E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ধর্ষিতাকে বিয়ের শর্তে জামিন, একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত

২০১৭ ফেব্রুয়ারি ০৩ ২৩:০৮:০৭
ধর্ষিতাকে বিয়ের শর্তে জামিন, একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক


প্রেম, ভালবাসা মানুষের জীবনের সুখকর অনুভূতির জন্ম দিলেও কখনও কখনও তা উভয়ের জন্য অভিশাপ রুপে দেখা দেয়। ষোড়শী কন্যা মাইনুর আর তার আপন খালাত ভাই দেলোয়ারের জীবনে এমনই ঘটেছিল। প্রেম-ভালবাসা স্বর্গীয়। কিন্তু ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয়া শিশুর অধিকার ও দায়িত্ব নিয়ে সভ্য সমাজে এখনও রয়েছে নানা জটিলতা। ফলে ধর্ষণের ঘটনা এবং এর ফলে জন্ম নেওয়া শিশুর সামাজিক জীবন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠে। রাষ্ট্রের উদাসীনতা ও আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়ার ফলে এ রকম অধিকাংশ শিশুই হয়ে ওঠে ভয়ংকর অপরাধী।

মাইনুরকে ভালোবাসার পাশাপাশি বিবাহের প্রস্তাব দেয় তারই আপন খালাত ভাই দেলোয়ার। কিন্তু মাইনুর তাতে রাজি হয়নি। বিবাহের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ২০০৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর মাইনুরকে তার পিতার গৃহে রাতের বেলায় ধর্ষণ করে দেলোয়ার। পরে বাদিনী অন্তসত্ত্বা হয়ে পড়েন। স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ঘরে তুলে নিতে বলা হলে টালবাহানা করে দেলোয়ার ও তার পরিবার। সামাজিকভাবে উদ্যোগ নিয়েও ঘটনার মীমাংসা করতে পারেনি উভয় পরিবারের সদস্যরা। এরই মধ্যে অন্তসত্ত্বা হয়ে পড়ে মেয়েটি। এ ঘটনায় মাইনুর ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট বাদি হয়ে দেলোয়ারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ৯ ধারায় আসামীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ১৬ বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তার সম্মতি ব্যতিরেকে কোন ভীতি প্রদর্শন করিয়া বা প্রতরণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করিয়া অথবা ১৬ বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সহিত তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনসঙ্গম করে তাহা হলে তিনি কোন নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে’। অর্থাৎ ধর্ষণের সংজ্ঞা থেকে আমরা যা পাই তা হলো (১) ভিকটিমের বয়স ১৬ বছরের নিচে হতে হবে (২) তার যৌনকর্মে সম্মতি থাকলেও ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে (৩) যিনি ওই ভিকটিমের সঙ্গে যৌনকর্ম করেছেন তিনি ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেন। এবং এজন্য তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন।

পরে এ ঘটনায় করা মামলায় ২০১১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ভোলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল দেলোয়ারকে যাবজ্জীবন সাজা দেয় ওই মামলায়। পরে গ্রেফতার হয়ে সাজা ভোগ করে চার বছর। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলেও জামিন মেলেনি তার।

আইনজীবীর আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এক আদেশে মেয়েটিকে বিয়ে করলে জামিন পাবে শর্ত দেয়। কিন্তু কারাগারে বিয়ে পড়ানোর অনুমতি নেই এই মর্মে মাইনুরকে বিয়ে করা হয়নি তার। পরে ১৫ দিনের জামিন দেয় হাইকোর্ট। শর্ত একটিই তা হচ্ছে বিয়ে করতে হবে। জামিনে বেরিয়েই দেলোয়ার ৫ লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ে করে মাইনুরকে।

গত ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ইং তারিখ রোজ বৃহষ্পতিবার বিচারপতি একেএম আব্দুল হাকিম ও বিচারপতি এসএম মজিবুর রহমানের ডিভিশন বেঞ্চে বিয়ের নিকাহনামা দাখিল করা হয়। ওই নিকাহনামা গ্রহণ করে মাইনুরের মেয়ে মারিয়ার পিতার স্বীকৃতির সনদ এফিডেভিট আকারে দাখিলের জন্য দেলোয়ারকে নির্দেশ দেয় আদালত।

