E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সঙ্গীতের শক্তি

২০১৬ জুন ২১ ১২:১৩:১৪
সঙ্গীতের শক্তি

অণিমা মুক্তি গমেজ : পৃথিবীর প্রায় সব দেশে আজ উদযাপিত হচ্ছে 'বিশ্ব সঙ্গীত দিবস'। সঙ্গীত মহাসমুদ্র অমৃত রসে পূর্ণ। যে এই সুধা পান করে, সে ধন্য হয়। তাই সমুদ্রে যারা ভাসতে পারে, যারা এ সুধা পান করতে পারে এবং সেই সুধা ছড়িয়ে দিতে পারে জনে জনে; তারা সৃষ্টিকর্তার চমৎকার সৃষ্টি অথবা সৃষ্টির চমৎকার জীব। আমার কাছে সঙ্গীতের অর্থ হচ্ছে 'ভালোবাসা'। ভালোবাসতে না পারলে সে ধরা দেয় না। আর সঙ্গীত যখন ভালোবাসে, তা কেবল অনুভব করা যায়; ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

সভ্যতার শিকার যুগ থেকে যদি দেখি, তবে মানুষ দলবদ্ধভাবে শিকার করে আনন্দে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করত এবং ভাষা ছিল না বলে এক প্রকার শব্দ করত শিকার পাওয়ার আনন্দে। এই অঙ্গভঙ্গিই নৃত্য ও খুশির আর্তচিৎকার সঙ্গীত।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলি, মাঠের চাষি খররৌদ্রে মাঠে ধান রোপণ করে, শস্যের যত্ন নেয় এবং ধান কাটে। চাষির কণ্ঠে তখন সুর খেলে যায়। তীব্র তাপদাহকে অগ্রাহ্য করতে শেখায় এই সুর। এই তো সঙ্গীতের চমৎকারিত্ব! রাখাল সারাদিন গরু চরায় বাঁশির সুরে। গাছি গাছ কাটে_ সুরের শক্তিতে রক্তে সঞ্চয় করে বাড়তি শক্তি। ভরদুপুরে মাঝি বৈঠা হাতে খাঁ-খাঁ রৌদ্রে মনের সুখে গাইছে ভাটিয়ালি। গাড়ি চড়িয়ে মইষাল গায় ভাওয়াইয়া গান। রোদ নেই, বৃষ্টি নেই, সঙ্গীত এদের ভুলিয়ে রাখে জীবনযুদ্ধের যাবতীয় কষ্ট। বাউলরা ঘুরে ঘুরে সুরে সুরে সৃষ্টিকর্তার অন্বেষণ করে, বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী শোনায় প্রেমের সঙ্গীত। ১৯৯৮ সালে জার্মান গিয়েছিলাম 'বাংলা সুর' সঙ্গীত দলের হয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে। এক বিকেলে আমাদের নেওয়া হলো 'নেশাগ্রস্তদের নিরাময় কেন্দ্রে'। কানে ভেসে এলো পিয়ানোর মিষ্টি শব্দ। এই নিরাময় কেন্দ্রে কোনো ওষুধের ব্যবহার নেই। ওষুধ বলতে 'সঙ্গীত', 'সুর' আর 'ছন্দ'। মিউজিক থেরাপি বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই।

লোকসঙ্গীতের স্বনামধন্য একজন শিল্পী ছিলেন হাফিজুর রহমান। একদিন তার বাসায় গেলাম গান তুলতে। তিনি আমাদের ভাবনার উন্মোচন করে দেখিয়েছেন সঙ্গীতের 'চমৎকারিত্ব'। প্রতিটি অনুষ্ঠানে আমি এই চমৎকারিত্ব অবলোকন করি হৃদয় দিয়ে। বিষয়টি এ রকম_ একটি মঞ্চে যখন সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়, তখন কেউ আসে শিল্পীকে কাছ থেকে দেখতে, কেউ আসে সঙ্গীতকে সরাসরি উপভোগ করতে।

এমন দর্শক-শ্রোতার মাঝে উপস্থিত থাকতে পারেন রাষ্ট্রের সম্মানীয় ব্যক্তি থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত। যতক্ষণ সঙ্গীতের সুর চলতে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত কারও মনে কোনো খারাপ পরিকল্পনার চিন্তা থাকে না। অর্থাৎ তখন পর্যন্ত সবাই শুদ্ধ মানুষ। সঙ্গীত সুধা পান করতে এসে কেউ খুনি হতে পারে না। সুরের ইন্দ্রজালে ভেসে ভেসে কখনও মন্দ চিন্তা করতে পারে না। সঙ্গীত অর্থ প্রেম, আর প্রেম অর্থ শক্তি। এই শক্তি সব অপশক্তিকে পরাজিত করে শান্তিধারা বইয়ে দিতে পারে। সঙ্গীতের শক্তির প্রমাণ পাওয়া গেছে ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান কিংবা যেসব শিল্পী ট্রাকে চড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গাইতেন দেশপ্রেমের গান, তাদেরকে আমরা স্মরণে রাখব চিরকাল। জাতিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে দেশের গানের শক্তি তা সঙ্গীতের চমৎকারিত্ব বৈকি। সঙ্গীতই পারে জাতিকে আবার ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে।

বিশ্ব সঙ্গীত দিবসে বিশ্বের সব শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। যেসব গীতিকারের বাণীতে সুর দিয়ে সঙ্গীত বানানো হয়, সেই গীতিকার ও সুরকারদের প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা। যারা সঙ্গীতের একজন সাধারণ মানুষকে শিল্পী করে তোলেন, সেসব দর্শকের জন্য সারা জীবনের অকৃত্রিম ভালোবাসা জানাই। জয় হোক সত্যের, জয় হোক সঙ্গীতের।

লেখক : লোকসঙ্গীত শিল্পী, প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ লোকসঙ্গীত পরিষদ, ঢাকা

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test