E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

হোটেল-ক্লাবে বন্দি হচ্ছে পহেলা বৈশাখ

২০১৬ এপ্রিল ০৫ ১৬:০৪:৫২
হোটেল-ক্লাবে বন্দি হচ্ছে পহেলা বৈশাখ

আয়েশা আকতার রুবী : কথায় ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ হলেও দিন দিন আমাদের মধ্যে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি খাবার-দাবারেও ভিন্ন সংস্কৃতির ছোঁয়া লাগছে। বিকৃতির ছোঁয়া লাগছে আমাদের চিন্তনেও।

অতি অনুকরণে আমরা হয়ে উঠছি পরনির্ভরশীল। হারাচ্ছি স্বনির্ভরতা। আর তাতে করে আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য-সংস্কৃতির অনুশীলন শুধু বাহ্যিকভাবেই ব্যাহত হচ্ছে না, হচ্ছে অন্তর্নিহিত বিচারেও। আসছে পহেলা বৈশাখ। মাত্র ক’দিন বাদেই দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে অন্তত একবারের জন্য হলেও ভিন্ন রঙে ভিন্ন ঢঙে মেতে উঠবে পুরো স্বদেশবাসী। দিনের শুরু হবে পান্তা-ইলিশে। যাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা নেই তারাও সেদ্ধ-ভর্তা খেয়ে পারিবারিক উল্লাসে দিনটি উদযাপন করবে।

কিন্তু এবছর নববর্ষকে ঘিরে সরকারের দেয়া নির্দেশনা দিনটির প্রকৃত মাহাত্মকেই সংকীর্ণ করবে বলে চিন্তকদের ধারণা। সাধারণত বর্তমান প্রজন্ম নানা বিদেশি খাবারের ভিড়ে স্বদেশের ভাজা ইলিশের স্বাদ ভুলে গেছে। অনেক ছেলে-মেয়েরাই আছে যাদের পান্তা ভাতের সাথে কোনো পরিচয়ই নেই। কিন্তু সে দায় কার? নিশ্চয় রাষ্ট্রের সামগ্রিক ব্যবস্থার।

যেখানে জাতিতে প্রজন্মকে আপন ঐতিহ্যে অনুপ্রাণিত করার কথা সেখানে সরকারি নির্দেশনায় হোটেল কিংবা ক্লাবে পহেলা বৈশাখ পালন করা নিশ্চিতভাবেই অপ্রত্যাশিত। আমদের এ প্রজন্মের পান্তা-ইলিশের সাথে খানিক পরিচয় থাকলেও বহু বাঙালিয়ানা খাবারের সাথে তাদের কোনো যোগসূত্রই নেই। তারা ভুলে যাচ্ছে বাঙালির সমৃদ্ধ অতীত ঐতিহ্যের বড় অংশকে। বরং উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বলা ভালো- প্রজন্মকে দেশীয় ঐতিহ্য-সংস্কৃতি চর্চার পথ থেকে দূরে রাখতেও এক ধরনের পরোক্ষ অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে।

নববর্ষ হচ্ছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নতুন বছরকে আপন সংস্কৃতির অনুশীলনে বরণ করে নেয়ার একটি দিন। এদিনে পান্তা-ইলিশ খেয়ে বাঙালি জাতি তার গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে স্মরণ করে। স্মরণ করে তার আত্মপরিচয়কে। বাঙালির জাতীয় জীবনের অংশ এই বাংলা নববর্ষ। কিন্তু এদিনটিকে যতটা সার্বজনীনতায়, ব্যাপকতায় হৃদ্য করার কথা কোথাও কোথাও তার উল্টোটাই চোখে পড়ে। রবীন্দ্রসংগীতের পরিবর্তে কানে বাজে বিদেশী গানের মিউজিক। তাতেই আমাদের ছেলে-মেয়েরা নিজেদের খুব অ্যাডভান্স বলে মনে করে। মনে করে তারা খুব স্মার্ট। কিন্তু ৪’শ বছর আগেই কবি আব্দুল হাকিম তার ‘বঙ্গবাণী’তে বলেছিলেন- “যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি”।

কবির সেই বিখ্যাত পঙতিগুলো আবেদন আজো সমানভাবে গুরুত্ববহ। আমরা পহেলা বৈশাখের দিন মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ব্যান্ড মিউজিক শুনে উল্টো-পাল্টা নাচে মেতে উঠবো, আর নিজেদের কালচারড ভেবে নির্বোধের মতো আত্মঅহমিকায় উল্লসিত হবো তা মোটেই উচিৎ মনের পরিচয় নয়। এখানেই শেষ নয়- এরকম বহু বিকৃত মানসিকতায় আক্রান্ত আমরা।

