E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শোকাবহ আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়

২০১৯ আগস্ট ২৫ ০০:০১:২৬
শোকাবহ আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বিশ্বের নৃশংশতম হত্যাকান্ড ঘটায় দেশীয় ও বিদেশী  ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ভাড়াটে খুনী কিছু বিপদগামী সেনাসদস্যদের দিয়ে। বহুবার নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর আক্রমন করে, জনসভায় গুলিবর্ষন করে, অসংখ্য নেতাকর্মীদের হত্যা করা হয়।

আন্দোলন দমনে ব্যর্থ হয়ে আবারও দীর্ঘ ২৯ বছর পর ২০০৪ সালে ২১শে আগস্ট বিএনপি সরকারের নেতৃত্বে দেশনেত্রীর জনসভায় বিশ্বের জঘন্যতম গ্রেনেড হামলা হয়। একে একে কয়েকটি গ্রেনেড হামলা হয় পাশ্ববর্তী বিল্ডিং এর উপর থেকে পরিকল্পিতভাবে। যেখানে মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমান সহ অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন, স্প্রিন্টারে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন শত শত আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীবৃন্দ। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় দেশনেত্রী প্রাণে রক্ষা পান। কিন্তু এখনও তাদের ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু জনগণ তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছে যা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় বিগত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। তাই এই শোকের আগস্ট মাসে আমাদের শোককে শক্তিতে পরিণত করে খুনীচক্র ষড়যন্ত্রকারীদের উৎখাত করতে হবে চিরতরে, প্রতিষ্ঠিত করতে হবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলার।
প্রতিটি রাষ্ট্রের যেমন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস থাকে তেমন তার পশ্চাতে কিছু দুঃখের স্মৃতিও থাকে। ষড়যন্ত্র, খুনাখুনি এরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ অধ্যায়কে যত সার্থকভাবে সমূলে ধ্বংস করা যায় সেই জাতি তত নিরাপদে এগিয়ে যেতে পারে এবং মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারে। বিষয়টি আপেক্ষিক ব্যাপার হলেও বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য। বাংলাদেশে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান বা সোভিয়েত রাশিয়ার মত বহু প্রদেশ, ভাষার সংস্কৃতির বিষয় নেই।
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিব নগর) পরিচালনায় দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, বিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জ্বতের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিজয় অর্জিত হয়। বাংলাদেশ লাভ করে স্বাধীনতা।
৮ জানুয়ারী পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন হয়ে ১০ জানুয়ারী ঢাকা পৌঁছালে তাঁকে অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা পদার্পন করা হয়। বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে লক্ষ জনতার সমাবেশ থেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ভাষণে বলেছিলেন কিভাবে পাকিস্তানী জুলুমবাজ সরকার তাকে চুক্তিতে সই করে মুক্তির আশ্বাস দিয়েছিল, নতুবা ফাঁসির কাস্টে ঝুলতে হবে এবং পাশে কবরও তৈরী করে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেছিলেন- আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, আমি মুসলমান। দয়াকরে আমার মৃতদেহটি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিবেন। এখানেই জাতির পিতা বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের স্বপ্নের সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমা প্রকাশ পায়।
১৯৭২ সালের জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু এ দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারী থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত এত অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে এক সার্বজনীন প্রশংসিত রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন, সৌদিআরব ও চীন ব্যতীত বিশ্বের বাকী সব দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ বঙ্গবন্ধুকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যায়। কিন্তু‘ দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতা বিরোধী দেশীয় ও বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে ছিল না। নানা অরাজকতার সৃষ্টি করছিল। বিশেষ করে ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশনায় খাদ্যবাহী জাহাজ ফিরে নেওয়া হয়। দেশে তখন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধু দেশের অরাজকতা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা প্রেমিক দলও জনগনের সাথে আলাপ করে “বাকশাল” ঘোষনা দেন, অর্থনীতির দ্বিতীয় বিপ্লব হিসেবে। তাঁর সংবিধানে ঘোষিত চার স্তম্ভকে (জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র) কার্যকর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সভায় গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। যেমন আমাদের কৃষক শ্রমিকরা দুর্নীতিবাজ না, শতকরা ৫ ভাগ, শিক্ষিত সমাজ ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, টাকা বিদেশে পাচার করে। অথচ এই শিক্ষিত ব্যক্তিরাই কৃষক শ্রমিকদের পরিশ্রমের টাকায় লেখাপড়া করেছে। কিন্তু তাদের ইজ্জত করে কথা বলে না, সম্মান করে না। যদি এই দুর্নীতিবাজ ঘুষখোর, চোরদের পশ্চিম পাকিস্তানীরা নিয়ে যেত তা হলে বাংলাদেশ হত সোনার বাংলা। জাতির পিতার এ বক্তব্যগুলোকে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা ভালভাবে নেয়নি। বরং তারা পাকিস্তান ও সা¤্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর সাথে হাত মিলাইয়ে ১৫ আগস্টে বিশ্বের জঘন্যতম হত্যাকান্ড ঘটায়। এখানে শুধুমাত্র কিছু বিপদগামী সেনাসদস্যবৃন্দ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে শেখ পরিবারের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখে। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষায় পরশ্রীকাতরতার এর কারণে খুনী মোশতাক কিছু পরশ্রীকাতর আওয়ামী নেতৃবৃন্দ এবং তার সহযোগী যুদ্ধাপরাধী ও লুটেরা সমাজ জড়িত ছিল। তারা মূলত পাকিস্তান ও সা¤্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীদের যোগসাজশে এই জঘন্য খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। এ সময়ে সামরিক বাহিনী প্রধান, পুলিশ প্রধান ও রক্ষিবাহিনীর প্রধানদের ভূমিকা রহস্যজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ। আগামী সুন্দর সোনার বাংলা তৈরীর প্রয়োজনে এর বিস্তারিত তদন্ত পূর্বক যথাযথ শাস্তির উদ্যোগ নেওয়া সময়ের দাবী। জাতির পিতা শ্রেণী বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন দেশীয় কমিউনিষ্টদের চাপে নয় (অনেকে মনে করেন, এমনকি বিশ্বাসও করেন) বরং তিনি দীর্ঘদিন সোভিয়েত রাশিয়া, চীন, কিউবাসহ বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশে জনগনের জীবনযাপন ও নিয়মনীতি পর্যবেক্ষণ- অধ্যায় করে উপরোক্ত চার স্তম্ভ ঠিক করেছিলেন। সে সময় অনেকে “মুজিববাদ” আখ্যা দিয়েছিলেন।
আমাদের জন্যে খুবই পরিতাপের বিষয় হল তিনি মুসলিম লীগ রাজনীতিতে বিশ্বাস ঘাতকতার অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন মীরজাফরের চরিত্রটি ও জানা। অনেক দেশী বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা থেকে তাঁকে ষড়যন্ত্রের কথা জানিয়েছিলেন। যদি বঙ্গবন্ধু ৩২নং বাড়িতে না থেকে বঙ্গভবনে থাকতেন সম্ভবত তা হলে বিশ্বের এই জঘন্যতম ঘটনা এড়ানো যেত। গানের কথায় “ যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই.......” আমার খুব মনে পড়ে। আজ বঙ্গবন্ধুর অভাব অনুভব করছে বাঙালী জাতি। বেঁচে থাকলে এতদিনে শ্রেণী বৈষমহীন স্বপ্নের সোনার বাংলা বিশ্বের দরবারে মাথা উচুঁ করে দাঁড়াত আর তিনি হতেন বিশ্বের শোষিত শ্রেণীর নেতা-বিশ্বনেতা-বিশ্ববন্ধু।

