E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক লালন সাঁই ও তাঁর গান

২০১৭ মার্চ ১০ ১৬:৪৯:২০
অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক লালন সাঁই ও তাঁর গান

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক ফকির 


লালন সাঁই তার গানের আড়ালে যে সুচিন্তিত বক্তব্য এবং গূঢ়তাত্ত্বিক বিষয়াদি লিপিবদ্ধ করেছেন আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও তা বিন্দুমাত্র ম্লান হয়নি বরং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। লালন সাঁইর দীর্ঘ আয়ুষ্কালে স্পর্শ করেছে ওহাবী ফরায়েজী আন্দোলন, সিপাহি বিদ্রোহ, তিতুমীরের সংগ্রামসহ ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বহিঃপ্রকাশ।

হিন্দু-মুসলমান জাতিভেদ আর ধর্মাধর্মের অতিরঞ্জিত বিষয়াদিতে সমগ্র বাংলাই তখন আচ্ছাদিত ছিল। সময় যার নীরব সাক্ষী। লালন সাঁই কৈশোরেই সমাজচ্যুত হয়েছিলেন। বসন্ত কুমার পালের একটি প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, লালন সাঁই মুসলমান অন্তরায় (জোলা) পরিবার থেকে দীর্ঘদিন সেবা-শুশ্রুষা নিয়ে সুস্থ হয়ে নিজ বাড়িতে প্রত্যাবর্তনের পর তার মা এবং স্ত্রী সমাজভয়ে তাকে আশ্রয় দেননি অর্থাৎ গ্রহণ করেননি। মূল কারণ, লালন মুসলমানের ঘরে অন্ন গ্রহণ করেছেন এবং লালিত-পালিত হয়েছেন। তারপর লালন গৃহছাড়া। পরবর্তী সময়ে সিরাজ সাঁইর আশ্রিত এবং পালিত হিসেবে বড় হয়ে ওঠেন। সিরাজ সাঁইয়ের মৃত্যুর পর ভবঘুরে বাউল সবশেষে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় গহীন অরণ্যে আখড়াবাড়ি স্থাপন করেন।

সৃষ্টিকর্তার কী অবাক খেলা! হয়তো যদি সেদিন লালন গৃহচ্যুত না হতেন এবং সমাজ তিরস্কৃত না হতেন তাহলে হতে পারতেন না মহাকালের অন্যতম মহাপুরুষ। লালন সাঁই তার দীর্ঘ ১১৬ বছরের জীবনে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য গান। তিনি নিরক্ষর থাকার কারণে গান গাইতেন আর শিষ্যদের মধ্যে যারা অল্প-স্বল্প লেখাপড়া জানতেন তারা লিখে রাখতেন। লালন তার গানে আত্মতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, জাতিভেদ বিষয়ক যুক্তি, ব্যাখ্যা এবং সূক্ষ্ম অথচ তীর্যক উপমা উপস্থাপন করেছেন। ধর্ম কিংবা ঈশ্বর লালন বিশ্বাস করতেন এটি যেমন সত্য তেমনি সত্য তার মতে- সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টাকে পাওয়া যায়। যার কারণে চন্ডীদাসের অমর বাণীর (‘সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই’) মতো মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে তার গানে। তিনি কখনই জাতিত্বের সঙ্কীর্ণতায় আবদ্ধ থাকতে চাননি। তিনি বিশ্বাস করতেন জাতির এবং জাতের সীমাবদ্ধতা মানুষকে আলাদা এবং অকর্মণ্য এবং কূপমূণ্ডক করে রাখে। তার গানে এসব প্রতিফলন স্পষ্ট এবং অসম্ভব তীব্রতর-
জাত না গেলে পাইনে হরি
কিছার জাতের গৌরব করি
ছুঁসনে বলিয়ে
লালন কয় জাত হাতে পেলে
পুড়াতাম আগুন দিয়ে।
জাতের বিপক্ষে এ রকম তীব্র বাণী লালন করেছিলেন গানের মধ্যে। হিন্দু-মুসলিম বিরোধ তাকে অসম্ভব যাতনা দিয়েছিল সেটি উক্ত অংশ প্রমাণ করে।

গানের পর্ব থেকেই লালন সমাজ সংস্করণের মহান দায়িত্ব গ্রহণ না করলেও চেতনা সংস্করণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। অত্যন্ত গুরুবাদী লালন সাঁই আধ্যাত্মবাদিতা থেকে শুরু করে ভক্তিবাদ, হিন্দু-মুসলিম পুরাণ পর্যন্ত তুলে ধরেছেন তার গানে। স্বামী বিবেকানন্দের মতো লালন সাঁই সৃষ্টির সেবায় ঈশ্বর সেবা চেয়েছেন। আবার তিনি পুঁথিগত ঈশ্বর চাননি চেয়েছেন নিরাকার ঈশ্বর।

