E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মিষ্টির প্যাকেটে স্বপ্ন বুনছেন ভিক্টোরিয়া  

২০১৬ ডিসেম্বর ২৮ ১৭:১০:০৮
মিষ্টির প্যাকেটে স্বপ্ন বুনছেন ভিক্টোরিয়া  

লোহাগড়া (নড়াইল) প্রতিনিধি : বাবা মহব্বত বিশ্বাস ও মা নাজমা বেগমের ঘর আলো করে জন্ম নেয় এক সন্তান। ফুটফুটে সন্তানের মুখ দেখে খুশি সবাই। দাদী আলেয়া বেগম অনেক আদর করে নাম রাখেন ‘ভিক্টোরিয়া’। এরপর ‘নায়াগ্রা জলপ্রপাত’র মতো প্রাণোচ্ছল আরেক সন্তানের নাম-‘নাইগেরিয়া।’ ঐতিহাসিক এসব নামের সঙ্গে মিল রেখে ছোট সন্তানের নাম রাখা হয়-‘এলিজাবেথ’। কিন্তু জন্মের পর থেকে তেমন কোনো ‘সুখের মুখ’ দেখেনি আদরের তিন সন্তান। ভূমিহীন বাবার সংসারে ‘অভাব-অনটন’ তাদের পিছু ছাড়েনি। তবুও পড়ালেখা চালিয়ে যায় তিন সন্তান। হঠাৎ করে ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত!’

প্রায় বছর দুয়েক আগে মহব্বত বিশ্বাস ব্রেনস্টোকে আক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। এরপর শুরু হয়-বড় মেয়ে ভিক্টোরিয়ার (২৩) জীবনযুদ্ধ। ভূমিহীন বাবার সংসারে মিষ্টির প্যাকেট তৈরি করে লেখাপড়ার খরচসহ সংসার চালান ভিক্টোরিয়া আক্তার। পাশাপাশি প্রাইভেট পড়ানোসহ (গৃহশিক্ষক) শিশু-কিশোরদের গান শেখান তিনি। প্রায় দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া এলাকায় বসতবাড়িতে (টিনের ঘর) প্যাকেট তৈরির ছোট কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। বাঁশঝাড় ও অরণ্যঘেরা অন্ধকারাচ্ছন্ন এই ঘরে প্রতিদিন প্যাকেট তৈরি করেন ভিক্টোরিয়া আক্তার।

এই কাজে ভিক্টোরিয়াকে সহযোগিতা করেন তার বাবা-মাসহ দুই বোন। খুলনা থেকে উপকরণ কেনার পর বাড়িতে প্যাকেট তৈরি করেন তারা। ভিক্টোরিয়ার বাবা দিঘলিয়াসহ স্থানীয় বাজারগুলোতে ভ্যানযোগে মিষ্টির প্যাকেট সরবরাহ করেন। প্রতিদিন প্রায় দুইশত মিষ্টির প্যাকেট তৈরি করেন তারা। একটি মিষ্টির প্যাকেট তৈরিতে খরচ পাঁচ টাকা। সেক্ষেত্রে বিক্রি হয় ছয় টাকায়। এ সামান্য আয় থেকে তিনবোনের লেখাপড়ার খরচসহ সংসার চলছে।

ভিক্টোরিয়া আক্তার নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের বিএ শেষবর্ষের শিক্ষার্থী। গানের পাশাপাশি পারদর্শী আবৃত্তি ও উপস্থাপনা। এসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ২০১৬ সালের ১ এপ্রিলে বাড়ির বারান্দায় ‘ভিক্টোরিয়া সংগীত নিকেতন’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। বর্তমানে ১২ জন শিশু-কিশোরকে প্রতি শুক্রবারে গান, আবৃত্তি, হাতের সুন্দর লেখা ও উপস্থাপনা শেখানোর পাশাপাশি আদর্শ মানুষ করে গড়ে তোলার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গানের স্কুলটিকে সমাজসেবার অধীনে নিবন্ধনও করতে চান ভিক্টোরিয়া।

এছাড়া ভিক্টোরিয়া আক্তার গোপালগঞ্জের শেখ ফজিলাতুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াকালীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের (বিএনসিসি) অধীনে অর্জন করেন ক্যাডেট আন্ডার অফিসার (সিইউও) পদমর্যাদা। এদিকে, ভিক্টোরিয়া আক্তারের উদ্যোগেই ২০১৪ সালের প্রথম দিকে নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে বিএনসিসির মহিলা প্লাটুন খোলা হয়। রোভার স্কাউটসহ বিভিন্ন সংগঠনের সাথেও জড়িত তিনি।

