E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কিভাবে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতেন সাংবাদিকেরা?

২০১৬ মার্চ ২৫ ১৩:০৭:৩৮
কিভাবে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতেন সাংবাদিকেরা?

নিউজ ডেস্ক :১৯৭১ সালে নয় মাস বাংলাদেশে যুদ্ধের ভয়াবহতা আড়ালে রাখতে, তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার সব ধরনের চেষ্টাই করেছিল।যার মধ্যে অন্যতম ছিল সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেয়া।যুদ্ধের নয় মাসে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন অনেক সাংবাদিকও।তা স্বত্ত্বেও যুদ্ধের খবরাখবর প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।

১৯৭১ এর সেই অবরুদ্ধ সময়ে সাংবাদিকেরা কিভাবে যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করতেন?৭ই মার্চের ভাষণের পরই বোঝা যাচ্ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি কোন দিকে এগুচ্ছে।
অনেক বিদেশী সাংবাদিক খবরাখবর সংগ্রহের জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসতে থাকেন।

২৫শে মার্চ ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর উপর গণহত্যা চালায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী।এই খবর যাতে দেশের বাইরে প্রচারিত না হয় সেজন্য বন্দুকের মুখে সকল বিদেশী সাংবাদিককে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল আটকে রাখা হয় এবং ধরে করাচি পাঠিয়ে দেয়া হয়।

ব্রিটেনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার ২৬ বছর বয়সী সাইমন ড্রিং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চোখ এড়িয়ে থেকে যেতে সক্ষম হন।পরে তিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে ব্যাংককে গিয়ে যে প্রতিবেদন পাঠান সেটি ১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ছাপা হয়।

বাংলাদেশ জেনোসাইড এন্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস বইতে অনূদিত সে রিপোর্টের কয়েকটি লাইন তুলে ধরা হলো...

“আমি নিরাপত্তা রক্ষীদের তল্লাশী ফাঁকি দিয়ে মুহুর্তের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানগামী বিমানে উঠতে সমর্থ হই। তারপরও আমাকে দু’দুবার আটক করা হয় এবং ব্যাগেজসহ আমাকে তন্নতন্ন করে তল্লাশীর মুখে পড়তে হয়। তবুও আমার এ প্রতিবেদন তৈরীর নোট ব্যাংকক পর্যন্ত অক্ষত ছিল"।

"ঢাকা এখন ধ্বংস এবং ভীতির নগরী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঠান্ডা মাথায় ২৪ ঘন্টাব্যাপী অবিরাম শের বর্ষনে সেখানে সাত হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে। ছাত্রাবাসে নিজেদের বিছানাতেই ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে।বাজারগুলোতে কসাইদেরকে নিজেদের দোকানের পিছনে হত্যা করা হয়েছে"।

২৫ এবং ২৬শে মার্চে ঢাকায় বেশ কয়েকটি পত্রিকা আক্রান্ত হবার পর অনেক সাংবাদিক আত্নগোপনে ছিলেন।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বড় পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। অন্যরা তখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।হত্যাযজ্ঞের খবর ছাপানোর কোন উপায় নেই।তিনমাস বন্ধ থাকার পর স্বল্প পরিসরে বেরিয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাক।

পত্রিকার তৎকালীন প্রতিবেদক সৈয়দ শাহজাহান জানালেন তখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রন এতাটাই জোড়ালো ছিল যে যুদ্ধের খবর ছাপানোর কোন উপায় নেই।

সদ্য স্বাধীনতা ঘোষণাকারী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের খবরাখবর তখনও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছিল।২৫শে মার্চের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে জোরপূর্বক সব বিদেশী সাংবাদিকদের বের করে দেয়া হলেও এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিনিধি ড্যান কগিনস ভারত সীমান্ত পার হয়ে কুষ্টিয়ায় পৌঁছান।

২৬শে মার্চ সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা কিভাবে প্রতিরোধ যু্দ্ধ শুরু করে তার বর্ণনা দিয়েছেন মি: কগিনস। ১৯শে এপ্রিল টাইম সাময়িকীতে সেটি প্রকাশিত হয় ...

“সান্ধ্য আইনের পুরো ৪৮ ঘন্টাই কুষ্টিয়া শহরটি নীরব ছিল।কারফিউয়ের সময় রাস্তায় বের হবার অপরাধে পাক সৈন্যদের গুলিতে নিহত হয় সাতজন। এদের অধিকাংশই কৃষক।ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতো না তারা। ২৮শে মার্চ সকালে কারফিউ তুলে নেয়া হয়। সাথে সাথেই প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সংঘবদ্ধ হতে থাকে এলাকাবাসী"।


এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বিবিসি’র মার্ক টালি বাংলাদেশে এসেছিলেন।তিনি তখন দু’সপ্তাহ এখানে ছিলেন।সেই প্রথম এবং শেষ বারের মতো পাকিস্তানী সরকার দু’জন সাংবাদিককে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দিয়েছিল।

মার্ক টালি বলছিলেন ১৯৭১ সালের সেই সফরে তিনি ঢাকা থেকে সড়ক পথে রাজশাহী গিয়েছিলেন।

“পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যখন সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত পৌঁছালো এবং তারা মনে করলো যে পরিস্থিতির উপর তাদের নিয়ন্ত্রন আছে, তখনই তারা আমাদের আসার অনুমতি দিয়েছিল। আমার সাথে তখন ছিলেন ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকার যুদ্ধ বিষয়ক সংবাদদাতা ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ। আমরা যেহেতু স্বাধীনভাবে ঘুরে বেরিয়ে পরিস্থিতি দেখার সুযোগ পেয়েছি সেজন্য আমাদের সংবাদের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ হয়েছে। আমি ঢাকা থেকে রাজশাহী যাবার পথে সড়কের দু’পাশে দেখেছিলাম যে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে"।