ধর্মচেতনা মধ্যযুগীয় মরমী সাধকদের যেরূপ আশ্রয় দিয়েছিল লালন সাঁইও তাদের একজন। লালন ধর্মীয় সীমাবদ্ধতার বাইরে মুক্তির পথ খুঁজেছেন। তার কণ্ঠে সুরারোপিত হয়ে তৈরি হয়েছে মানবধর্মের শ্রেষ্ঠ জয়গান। মানবধর্ম আর মানব প্রেমের মূর্ত প্রতীক কিংবা অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার অন্যতম সার্থক রূপকার লালন সাঁই কেবল মানবাত্মার মুক্তির জন্যই সংগ্রাম করেননি তার সাধনার মূলমন্ত্র ‘আত্মং বিদ্ধিং’। যার অর্থ ‘নিজেকে চেন’। দেহের ভেতর আত্মার বসতি। সবাই টের পেলেও সে আত্মাকে কেউ স্পর্শ করেনি কিংবা মানবচক্ষে দেখতে পায়নি। লালন তার গানে এ ভাবধারাই প্রকাশ করলেন-

বাড়ির কাছে আরশি নগর সেথা
এক পড়শি বসত করে
আমি একদিন না দেখিলাম তারে॥
যার চেতনাকে পুরোপুরি আত্মস্ত করে পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন-
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি
বাহির পানে চোখ মেলেছি
হৃদয় পানে চাইনি
শুধু উপরোক্ত পই নয়, রবীন্দ্রনাথ অনেক গানেই লালন সাঁইর চেতনাকে সজ্ঞানেই আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি এক সময় নিজেকে ‘রবীন্দ্র-বাউল’ বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন। কারণ হিসেবে বলা যায় রবীন্দ্রনাথ এবং লালন পুরোপুরি চিন্তা-চেতনার অনেকটাই একই পথে হেঁটেছেন।

লালন সাঁইর গানে ভনিতার প্রকারভেদ প্রচুর রয়েছে। ফকির লালন, লালন সাঁই, অধীর লালন, মূঢ় লালন, লালন ভেড়ো প্রভৃতি ভনিতায় তিনি তার গান সৃষ্টি করেছেন। অধিকাংশ গবেষকদের মতে লালন সাঁই সিরাজ সাঁইর সাক্ষাৎ প্রাপ্তির আগের গানগুলোতে ‘লালন বলে’ ‘অধীন লালন বলে’ প্রভৃতি ভনিতা জুড়ে দিয়েছেন এবং সাক্ষাৎ পরবর্তী সময়ের গানগুলোতে সিরাজ সাঁইর ভনিতা ব্যবহার করেছেন যদিও উক্ত মন্তব্যের কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। আবার লালনপন্থী অনেক বাউল-সাধকরাই তাদের গান পরিবেশনের সময় ভনিতায় ‘সিরাজ সাঁই’র উচ্চারণে ‘সেরাজ সাঁই’ উচ্চারণ করে থাকেন। আখড়াই ঘরানার সাধকদের ব্যাখ্যানুযায়ী ‘সাঁই’ শব্দটির অর্থ প্রভু, গুরু/সুতরাং ‘সেরাজ সাঁই’ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় ‘সে/রাজ/সাঁই’ যার অর্থ ‘তিনি/প্রধান বা মূল/প্রভু’ পক্ষান্তরে সিরাজ সাঁই কেবলই লালনের কথিত গুরু। লালন অত্যন্ত গুরুবাদী সাধক যার কারণে হয়তো তিনি গুরুকে স্রষ্টার কাছাকাছিই পৌঁছে দিয়েছিলেন। যদিও এ বিষয়টি সম্পর্কে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। আবার সিরাজ সাঁইর বিষয়ে গবেষকদের প্রায় সবারই স্পষ্ট মন্তব্য তিনি পেশায় পালকিবাহক ছিলেন এবং লালনের দীশাগুরু ব্যতীত আর কিছু নন।