ভিক্টোরিয়া জানান, তার বাবার অসুস্থতার কারণে প্রায় দুই বছর আগে তাকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকুরি করার দুইমাসের মধ্যে এক প্রতারকের খপ্পরে পড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে (২০১৫ সালের জুলাইয়ে) আসেন ভিক্টোরিয়া। পরবর্তীতে মিষ্টির প্যাকেট তৈরি, গান শিখিয়ে এবং প্রাইভেট পড়িয়ে লেখাপড়ার খরচসহ সংসারের চাকা সচল রেখেছেন। তবে, স্থান সংকুলান না হওয়ায় বাড়িতে প্রাইভেট পড়ানোসহ গানের স্কুল পরিচালনার ক্ষেত্রে অসুবিধা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

মেঝো বোন নাইগেরিয়া খানম বলেন, এতোদিন স্থানীয় (দিঘলিয়া) স্কুল ও কলেজে পড়ালেখা করলেও উচ্চশিক্ষার জন্য গোপালগঞ্জের সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে সম্মান শ্রেণিতে (প্রথম বর্ষ) ভর্তি হয়েছি। গত ১২ নভেম্বর কলেজ হোস্টেলে (হল) সিট বরাদ্দের জন্য আবেদন করলেও এখনো পর্যন্ত সিট (আসন) পাইনি। অচ্ছলতার কারণে এ মুহুর্তে মেসে বা বাসাবাড়িতেও উঠতে পারছি না। এক্ষেত্রে নিয়মিত ক্লাস করতে পারবো কী? এদিকে, ছোট বোন এলিজাবেথ পড়ছে স্থানীয় আকড়াবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে।

ভিক্টোরিয়ার বাবা মহব্বত বিশ্বাস জানান, বসতভিটার (লোহাগড়ার দিঘলিয়া) পাঁচ শতাংশ জমি ছাড়া তাদের আর কোনো সম্পত্তি নেই। তিনি বলেন, এই জমির ওপর নির্মিত টিনের ঘরে আমরা বসবাস করি এবং ঘরের এক কোণে প্যাকেট তৈরির কারখানা। প্যাকেট তৈরি কারখানাকে আরো গতিশীল করতে এবং ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন আলাদা জায়গাসহ সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। এদিকে, ভিক্টোরিয়া আক্তারসহ তিন সন্তানের জীবন সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মা নাজমা বেগম। তিনি বলেন, ঋণ এবং দেনার বোঝা মাথায় নিয়ে অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করছে আমার তিন মেয়ে।

স্থানীয় প্রগতি প্রি-ক্যাডেট স্কুলের শিক্ষক কানন পাল বলেন, ভিক্টোরিয়া খুব কষ্ট করে এগিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে আরো ভালো করতে পারবে। প্রতিবেশি বিউটি রানী সাহা বলেন, প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বে এগিয়ে যাচ্ছে ভিক্টোরিয়া। ওর জীবনযুদ্ধে আমরা অনুপ্রাণিত হই, গর্ববোধ করি। অপর প্রতিবেশি অনিতা সাহা জানান, ভিক্টোরিয়ার বাবার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তবুও পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে তিনবোন।

জেএসসি ফলপ্রার্থী মুন্নি এবং চতুর্থ শ্রেণির পূজা পাল জানায়, ভিক্টোরিয়া ম্যাডামের কাছে স্বরলিপি শেষ করে নজরুল গীতি, রবীন্দ্র সংগীত ও দেশাত্ববোধক গান শিখছি। চতুর্থ শ্রেণির মানষী সাহা বলে-আমরা এখানে শুধু গানই শিখি না, এখানে বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা, ছোটদের স্নেহ ও সমবয়সীদের প্রতি সঠিক আচার-আচরণসহ আদর্শবোধ শিখছি।

ভিক্টোরিয়ার মা নাজমা জানান, ব্রিটেনের রানী ‘ভিক্টোরিয়া’র নামানুসারে তার শাশুড়ি বড় মেয়ের নাম রাখেন ‘ভিক্টোরিয়া’। এভাবে কানাডার ‘নায়াগ্রা জলপ্রপাত’ এর নামানুসারে মেঝো মেয়ের নাম ‘নাইগেরিয়া’ এবং ব্রিটেনের অপর রানী এলিজাবেথের নামানুসারে ছোট মেয়ের নাম রাখা হয় ‘এলিজাবেথ’। কিন্তু, সুখের মুখ দেখা হয়নি তাদের। পায়নি রানীদের মতো আয়েশী জীবন। এদিকে, শাশুড়ি (আলেয়া বেগম) মারা যান ১৯৯৬ সালের ৮মার্চ। উর্পাজনক্ষম আলোয়ার মৃত্যুর পর সংসারে দেখা দেয় বেশি ‘অভাব-অনটন’।

(আরএম/এএস/ডিসেম্বর ২৮, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test