E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কেমন আছেন বৃদ্ধাশ্রমের মানুষগুলো!

২০১৬ অক্টোবর ০১ ১৫:০৬:৫০
কেমন আছেন বৃদ্ধাশ্রমের মানুষগুলো!

রাজীবুল হাসান, গাজীপুর :


সেদিন যখন গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্ণবাসন কেন্দ্রে পৌঁছাই সূর্য তখন ঠিক মাথার উপর। রৌদ্রের প্রখরতা ছিল না ততটা। আশ্রমে ঢুকতেই প্রথম দেখা হয় জামালপুর সদরের শিলকুড়িয়া গ্রামের জিয়াউদ্দিনের সাথে।

প্রতিদিন দুপুর হলেই নাকী ফটকের ঠিক ডান দিকের বেঞ্চটাতে বসে থাকেন তিনি। শুধু আজ কিংবা কাল নয় বারো বছর যাবৎ এবাবেই কাটাছেন তার নিদারুন সময়গুলো। নীরব স্বভাবের এই মানুষটার কাছে জানতে চাইলাম কেমন আছেন? বিধ্বস্ত পাখি যেভাবে ডানা গুটিয়ে বসে থাকে সেভাবে একেবারে জড়ো সড়ো হয়ে বসেছিলেন তিনি। আমি ভেবেছিলাম উনি হয়তো আমার কথা শুনতেই পাননি। দু’মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর বললেন, আপনারা কারা? সংবাদকর্মীর কথা শুনেই চুপ হয়ে গেলেন। কিছক্ষণ পর বললেন, আপনারা কেন বারবার পুরান কাসুন্দি ঘায়টা আমার কষ্ট বাড়াইতে আসেন।

জিজ্ঞেস করলাম চাচা আপনার বাড়িতে কে কে আছেন? বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, আমার কেউ না গো বাবা। যমুনার জলে সব ভাসাইয়া দিয়া আইছি। আমি মরলে কেউ যেন আমার লাশটাও নিতে না আসে। বেশিদিন আর বাঁচবো না। ওরা যেন ভালো থাকে। চোখের পাতা মুছতে মুছতে অভিমানী জিয়াউদ্দিন বলছিলেন কথাগুলো। চাপা স্বভাবের জিয়াউদ্দিনের বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসই যেন বলে দিল তার সমস্ত কষ্ট বেদনা আর অভিমানের কথা। ২০০৪ সালের শুরুর দিকে কোন এক মধ্যদুপুরে জামালপুর থেকে জিয়াউদ্দিন ছেলে মেয়েদের সাথে অভিমান করে গাজীপুরের মনিপুরে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে চলে আসেন। সেই থেকে মধ্যদুপুর হলেই বসে থাকেন ফটকের সামনে। হয়তো যদি কেউ খুঁজতে এসে না পায়! এখানে কী ভাবে আসছেন ? ছেলে মেয়ে কয়জন? তারা কী করে? এই সকল প্রশ্ন জিয়াউদ্দিন বারবারই গোপন করছিলেন। শুধু বললেন ‘যমুনার জলে সব ভাসাইয়া দিয়া আইছি।’

কিছুদূর হাঁটতেই দেখা হয় ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ছাপোনাহালা গ্রামের ৭৫ বছর বয়সী মোতালেব হোসেনের সাথে। পেশায় ছিলেন স্কুল শিক্ষক। দুঃখ-কষ্টে চলতো সংসার। ছেলেদের মানুষ করতে বহু কষ্ট করতে হয়েছে তার। দুই ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। বড় ছেলে আবিদ হোসেন ঢাকায় একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন আর ছোট ছেলে বুলবুল হোসেন নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় উচ্চপদে। দশ গ্রাম জানিয়ে দুই ছেলেকে এক সাথে বিয়েও করিয়েছিলেন তিনি। সোনার সংসারে আসে নাতি-নাতনি। ভালোই চলছিল সংসার। কিন্তু ছেলেদের বিয়ের পর থেকেই দেখা দেয় যত জটিলতা। ছেলেদের বিয়ের দু’বছরের মাথায় স্ব-স্ত্রী মারা যায়। স্ত্রী যেন কষ্টের ঝাল বুনে গেল। মোতালেবের সেবাযত্ন করতে নারাজ ছেলের বউরা। পান থেকে চুন খসলেই পুত্রবধূরা গালি গালাজ করে। কিছু চাইলে মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। আবার ছেলেরা বাড়িতে এলে সব ঠিক ঠাক। এক সময় বিষয়টি ছেলেদের নজড়ে পড়ে। বউদের প্ররোচনায় আর ছেলেদের শলাপরামর্শে অবশেষে হাসপাতালের কথা বলে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যান তাকে। দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে গেল। কেউ আর খবর নেয় না।

