E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শেরপুরে দারিদ্র জয়ের সংগ্রামে আশার আলো দেখছেন গ্রামীণ নারীরা

২০১৬ অক্টোবর ২৩ ১৪:১৬:১৮
শেরপুরে দারিদ্র জয়ের সংগ্রামে আশার আলো দেখছেন গ্রামীণ নারীরা

শেরপুর প্রতিনিধি :দরিদ্র পিতার ঘরে জন্মগ্রহন করায় দুঃখ-কষ্টকে সঙ্গী করে বড় হতে থাকেন সমলা বেগম (৪৭)। বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই বসতে হয় বিয়ের পিড়িতে। অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে দিনমজুর স্বামীর সাথে সংসার শুরু করেন। দাম্পত্য জীবনের কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের ঘরে আসে এক মেয়ে এবং দু’টি ছেলে সন্তান। এই পাঁচজনের সংসারের জীবনে অভাব আরও প্রকট আকার ধারন করে। এর মাঝেই স্বামী হায়দার আলী অসুস্থ্য হয়ে পড়লে চোখে তিনি সর্ষে ফুল দেখতে থাকেন। পরের বাড়ীতে কাজ করে কোনমতে সংসারের ঘানি টানছিলেন। এর মাঝেই একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার অতিদরিদ্র কর্মসূচীর গ্রাম নির্বাচনকালে খুলে যায় সমলার ভাগ্যের চাকা।

২০১৫ সালের প্রথমদিকে অতিদরিদ্র তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত হলে গরু মোটাতাজাকরণ ও হাসঁ-মুরগী, পশু পালনের ওপর চারদিনে প্রশিক্ষণ পান। প্রশিক্ষণ শেষে তাকে ১২ হাজার টাকা ঋণ প্রদান করা হয়। ঋণের টাকায় একটি গরু ক্রয় করেন। এসময় সংস্থার পক্ষ থেকে সহায়ক ভাতা হিসেবে ৩৩ সপ্তাহে ২১০ টাকা করে ৬ হাজার ৯৩০ টাকা এবং গরুর খাবার বাবাদ ৬০০ টাকা এবং কৃমিনাশক ও ভিটামিন প্রদান করা হয়। গরুটি মোটাতাজাকরনের ৬ মাস পর সেই গরুটি তিনি ৩২ হাজার টাকায় বিক্রী করেন। এই শুরু, তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। গরুবিক্রী করে ঋণের টাকা পরিশোধ করার পর সংস্থার লোকজন খুশী হয়ে তাকে এবার ১৫ হাজার টাকা ঋণ দিলে আরেকটি গরু কিনে সেটি লালন-পালনের পর সাড়ে ৩৪ হাজার টাকায় বিক্রী করেন। বর্তমানে তিনি একটি গরু, ১১টি মুরগী ও একটি রিক্সার মালিক হয়েছেন। এভাবে তার সংসারে এখন স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। মেয়েটির লেখাপড়ায় ছেদ পড়লেও এক বছরের বিরতি দিয়ে এবার তাকে এইচএসসিতে ভর্তি করিয়েছেন।

সমলা বেগম বলেন, আল্লায় আমারে খুব বালা রাখছে। আল্লার কাছে হাজার শুকুর। আগে চাইয়া-মাই¹া খাইতাম, কোন সুময় খাইতাম, কোন সুময় পাইতাম না। আর অহন আল্লায় আমার দিন ফিরাইছে। ঋণের ট্যাহায় গরু পাইল্লা আমি অহন গরু-ইস্কার মালিক অইছি। অহন নিজের ইচ্ছামতো বালামুন্দ চাইড্ডা খাবার পাই। আল্লায় দিলে অহন আমার সংসারো অভাব খুব একটা টের পাইন্না।

সমলা বেগমের মতোই সদর উপজেলার লছমনপুর ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর দড়িপাড়া গ্রামের হতদরিদ্র রওশন আরা, সাজেদা বেগম, রিপা বেগম, মর্জিনা বেগম, দুলালী বেগমের জীবনের গল্পও পাল্টে গেছে। মাত্র দুই/তিন বছরের ব্যবধানে এসব মহিলারা গরু-ছাগল-ভেড়া, হাঁস-মুরগী পালন এবং গ্রামীন ক্ষুদ্র নার্সারী প্রতিষ্ঠা করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। একসময় যাদের দুইবেলা ঘরে খাবার জুটতো না, আজ তারা তিনবেলা পেটপুরে খেতে পারছেন। ছনের পরিবর্তে টিনের ঘর হয়েছে। সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসার পাশপাশি তারা এখন সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারছেন। পরিবার ও সমাজে তাদের গুরুত্ব বেড়েছে, নিজেরা তাদের মতামত তুলে ধরতে পারছেন। শেরপুর সদরের লছমনপুর ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর দড়িপাড়া গ্রামে গেলে গ্রামীণ নারীদের দারিদ্র জয়ের এমন চিত্রই দেখা যায়।