অবশ্য এসব প্রেক্ষাপট তৈরির পেছনে প্রজন্মকে পুরোপুরি দোষারোপ করা যায় না। বরং আমাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাকেই অধিকতর দায়ী করা যায়। নববর্ষ যেখানে মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে উড়ার উল্লাস নিয়ে উদযাপিত হওয়ার কথা, সেখানে উল্টো দিনটিকে সীমাবদ্ধতা-সংকীর্ণতায় ঢেকে দেয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে- আসছে বাংলা নববর্ষে দেশের অভিজাত হোটেল ও ক্লাবগুলোতে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবার আয়োজনের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে দেশের সকল জেলা পর্যায়ের অভিজাত হোটেল-ক্লাবগুলোর প্রতিও নাকি একই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যদি তাই হয়- তবে বনের পাখিকে খাঁচায় বন্দি করে দেশীয় সংস্কৃতি চর্চায় সরকার কতোটা সফল হবে তা দেখার বিষয়।

রবিবার বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শামীম আহম্মেদ স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, উপর্যুক্ত বিষয় ও আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার কার্য বিবরণীর আলোকে অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, গত ১৪১৭ বঙ্গাব্দ হতে ‘বাংলা নববর্ষ’ জাতীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলা নববর্ষ-১৪২৩ জাতীয়ভাবে উদযাপনের লক্ষ্যে অভিজাত হোটেল ও ক্লাবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা ও ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবার আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। এ অবস্থায় বাংলা নববর্ষ ১৪২৩ উদযাপন উপলক্ষে সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শামীম আহম্মেদ বাংলামেইলকে বলেন, ‘বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশের অভিজাত হোটেল এবং ক্লাবগুলোতে বাঙালি খাবার পরিবেশন এবং বিশেষ অনুষ্ঠানমালা আয়োজনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে থ্রি থেকে ফাইভ স্টার হোটেলগুলোতে এ বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে সোনারগাঁও হোটেলে যারা এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে কিংবা এবারও করবে, তাদেরকে আগাম বিষয়টি জানানো হয়েছে।’

এ বছরই সরকারিভাবে এ নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে জানিয়ে শামীম আহম্মেদ আরো বলেন, ‘জেলা পর্যায়েও অভিজাত হোটেলে ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবার আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রত্যেক জেলার জেলা প্রশাসকদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’ কেন এই আয়োজনের নিদের্শনা- জানতে চাইলে তিনি জানান, এটা সরকারি সিদ্ধান্ত।

এদিকে গত কয়েকবছর ধরে বেশ জাকজমকপূর্ণভাবে দিনটি পালন হয়ে আসলেও ক্রমেই নববর্ষকে ঘিরে আমাদের মনোজগতে বিকৃতি তৈরি হচ্ছে। তার উপর এ বছর থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে সার্বজনীন উৎসব ভাতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যা ইতোমধ্যে অনেক ক্ষেত্রে কার্যকরও হয়েছে। সরকারি নির্দেশনায় বাংলা নববর্ষ ভবিষ্যতে আরও সুন্দরভাবে পালিত হলেও তাতে বাঙালিয়ানার পরশ পশ্চাতে পড়তে পারে বলে মনে করছেন দেশের সংস্কৃতিবান ও সুশীল সমাজ।

চিন্তকদের ধারণা একেবারে মিথ্যে নয়- যেখানে মাটির সানকিতে পান্তা আর ইলিশের সাথে শুকনো মরিচ মেখে নববর্ষের সকাল শুরু হওয়ার কথা সেখানে নববর্ষকে জাতীয়ভাবে পালনের কথা বলে সত্যিকার অর্থেই কি তাকে খর্ব করা হচ্ছে না? বাংলার মুক্ত প্রান্তর থেকে কি নববর্ষকে ঝাড়বাতির কৃতিমতায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পিত অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে না? যদি তাই হয়ে থাকে তবে সময় থাকতেই পিছু ফিরতে হবে। ঘাড় ঘুরিয়ে অন্তত একবার হলেও দেখে নিতে হবে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত জাতির অতীত ঐতিহ্যকে।

কেননা, আপন ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে গুরুত্ব না দিয়ে বিশ্ব সংস্কৃতির সাথে কোনোভাবেই মিলিত হওয়া যায় না। ফলে আপন ঐতিহ্যের অনুশীলনের মধ্য দিয়েই ভিন্ন সংস্কৃতিকে বিচার করা যায়, তার মর্মমূলে পৌঁছানো যায়। তাতে একদিকে যেমন নিজস্ব সংস্কৃতির বলয় বৃদ্ধি পায়, জাতীয় চেতনা সুদৃঢ় হয়,অপরদিকে বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি তৈরি হয় না বিকৃত মনোভাব।

(ওএস/এএস/এপ্রিল ০৫, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test