E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

গাইবান্ধায় ভালোবাসায় বসবাস মানুষ ও হাজারো পাখির

২০১৬ সেপ্টেম্বর ১৯ ১৮:৫১:০৮
গাইবান্ধায় ভালোবাসায় বসবাস মানুষ ও হাজারো পাখির

গাইবান্ধা প্রতিনিধি : বন-বাঁদাড় আর বাঁশের ঝাড় উজাড় হয়ে যাওয়ায় গাইবান্ধায় পাখির অভয়াশ্রমগুলো আর নেই। অনেক প্রজাতির পাখি এখন আর চোখে পড়ে না। আবাদি জমি আর নতুন নতুন বসতবাড়ি গড়ে ওঠায় ঝোপ-জঙ্গল সব নিঃশেষ হচ্ছে। নদী-নালা, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় খাদ্য সংকটের কারণে অন্যত্র চলে যাচ্ছে পাখি।

এর মধ্যেই জেলার দুটি গ্রামে মানুষের ভালোবাসায় গড়ে উঠেছে পাখির অভয়াশ্রম। পাখিরা মিতালি করেছে বাড়ির বাসিন্দা আর স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে। ডাকলে কাছে আসে এসব বুনো পাখি। গায়ে বসে। হাত থেকে খাবার তুলে নেয়। পাখির বিষ্ঠায় ‘যন্ত্রণা’ হার মানছে ভালোবাসার কাছে।

এমনই একটি অভয়াশ্রম রয়েছে ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের মদনেরপাড়ায়। আরেকটি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামে।

ফুলছড়ির মদনেরপাড়া গ্রামের অল্প কিছু দূরে ঘাঘট নদী। আরও কিছুটা দূরে ব্রহ্মপুত্র। এ দুই নদীকে কেন্দ্র করে গ্রামটিতে গড়ে উঠেছে পাখির অভয়াশ্রম।

গ্রামের সোলায়মান আলী (৪৫) ও তার ভাই মন্টু মিয়ার বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড় জুড়ে কয়েক হাজার পাখির বাস। বাঁশঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে বাসা বেঁধেছে এসব পাখি। বিদেশি সাদা বড় বক, কানি বক, পানকৌড়ি, রাতকানা ইত্যাদি নানা ধরনের পাখির বাস সেখানে। গোটা বাড়ি ভরে আছে পাখির বিষ্ঠায়। দুর্গন্ধে বাড়িতে ঢোকা দায়। কিন্তু বাড়ির মালিকদের এ নিয়ে কোনো মাথা নেই। দুর্গন্ধ নাকি সয়ে গেছে তাদের। বরং বাইরে কোথাও গেলে ওই গন্ধই তাদের টানে, তাদের তখন ভালো লাগে না।

এমন কথাই বললেন সোলায়মান আলীর স্ত্রী রোজিনা বেগম, যিনি মাঝেমধ্যে পাখিদের খাবার দেন। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি তখন ভিড় জমায় উঠানে তার চারপাশে।

রোজিনা বেগমের মেয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্রী সুমাইয়া খাতুন জানায়, সকালবেলা তারা ঘুম থেকে উঠে দেখে উঠানে অনেক মাছ পড়ে থাকে। খাবার জন্য পাখিরা এসব মাছ খাল-বিল-নদী থেকে ধরে নিয়ে আসে। তাদের মুখ থেকে হয়তো এসব পড়ে যায়। সেগুলো আর তুলে নেয় না পাখিরা। বাড়ির লোকজন এসব মাছ কেটেকুটে পাখির খাদ্য বানিয়ে সেগুলো ওদের খেতে দেয়। এভাবেই পাখিগুলোর সঙ্গে পরিবারের লোকজনে গড়ে উঠেছে মিতালি। অপর বাড়ির মালিক মন্টু মিয়া বলেন, ‘আমরা কাউকে পাখি মারতে দিই না। ওরা আমাদের সন্তানের মতোই থাকে এখানে। ওদের কিচিরমিচির শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙে। ওদের ডানা ঝাঁপটানির শব্দে পালায় আপদ-বিপদ।

সকালে পাখিগুলো বাঁশঝাড় থেকে বেরিয়ে যায় খাদ্যের সন্ধানে। আবার সন্ধ্যার আগে আগে পশ্চিম আকাশে যখন সূর্য ডুবু ডুবু, তখন ফিরে আসে নীড়ে। আর যাদের ছানা আছে, তারা পালাক্রমে খাবার আনতে যায়। বাচ্চা পাহারা দেয় হয় বাবা, নয় মা। এমনি করে একানে পাখির বংশ বেড়ে চলেছে।

বাড়ির গৃহিণী রোজিনা বেগম বলেন, ‘প্রায় এক যুগ ধরে এসব বুনো পাখির সঙ্গে আমাদের বাস। এখন আর ওরা বুনো নেই। আমাদের কথা শোনে। ওদের ডাকলে কাছে আসে। হাত থেকে খাবার তুলে খায়। গায়ে এসে বসে। পাখির নরম ডানায় হাত বোলাতে খুব ভালো লাগে। নিজেদের আদরের ধন মনে হয় তখন।’

প্রতিবেশী নার্সারি মালিক সাইদুর রহমান বলেন, ‘রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কখনো কখনো পাখির বিষ্ঠা এসে গায়ে পড়ে। কাপড় নষ্ট হয়ে যায়। কাপড়টা তখন পাল্টে নেই। কিন্তু পাখির কোনো ক্ষতি করি না। চিড়িয়াখানায় মানুষ পাখি দেখতে যায়, সেই পাখি এখন আমাদের দোয়ারে। বাইরে থেকে মানুষ এই পাখি দেখতে আসে এখানে। এটা আমাদের গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ অন্যদিকে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে গড়ে ওঠা অভয়াশ্রমে দু-তিন হাজার বকসহ বিভিন্ন পাখির বাস।
স্থানীয় বাসিন্দাদের নিবিড় ভালোবাসায় সেখানে বাসা বেঁধেছে ঝাঁকে ঝাঁকে বক। আর চোরা শিকারিদের হাত থেকে নিরাপদ বলে এখানে ঠাঁই নিয়েছে দূর-দূরান্ত থেকেও আসা বক প্রজাতির অনেক পাখি। নিজেদের অভয়ারণ্য গড়ে চলছে প্রজনন আর বংশবিস্তার।

কদমতলা গ্রামের ক্ষীতিশ চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘আমার ভালো লাগে দেখে, একটি বকের ছানা মানুষের ডাকে যখন সাড়া দেয়। এটা কল্পনাও করতে পারি না। আয় আয় করে ডাকলে বকের বাচ্চাটি হাতের ওপর এসে বসে। এ দৃশ্য কেউ না দেখলে বিশ্বাস করবে না।’

স্থানীয় কদমতলা গ্রামের শিক্ষক শশী মোহন বর্মণ বলেন, ‘আমি প্রায় এক বছর ধরে ওই সব পাখির বসবাস দেখে আসছি এ এলাকায়। আমাদের ওই পাখিগুলো দেখতে খুব ভালো লাগে। তারা দিনরাত কিচিরমিচির করে। পাখিগুলোর ডাকে সকালে ঘুম ভাঙে আমাদের। কদমতলা গ্রাম পাখিদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে।’

(এসআইআর/এএস/সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test