হয়। শুধুই রাস্তাঘাট নয় , বৈপ্লবিক পরিবর্তনের চিহৃ সব ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। রাতের নাহার এক অন্যরকম রূপ নেয়। চারিদিকে বৈদ্যতিক আলোর ঝলকানি, যেন ’’কুপি বাতি থেকে আলোর রাজ্য’’।

২০১৫ সালের দিকে বাগানে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও উন্নত জেনারেটারসহ চা উৎপাদনের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ বিশাল কারখানা তৈরি করা হয়। কারখানার পশ্চিম দিকে বিশাল উচুঁ পাহাড়ের চুড়ায় নাহার চা বাগানের চেয়ারম্যানের থাকার জন্য দৃষ্টিনন্দন বাঙলো তৈরি করা হয়েছে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাঙলোটিতে সুইমিংপুলসহ আধুনিক স্থাপত্য শৈলীর চমৎকার সংমিশ্রণ রয়েছে। রয়েছে নয়নাভিরাম ঝর্ণাধারা আর সুভিত ফুলের বাগান। নাহার চা বাগানের বর্তমান পরিবেশ দেখলে তার পূর্বের রূপ সম্পর্কে ধারনা পাওয়ার কোন উপায় নেই, দৃষ্টিনন্দন বাঙলো, সারিসারি চাঁয়ের গাছ আর বিশাল লেক মিলে চারপাশের পরিবেশকে করেছে অনেকখানি সমৃদ্ধ। বাগানটি সীমান্তবর্তী হওয়ায় ভারতের সীমান্ত আলোর কিরনে আর বাগানের বৈদ্যতিক আলোর সংমিশ্রনে রাতের নাহার এক অন্যরকম সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। যে দিখেই চোখ যায় শুধু আলো আর আলোর খেলা।

এই সমৃদ্ধির পিছনে রয়েছে চা শ্রমিকদের ঘামঝরানো শ্রমও। তাই কর্তৃপক্ষের চেষ্টায় বাগানের চা শ্রমিকদের জন্য নির্মিত বাড়ীগুলো অন্যান্য বাগানের থেকে অনেকটা উন্নত। চা শ্রমিকদের জন্য শুরুতে ৭টি জরাজীর্র্ণ ছনের ঘর থাকলেও বর্তমানে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষে সেখানে অত্যাধুনিক ৯৩টি পাকা ঘর নির্মাণ করা হয়েছে, রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ, স্যানিটেশনসহ আধুনিক সব সুবিধা। এখানে শ্রমিক আর মালিক পক্ষের রয়েছে শক্তিশালী সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক, কারন সিটি গ্র“পের মালিক পক্ষ তাদের নিজস্ব উৎপাদিত তীর মার্কার যে আটা খেয়ে থাকেন একই আটা নাহার চা বাগানের চা শ্রমিকরাও রেশন হিসেবে পেয়ে থাকেন।

প্রায় চারশ চা শ্রমিক কর্মরত রয়েছে এই বাগানে। ২০০৬ সালের দিকে বাগানে কর্মরত চা শ্রমিকরা অসুস্থ হলে যেখানে কোন চিকিৎসা সেবা পেতনা সেখানে বর্তমানে শ্রমিক এবং স্টাফদের স্বাস্থ্য রক্ষায় উন্নত মানের চিকিৎসা সেবা রয়েছে। স্টাফ কোয়ার্টার যেখানে শুরুর দিকে দুটি ছনের ঘর ছিল সেখানে বর্তমানে ১০টি পূর্ণ পাকা ঘর রয়েছে। রয়েছে উন্নত মানের স্যানিটেশন ব্যবস্থা । বর্তমানে বাগানের পূর্ণ পানি চাহিদা মিটানোর লক্ষে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক বেসরকারী এনজিও আইডিয়া’র সার্বিক অর্থায়নে বৃষ্টির পানিকে সংরক্ষণ করে উন্নত ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে পুরো বছরের জন্য প্রায় ২লক্ষ ৬০ হাজার লিটার নিরাপদ পানি মজুদের লক্ষে একটি প্রকল্প কাজ চলছে। জানা যায় এটি বাস্তবায়ন হলে পুরো বাগান জুড়ে আদর্শ স্যানিটেশন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এছাড়াও বর্তমানে বাগানের নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় সাড়ে ৭শ ফুট গভীর নলকুপ স্থাপন করে বাগানের সার্বিক পানির চাহিদা যোগান দিচ্ছে। নাহার চা বাগানের ব্যবস্থাপক পীযূষ ভট্রাচায্য জানান এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য আইডিয়া কর্তৃপক্ষকে আমাদের বাগানে চাঁয়ের আমন্ত্রন জানালে আলোচনা করে তাদের দেয়া প্রস্তাব গ্রহণ করি।

এক সময়ের ঘুনেধরা রুগ্ন চা বাগানটি বর্তমানে অনেকটা উন্নত চাবাগানে রূপ নেয়ায় এখানকার উৎপাদিত চাঁয়ের মানও অনেকটা উন্নত। ২০০৫ সালের দিকে এই বাগানে চাঁয়ের উৎপাদন ক্ষমতা ৩৬হাজার কেজি হলেও সময়ের ব্যবধানে ক্রমান্বয়ে তা বাড়তে থাকে। ২০১৬ সালে বাগানটির বাৎসরিক গড় উৎপাদন হয়েছে ২ লক্ষ কেজি চা। যার বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকার উপরে। ঐ বছর আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় এবং রেকর্ড পরিমান বৃষ্টিপাত হওয়ায় বৃদ্ধি পায় চাঁয়ের উৎপাদন ক্ষমতা । তবে ২০১৯ সালে আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে এবং চাহিদা পরিমান বৃষ্টিপাত হলে ২ লক্ষ কেজির উপরে চায়ের উৎপাদন লক্ষমাত্রা আশা করছেন নাহার কর্তৃপক্ষ।

(একে/এসপি/এপ্রিল ১৬, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test