মার্ক টালির আগে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানী সরকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সে দেশের আটজন সাংবাদিককে পূর্ব বাংলায় নিয়ে আসে।

উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব বাংলায় যে তাদের ভাষায় সব কিছুই স্বাভাবিক সেটি তুলে ধরা।এদের মধ্যে সাতজন সাংবাদিক পাকিস্তানী সরকারের চাহিদা অনুযায়ী রিপোর্ট করেন।


কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম ঘটে করাচির মর্নিং নিউজের সাংবাদিক এবং ব্রিটেনের সানডে টাইমস পত্রিকার পাকিস্তান সংবাদদাতা এন্থনি মাসকারেনহাস-এর ক্ষেত্রে।

তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে পাকিস্তান ছেড়ে ১৮ই মে লন্ডনে সানডে টাইমসের দপ্তরে হাজির হয়ে জানান যে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি একটি প্রতিবেদন লিখতে চান।

কিন্তু এ প্রতিবেদন লিখলে তার পক্ষে পাকিস্তানে থাকা সম্ভব হবেনা বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে তার স্ত্রী এবং সন্তানদের বের করে না আনা পর্যন্ত এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা যাবেনা।

সেই প্রতিবেদনে মি: মাসকারেনহাস উল্লেখ করেন "পূর্ব বাংলার শ্যামল প্রান্তর জুড়ে আমি আমার প্রথম চাহনিতেই জমাট রক্তপুঞ্জের দাগ দেখতে পেয়েছিলাম। এই সংঘবদ্ধ নীপিড়নের শিকার কেবলমাত্র হিন্দুরাই নয়। বরং হাজার হাজার বাঙালী মুসলমানও এ নির্মমতার শিকার”।

১৯৭১ সালের এপ্রিল-মে মাসের পর যুদ্ধক্ষেত্র আর কোন সরেজমিন প্রতিবেদন হয়নি।

এরপর মূলত কূটনৈতিক তৎপরতা, শরণার্থী ক্যাম্পের অবস্থা, বিশ্লেষণ এবং সম্পাদকীয়ই ছিল মুখ্য।

যুদ্ধ চলাকালীন কলকাতা থেকে বেশ কয়েকটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো যাতে বাংলাদেশের যুদ্ধের খবরা-খবরই ছিল মুখ্য।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক এবং সাংবাদিক আফসান চৌধুরী বলছেন সাংবাদিকতার স্বাভাবিক নিয়মে যেভাবে খবর যাচাই-বাছাই করতে হয়, তখন সে পরিস্থিতি ছিলনা।

তিনি বলেন ১৯৭১ সালে গণমাধ্যম দৃশ্যত দুটো ভাগে ভাগ হয়েছিল।

একটি অংশ পাকিস্তানের পক্ষে। অন্যটি পাকিস্তানের বিপক্ষে অর্থাৎ নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে।

যুদ্ধের সময় তখন বিবিসি নিয়মিত অবরুদ্ধ বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে খবর এবং বিশ্লেষণ দিয়েছে।সে সময়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে বিবিসি’র মার্ক টালির নাম লোকমুখে।

যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কিভাবে খবর সংগ্রহ করতেন?

মার্ক টালি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন “যুদ্ধকালীন অধিকাংশ সময় আমি লন্ডনেই অবস্থান করেছি। তখন সেখানে বসে যুদ্ধের নানাদিক নিয়ে বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য লিখেছি এবং প্রচার করেছি। যেসব খবরাখববের উপর ভিত্তি করে এসব লিখতাম তার বেশিরভাগই আসতো কলকাতা থেকে"।

"যখন শরণার্থী সংকট শুরু হলো তখন তাদের কাছ থেকে নানা ধরনের খবরাখবর পাওয়া যেত। নিজামউদ্দিন নামের আমাদের বেশ ভালো একজন সংবাদদাতা ছিলেন। তিনি দেশের ভেতরেই অবস্থান করছিলেন। তিনিও খবরা-খবর পাঠাতেন। যুদ্ধের শেষের দিকে তাকে হত্যা করা হয়"।

"এছাড়া আমাকে অনেক সহায়তা করেছিল লন্ডনে অবস্থিত বিবিসি বাংলা বিভাগের সহকর্মীরা। তাদের অনেকেরই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব দেশে থাকতো। তাদের সাথে বাংলা বিভাগের সহকর্মীরা যোগাযোগের চেষ্টা করতেন বিভিন্ন উপায়ে। সেসব তথ্য আমার কাজে লাগতো"।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী বলছেন যুদ্ধের সময় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের গণমাধ্যমে কিংবা অবরুদ্ধ ঢাকায় সংবাদপত্র পাঠ করে, রেডিও শুনে কিংবা টিভি দেখে পরিস্থিতি আঁচ করার কোন উপায় ছিলনা।

কারণ ছিল পাকিস্তানী সরকারের কঠোর বিধি-নিষেধ। কিন্তু তাতে সাধারন মানুষের জণ্য খবর থেমে থাকেনি বলে উল্লেখ করেন আফসান চৌধুরী।

সাংবাদিক এবং গবেষকরা বলছেন যুদ্ধ শুরু হবার কিছু দিনের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে ধীরে-ধীরে যে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে উঠেছিল তার কারণ হচ্ছে বিদেশী পত্র-পত্রিকার খবর।

পাকিস্তানী শাসকরা নৃশংসতা এবং যুদ্ধের খবর চেপে রাখার জোর চেষ্টা করলেও সেটি সফল হয়নি। বিভিন্ন ফাঁক গলে খবর ঠিকই বেরিয়েছে। বিবিসি বাংলা ।


(ওএস/এস/মার্চ২৫,২০১৬)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test