তিনি বলেন, ‘ছেলে আর নাতি-নাতনিদের সঙ্গে আর হয়তো দেখা হবে না। কী দুর্ভাগা আমি! ছোটবেলা ছেলেরা যা বায়না করত আমি তাই এনে দিতাম। এখনতো আমার যাবার সময় হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম শেষ জীবনে ওরা আমার পাশে থাকবে। তা আর হলো না। এ সময় তার চোখের পানি পড়তে থাকে। তিনি বলেন, ‘সারাদিন চেয়ে থাকি কখন আমার ছেলেরা আসবে। কিন্তু দিন শেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেও আমার সন্তানরা আসে না।’ এত দুঃখ তবু তার প্রকৃত নাম গোপন রাখার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আসল নাম প্রকাশ হলে ছেলেরা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হবে। সন্তানদের দেওয়া আঘাত কিংবা অন্য কোন চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে এ রকম প্রায় আড়াই শতাধিক নারী পুরুষের একমাত্র ভরসা এখন গাজীপুর সদর উপজেলার ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের বিশিয়া কুড়িবাড়ী বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে।

আশাভঙ্গের যন্ত্রণা আর হারানো দিনের সুখস্মৃতি বয়ে বেড়ানোই এখন তাদের একমাত্র অবলম্বন। আশ্রমের প্রতিটি মানুষ যেন সন্তানদের উদ্দেশে মনে মনে বলছে বাবা, আমি বৃদ্ধাশ্রম থেকে বলছি...তুই কেমন আছিস?

পুনর্বাসন কেন্দ্রের ম্যানেজার আবু শরীফ বলেন, আশ্রমের ভেতরে আমাদের বিভিন্ন ফল মূল শাক সবজি চাষ করা হয়। এ সব কিছুই প্রবীণদের জন্য। অসুস্থদের আলাদা থাকা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। সকল প্রবীনদের দেখবাল করে আশ্রম কর্তৃপক্ষ।

প্রভাতী প্রার্থনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রবীণদের দিন। এরপর তারা বের হন হাঁটতে। সকাল আটটার মধ্যে নাশতা তৈরি হয়ে যায়। এরপর প্রবীণরা কেউ লুডু খেলেন কেউ খেলেন দাবা। এরই মধ্যে দুপুর হয়ে যায়। গোসল সেরে ফের প্রার্থনায় মগ্ন হন তারা। দুপুরের খাবার সেরে নিজেরা গল্প গুজব করেন। সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ আদায় করে কেউ কেউ টিভি দেখেন। এশার নামাজ শেষে কেউ মগ্ন থাকেন টিভির পর্দায় কেউ আবার বিশ্রামে চলে যান ।

এখানে রয়েছে মেডিকেল ক্যাম্প, নারী পুরুষের আলাদা ইউনিট, রান্নাঘর, ফুল ফলের বাগান, রয়েছে পুকুর। পুকুরের সামনে মসজিদ, অজুখানা, কবরস্থান। ১’শ বিঘার এই বৃদ্ধাশ্রমের পুরো আঙিনা জুড়ে রয়েছে বসার বেঞ্চ। ইট বিছানো রাস্তা, অন্ধকার দূর করতে দেওয়া হয়েছে লাইট।

পাবনার শ্রীপুর গ্রামের খতিব আবদুল হামিদের শিশুপুত্র খতিব আবদুল জাহিদ মুকুল একদিন বাড়ির পাশে দেখলেন এক বৃদ্ধা বাচ্চা কোলে নিয়ে কাঁদছেন। বৃদ্ধা বললেন, তার সন্তানেরা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।

এ দৃশ্য দেখে মুকুলের হৃদয় নাড়া দেয়। অবহেলিত মানুষদের জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছে জাগে তখনই। সিদ্ধান্ত নেন যাদের পৃথিবীতে সন্তান থাকার পরও না থাকার অবস্থা হয়, তাদের সন্তান হয়ে আশ্রয় দেবেন তিনি। এই বাসনা লালন করেই ১৯৮৭ সালে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে আশ্রিতরা বিনা খরচে থাকেন।

(আরএইচ/এএস/অক্টোবর ০১, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

০৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test