শেরপুরের জেলা প্রশাসক ডা. এ এম পারভেজ রহিম দারিদ্রজয়ী এসব অতিদরিদ্র মহিলাদের বাড়ি পরিদর্শন করে উঠান বৈঠকে মিলিত হন। এসময় জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আব্দুল মান্নান, সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. নীলাদ্রি হোড়, ইউপি চেয়ারমান মো. সেলিম মিয়া, ব্র্যাক জেলা প্রতিনিধি আতাউর রহমান ছাড়াও বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা তাদের সাথে ছিলেন। আন্তর্জাতিক দারিদ্র বিমোচন দিবস উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের শেরপুর জেলা কার্যালয় এ মাঠ পরিদর্শনের আয়োজন করে। পরিদর্শনকালে জেলা প্রশাসক ব্র্যাকের অতিদরিদ্র কর্মসূচীর উপকারভোগী বিভিন্ন সদস্যদের সাথে কথা বলেন। এসময় রওশনা আরা জানান, তিনি ব্র্যাক থেকে ৪টি ভেড়া পেয়েছিলেন। সেগুলো থেকে ৬ মাস পর পর ভেড়া বাচ্চা দিলে তিনি ১০টি ভেড়া ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। তার থেকে তিনি ১৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি বকনা বাছুর কেনেন এবং ৬ হাজার টাকায় একটি পুরাতন রিক্সা কেনেন। আর ৪ হাজার টাকা সংসারে খরচ করেন। এখন তিনি ৪টি ভেড়া, একটি বকন বাছুর আর রিক্সার মালিক। স্বামী প্রতিন্ধি হলেও তার এখন সংসার চালাতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছেনা বলে তিনি জানান। আরেক দরিদ্র গৃহবধু সাজেদা ব বেগমও ৪টি ভেড়া লালন-পালন করে ১২টি ভেড়া হলে ৮টি ভেড়া তিনি ১৮ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। ওই টাকা থেকে ১৪ হাজার টাকায় তিনি একটি গরু কেনেন এবং ৪০ হাজার টাকা দিয়ে ফেরি করে কাপড়ের ব্যবসা করছেন বলে জানান। জেলা প্রশাসক সহ অতিথিরা এসব হতদরিদ্র নারীর জীবন সংগ্রাম ও তাদের ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা শুনে ভুয়শী প্রশংসা করেন। পরে তিনি কয়েকজন গ্রামীণ নারীর মাঝে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা, ঢেউটিন ও নগদ অর্থ বিতরন করেন।

ব্র্যাক জেলা প্রতিনিধি মো. আতাউর রহমান জানান, ২০১৫ সালে ব্র্যাক শেরপুরের চার উপজেলায় ৩ হাজার ১১২ জন অতিদরিদ্র গ্রামীণ নারীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করেছে। এবছর আরো ২ হাজার ১৪৪ জন অতিদরিদ্র গ্রামীণ নারী এ কর্মসূচীর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। সভায় অতি দরিদ্রদের উন্নয়নে সরকার ও ব্র্যাকের গৃহীত নানা কার্যক্রম এবং বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়। তিনি জানান, এ অতিদরিদ্র কর্মসূচীর মাধ্যমে লক্ষিত জনগোষ্ঠিাকে আয়বর্ধক উদ্যোগে সম্পৃক্ত করা হয়। এজন্য তাদের নানা প্রশিক্ষণ প্রদান, বিনামুল্যে সম্পদ হস্তান্তর, সহায়ক ভাতা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা, এবং হোম ভিজিটের মাধ্যমে কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। সেইসাথে প্রয়োজনীয় সম্পদ ক্রয়ের জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা হয়।

জেলা প্রশাসক ডা. এ এম পারভেজ রহিম বলেন, সরকার ও এনজিও একত্রে কাজ করছে বলেই দেশ দারিদ্রমুক্ত হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও বিশেষ করে ব্র্যাক শেরপুর জেলায় অনেক ভাল কাজ করছে, দারিদ্র্য নিরসনেও ভুমিকা রাখছে। হতদরিদ্র মহিলাদের জীবন ও জীবিকা উন্ন্য়নে গ্রামীন নার্সারী, খামার, হাঁস-মুরগী পালন করার কাজে সম্পদ বিতরণসহ স্বাস্থ্য সেবা, ল্যাট্রিন বিতরণ করছে। এতে দারিদ্রতার হার আগের তুলনায় অনেক হ্রাস পেয়েছে।
প্রেরক : হাকিম বাবুল, শেরপুর জেলা প্রতিনিধি, মোবাইল-০১৭১২৪২২০৮০, তারিখ: ২৩/১০/২০১৬।







(এইচবি/এস/অক্টোবর ২৩, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test