ওই রায়ে বলা হয়, ভিকটিম ও আসামি একে অপরের প্রতিবেশি। আসামি কর্তৃক যৌন সংগমের ফলে ভিকটিমের সাত মাসের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। যদি আসামি ভিকটিমের সন্তানের পিতা না হত তাহলে মামলার বিচার চলাকালে সে আদৌও ওই সন্তানের পিতা কিনা তা পরীক্ষার জন্য ডিএনএ টেস্টের আবেদন করত। নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই মামলার শুরু থেকেই আসামি দেলোয়ার পলাতক। ভিকটিমকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ অথবা প্রতারণার মাধ্যমে যৌন সম্মতি আদায় করে গর্ভে সন্তান দিয়েছে এবং তার অপকর্মের সম্ভাব্য প্রতিফল থেকে বাঁচার জন্য পলাতক রয়েছে। তাই নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯(১) ধারা অনুসারে আসামিকে যাবজ্জীবন সাজার পাশাপাশি এক লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরো ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হল। সাজা হওয়ার পর ২০১২ সালের ২৭ মে গ্রেফতার হন ওই আসামি। পরে কারাগার থেকে সাজার এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামি দেলায়ার। তার পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন আইনজীবী সাবিনা পারভীন।

আপিল করার পর হাইকোর্টে ৪/৫ বার জামিনের আবেদন করা হয়। কিন্তু আদালত জামিন দেয়নি। আদালত জানান আসামিকে জামিন দেওয়া হলে এই শিশুটির পিতৃপরিচয় কি হবে? সমাজ কি তাকে ভালো চোখে দেখবে? পরে আদালত শিশু সন্তানের স্বীকৃতির জন্য প্রয়োজনীয় আদেশ দেয়।

বাদিনী মাইনুর বেগম জানান, ছেলের বাবা রাজি না থাকায় সন্তানের পিতৃ পরিচয়ের জন্য আমাকে মামলা করতে হয়েছে। দেলোয়ার বলেন, আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরে জামিন পেয়ে মাইনুরকে বিয়ে করেছি।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩)-এর ধারা ১৩-তে বলা হয়েছে যে, ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া শিশুটির তত্ত্বাবধান করবেন শিশুটির মা অথবা মা-পক্ষের আত্মীয়স্বজন। এ সময় শিশুটি মায়ের অথবা বাবার অথবা উভয়ের পরিচয়ে পরিচিত হবে। আরো বলা হয়েছে যে, শিশুটির ভরণপোষণ ব্যয় বহন করবে সরকার। এ ক্ষেত্রে শিশুটি ছেলে হলে ২১ বছর আর মেয়ে হলে বিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত সরকার তার ভরণপোষণ ব্যয় বহন করবে। তবে শিশুটি যদি প্রতিবন্ধী হয়, তবে যত দিন পর্যন্ত সে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করতে না পারে, তত দিন পর্যন্ত সরকার ভরণপোষণ দেবে। আদালত এ ক্ষেত্রে নির্ধারণ করে দেবেন যে শিশুটিকে প্রতি মাসে ভরণপোষণ বাবদ কত টাকা দেওয়া হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩)-এর ধারা ২০-এ বলা হয়েছে যে, এ আইনে দায়ের করা প্রতিটি মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। ধারা ১৩(৩) এ বলা হয়েছে প্রাথমিক অবস্থায় শিশুটির ব্যয়ভার বহন করবে সরকার। কিন্তু পরে আদালতের নির্দেশে ধর্ষণকারীকে শিশুর ব্যয়ভার নির্বাহ করতে হবে। ধর্ষক ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে শিশুর ব্যয়ভার বহন করা হবে। ধারা-১৩ ও ১৫ তে বলা হয়েছে যে, ধর্ষকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রির মাধ্যমে সংগ্রহকৃত টাকা পর্যাপ্ত না হলে সে ভবিষ্যতে উত্তরাধিকারী হবে এমন সম্পত্তি থেকে ভরণপোষণ ব্যয় নির্বাহ হবে। এ ক্ষেত্রে ওই সম্পত্তির ওপর কোনো ব্যাংক লোন অথবা বন্ধকি থাকলেও শিশুটির অধিকার আগে প্রাধান্য পাবে। ধারা ১৬ তে বলা হয়েছে, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট জেলার কালেক্টর প্রথমে ধর্ষণকারীর সব প্রকার সম্পত্তির একটি তালিকা তৈরি করবেন এবং সরাসরি নিলামের মাধ্যমে সেই সম্পত্তি বিক্রি করে শিশুর ভরণপোষণ ব্যয় নির্বাহ করবেন।

ধারা ১৪ তে বলা হয়েছে ধর্ষিতা ও সন্তানের ছবি, নাম, বাসা অথবা স্থায়ী ঠিকানা কোনোটাই পত্রিকা অথবা মিডিয়ায় প্রকাশ করা যাবে না। যদি কেউ জানা সত্ত্বেও ভিকটিমের পরিচয় বা ছবি মিডিয়ায় প্রকাশ করেন, তবে তিনি এক লাখ টাকা অর্থদ-সহ জেল ভোগ করবেন। ধারা ২৪-এ বলা হয়েছে, যদি কোনো পক্ষ আদালতের রায়ের ফলে নিজেকে বঞ্চিত মনে করেন, তাহলে ওই রায় ঘোষণা হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন।

লেখক : আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও গবেষক



পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test