এই নৃশংস হত্যাকান্ডের সময় আমি মস্কোতে অর্থনীতি বিষয়ে পড়তেছিলাম। আমার কিছু রাশিয়ান বন্ধু আমাকে ক্ষিপ্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল। তোমরা কেমন জাতি, একজন স্বাধীনতার জনককে খুন করলা? এমনিতে এই নৃশংস হত্যাকান্ডের পর আমি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলাম, তার উপরে তাদের আক্রমনাতœক প্রশ্নে আরও কষ্ট পেলাম। যদিও শান্তনা দিলাম নিজেকে এইভাবে যে তারা তো জাতির পিতাকে ভালবাসা থেকে আমাকে এ প্রশ্ন করেছে। শান্ত হলাম, তাদের বুঝাতে চেষ্টা করলাম ষড়যন্ত্রের মূল বিষয়টি। সোভিয়েত রাশিয়ায় মহামতি লেনিনকে এক জনসভায় বক্তৃতা মঞ্চের গাড়ীর পিছন থেকে এক রুশ মহিলা গুলি করেছিল। যার ফলে তিনি বেশিদিন বাঁচতে পারেননি। এর অর্থ সব রাশিয়ান মহিলাকে খারাপ কি বলা যাবে? পরবর্তীতে বিষয়টি বুঝতে পেরে দুঃখ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু আমি তাদের জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলাম। এখান থেকে প্রকাশ পায় বিশ্ববাসী জাতির পিতাকে কত ভালবাসতেন এবং এখনও ভালবাসেন।

১৯৭৫ সালের পর এই খুনী সামরিক চক্র দীর্ঘ একুশ বছর ক্ষমতা দখল করে দেশকে পূর্বের মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান বানানোর অপচেষ্টা করেছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে যুদ্ধাপরাধী খুনীচক্র দেশ শাসন করতেছিল।১৯৬৬ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করা হয়। এবং বিশ্বের জঘন্য নৃশংস হত্যাকান্ডের বিচারের দাবি ৩৪ বছর পর বাস্তবায়িত হয়। অনেক বাধা বিপত্তি ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের মহাসড়কে।
বিশ্বের উন্নয়নের অন্যতম রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পৌছে যাবে মধ্যম আয়ের দেশে। উদযাপিত হবে দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। ২০৪১ সালে উন্নীত হবে জাতীর পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে। এ লক্ষ্যে প্রথমে প্রয়োজন ১৫ আগস্টের পর থেকে সমস্ত খুনি, ষড়যন্ত্র কারীদের মূল উৎখাত করে প্রয়োজনে মরণোত্তর যথাযথ শাস্তির কায়েম করা। এর পাশাপাশি জাতির পিতার শ্রেণী বৈষম্যহীন সোনার বাংলা কায়েমের লক্ষ্যে দেশে দূর্নীতি, ঘুষ, মধ্যস্বত্ব ভোগীদেরও লুটেরা ধনীদের দৌরাত্ব নস্যাৎ করে কৃষক শ্রমিকদের রাজত্ব কায়েম করতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতির পিতার সোনার বাংলা বিনির্মাণ হবে।

লেখক: প্রফেসর ড. প্রিয়ব্রত পাল
অর্থনীতি বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test