E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মাগুরায় পাটকাঠির ছাই থেকে মিলছে বিপুল বৈদেশিকমুদ্রা 

২০১৬ নভেম্বর ২৪ ১৩:০০:৪১
মাগুরায় পাটকাঠির ছাই থেকে মিলছে বিপুল বৈদেশিকমুদ্রা 

দীপক চক্রবর্তী, মাগুরা প্রতিনিধি  : ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, মিললেও মিলতে পারে, অমূল্য রতন’- ছাইয়ের মধ্যে রতন পাওয়া নিয়ে সংশয় থাকলেও পাঠকাঠি পুড়িয়ে তৈরি করা ছাইয়ের মধ্যে নিশ্চিত রতন মিলছে।

মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার নাকোল ও মহম্মদপুর উপজেলার রুইজানি এলাকায় দুটি কারখানা থেকে পাঠকাঠির ছাই বিদেশে রপ্তানী হচ্ছে। পাটখড়ি বা পাটকাঠির ছাই চারকোল নামেও পরিচিত। ব্যতিক্রম এ পণ্যের রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

চীনসহ বিভিন্ন দেশে পাটকাঠির ছাই থেকে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, আতশবাজি ও ফেসওয়াশের উপকরণ, মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধনীপণ্য, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধ ও ক্ষেতের সার ইত্যাদি পণ্য তৈরি হচ্ছে বলে কারখানার মালিকেরা জানিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশের অন্যতম পাট উৎপাদকারী জেলা মাগুরা। কিছু দিন আগেও অনাদরে-অবহেলায় পড়ে থাকত পাটকাঠি। কৃষকের রান্নার জ্বালানি, ঘরের বেড়া পানের বরজের ছাউনি অথবা বড়জোর পার্টিকেলবোর্ড তৈরিতে ব্যবহৃত হতো পাটকাঠি। এখন ছাই তৈরির মিলে ব্যবহৃত হওয়ায় পাটকাঠির চাহিদা বেড়ে গেছে। ভালো দাম পেয়ে লাভবান হচ্ছেন কৃষক। এতে সবার আশা পাটকাঠিতেই আবার ফিরবে পাটের সোনালী ঐতিহ্য।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশের অন্যতম পাট উৎপাদনকারী জেলা মাগুরা। গত মৌসুমে জেলার চারটি উপজেলায় ৩২ হাজার ৭৭২ হেক্টরে পাট আবাদ হয়। প্রতি হেক্টরে প্রায় ১৩ বেল ( এক বেল = ৫ মণ) পাট উৎপাদন হয়। জেলায় এবার ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৬৭০ বেল পাটের উৎপাদন হয়েছে।

প্রতিহেক্টরে পাটকাঠি হয় প্রায় ২৫০ মণ। সে হিসেবে জেলায় ৮১ লাখ ৯৩ হাজার মেট্রিকটন পাটকাঠি উৎপাদন হয়েছে। জেলার নাকোলে চীনের নাগরিক ও মহম্মদপুরের রুইজানিতে দেশের দুই উদ্যোক্তা পাটকাঠির ছাই রপ্তানির জন্য দুটি কারখানা স্থাপন করার পর পাটকাঠির ব্যবহার ও চাহিদা নিয়ে বদলে গেছে পুরনো ধারনা।

সরেজমিন মহম্মদপুর উপজেলার সদরের মধুমতি নদীর তীরে স্থাপিত পাটকাঠির ছাই তৈরির কারখানায় গিয়ে জানা গেছে, ছাইয়ের প্রধান আমদানিকারক দেশ হচ্ছে চীন। চার বছর আগে পাটকাঠিকে ছাই বানিয়ে তা রপ্তানির পথ দেখান ওয়াং ফেই নামের চীনের এক নাগরিক। তাইওয়ান, ব্রাজিলেও এটি রপ্তানি হচ্ছে। এর বড় বাজার রয়েছে মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, ব্রাজিল, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে। বিদেশে পাটকাঠির ছাই থেকে মূল্যবান নানা পণ্য তৈরি হওয়ায় দিন দিন চাহিদা বাড়ছে ।

এ খাত থেকে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে ১৫০ কোটি টাকা। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও বাজার ধরতে পারলে বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা সহজেই আয় হওয়া সম্ভব।
একটি কারখানায় দৈনিক চাহিদা ৫০০ মণ পাটকাঠির চাহিদা রয়েছে। মৌসুমে প্রতি মণ পাটকাঠি কিনতে হয় ১৮০-২০০ টাকা দরে। যখন মৌসুম থাকে না, তখন দাম পড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। জুন-জুলাই দুই মাস ছাড়া সারা বছর মিল চালু থাকে। দেশে বর্ষাকাল ও চীনে এই দুই মাস গরমে কারখানা বন্ধ থাকে। একটি কারখানায় মাসে ১৫০-২০০ মেট্রিকটন ছাই উৎপাদন হয়। প্রতিটন ছাই বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫০ হাজার টাকা বিক্রি হয়। নতুন এই রপ্তানি পন্যের উৎপাদন ঘিরে জেলায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।

দেখা গেছে, বিশেষ চুল্লির মাধ্যমে পাটকাঠি পুড়িয়ে ছাই করা হচ্ছে। পোড়াানোর পর প্রযুক্তির মাধ্যমে কার্বনগুলোকেই মূলত ধরে রেখে প্যাকেট করা হচ্ছে।

এ কারখানায় বিদ্যুৎ বেশি লাগে না, কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগের পরিমাণও খুব বেশি নয়। তা ছাড়া পাট প্রধান এলাকায় কাঁচামাল পাওয়া যায় সহজেই।

সদরের জাঙ্গালিয়া গ্রামের কৃষক আকরাম আলী শেখ (৫৫) জানান, ‘পাটের সাথে পাটকাঠি বিক্রি করে আমরা বেশি লাভবান হচ্ছি।’

গোপাল নগর গ্রামের পাটকাঠি ব্যবসায়ি কবির মোল্যা (৫০) বলেন, ‘আগে পাটকাঠির তেমন চাহিদাই ছিল না। এখন প্রতিমণ বিক্রি হচ্ছে ১৮০-২০০ টাকায়।’

পূূর্বনারায়নপুর গ্রামের মাজহারুল ইসলাম (২৮) বলেন,‘বেকার ছিলাম। পাটকাঠির মিলে তারমতো অনেক যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে।’

সদরের রুইজানির পাটকাঠির ছাই তৈরির কারখানার মালিক আব্দুল মান্নান জানান, ‘ছাই ছাড়াও পাটকাঠি থেকে কয়লা বা অ্যাকটিভেটেড চারকোল উৎপাদন করতে পারলে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে। ইউরোপে ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্লান্টে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তারা এই লক্ষ্যে পৌছাতে পারলে সোনালি আঁশের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

তিনি আরও বলে, পাটখড়িরর ছাই উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে সরকার ইতিবাচক। চীনে শুল্কমুক্ত ছাই রপ্তানির সুজোগ দিলে পরিবেশবান্ধব এ শিল্প আরও এগিয়ে যাবে। এজন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।’


(ডিসি/এস/নভেম্বর ২৪, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test