লালন সাঁই তার গানে আধ্যাত্মবাদ, গুরুবাদ অসাম্প্রদায়িক কিংবা দেহতাত্ত্বিক বিষয়াদিতে সিরাজ সাঁইর প্রসঙ্গ এমনভাবে নিয়ে এসেছেন যার ফলে সিরাজ সাঁই কি শুধুই পালকিবাহক তার গুরু নাকি আত্মদীক্ষাদানকারী নিরাকার অলখ সাঁই। বিষয়টি রহস্যাবৃতই থেকে গেছে। নিচে বর্ণিত গানের অংশবিশেষই এ মন্তব্য সমর্থন করে-
‘প্রেমের দায়ে মত্ত হয়ে
নিজ শিরে বাদা বয়ে
এলাম নিজালয়;
সিরাজ সাঁই বলে ওরে লালন
জয় জয় বলো বাঁধা॥
ফকির লালনের গানে ও দর্শনে সুফিজমের পাশাপাশি বৈষ্ণব সহজিয়া, তান্ত্রিকতা, কর্তাভজাসহ বেশ কিছু দর্শনের মিল ঘটেছে। ধর্মাধর্মের এ বিভাগ ছাড়াও রূপাশ্রিত গীতিকবিতাও পাওয়া যায় লালন গানে। সাধক পুরুষ লালন জীবনও তার গানের মতোই রহস্যময়। ব্যক্তি লালনের জাত-ধর্ম সম্পর্কে আজও পরিষ্কার করে কেউ বলতে পারেনি। ধর্মের কথাই বলি, লালন হিন্দু কি মুসলমান এ নিয়ে অনেক মতামত পাওয়া যায়। কেউ বলেন, তিনি কায়স্থ পরিবারের সন্তান। যার পিতা মাধব এবং মাতা পদ্মাবতী। পরে তিনি ধর্মান্তরিত হন। তবে গবেষকরা মনে করেন, লালন মুসলিম তন্তুবায় পরিবারে জন্মেছিলেন। তার পিতার নাম দরিবুল্লাহ দেওয়ান। মাতার নাম আমিনা খাতুন। লালন ফকির নিজের জাত পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন :
'সবে বলে লালন ফকির
হিন্দু কি যবন
লালন বলে আমি আমার আমি
না জানি সন্ধান'।
সর্বপ্রথম জীবনীকার বসন্ত কুমার পাল ও মহাত্মা লালন নিবন্ধে একই কথা বলেছেন 'সাঁইজী হিন্দু কি মুসলমান এ কথা আমিও স্থির বলিতে অক্ষম'। অনেক মুসলমান সাধক ফকির অন্য যুক্তি দেন। তাদের মতে, আল্লাহর পথে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন বলেই লালন তার গানে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে ফকির লালন, অধর্ম লালন, দরবেশ অথবা সাঁই লালন উপাধিগুলো যোগ করেন। তবে হিন্দু সাধকরা সাঁই-গোসাই ইত্যাদি পদেও তাকে ডাকেন। আসলে লালন নিজের পরিচয় দিতে চাননি বরং আমরাই পরিচয় পেতে বার বার ধরনা দেই তার কাছে। লালনকে একদিক দিয়ে দেখা যায় না। তাকে দেখতে হয় বহু দিক দিয়ে। লালন জীবন ও বাউল দর্শন তার পদাবলীর মধ্যে মিশে আছে। লালন গানের ধারাগুলো হলো সৃষ্টিতত্ত্ব, নবীতত্ত্ব, মুর্শিদতত্ত্ব, বেলায়েততত্ত্ব, ত্রিবেনীতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব ইত্যাদি।

ইসলাম ধর্মের পাশাপাশি লালন সনাতন হিন্দু ধর্মের চরিত্র ও গুণাগুণ করেও নানাবিধ গান রচনা করেন। তার নানাবিধ গানে উঠে আসে নিমাই, কানাই, গৌরচাঁদ, রাধাকৃষ্ণ, ভারতী বিভিন্নজন। লালন ছিলেন উদার প্রকৃতির মানুষ। তিনি জাতিভেদ মানতেন না, লালনের কাছে সব মানুষ সমান ছিলেন। তাই তিনি গেয়েছেন, 'সব লোক কয় লালন কি জাত সংসারে/লালন কয় জাতির কি রূপ দেখলাম না এ নজরে'। ভাবরসে হৃদ্য বলে লালনের গান বাংলার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছে সমান জনপ্রিয়। তার কাছে 'খাঁচার ভিতর অচিন পাখি', 'বাড়ির কাছে আরশী নগর', 'আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে' ইত্যাদি গান বাউলতত্ত্ব সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। তিনি ধর্ম বিশ্বাস থেকে নিজেকে যেমন বের করে আনতে পেরেছিলেন, তেমনি গানে গানে মানবতার প্রচার করতে চেয়েছিলেন। জাতের পরিচয় বিলুপ্ত করে কিভাবে মানুষ নামের কাতারে দাঁড়ানো যায়, তারও সব ব্যাখ্যা লালনের গানে পাওয়া যায়। বহু তীর্থভ্রমণ এবং সাধু সন্ন্যাসীদের সঙ্গলাভের পর ছেউড়িয়ার আখড়ায় বসেই লালন আজীবন সাধনা ও সংগীত চর্চা করেন।

বাংলার বাউল ধর্মমতের শুরু মধ্যযুগে। গবেষকদের মতভেদ রয়েছে এ ব্যাপারে যথেষ্ট। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে, বাউলধর্মের সূত্রপাত আনুমানিক ১৬২৫ সালের দিকে। আহমদ শরীফ মন্তব্য করেছেন ‘উনিশ শতকে লালন ফকিরের সাধনা ও সৃষ্টির মাধ্যমেই এর পরিপূর্ণ বিকাশ।’

লালন সাঁইয়ের বাউলতত্ত্ব পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং মানবধর্ম নির্ভর। যদিও সব বাউলদেরই একই পথ তবুও বাংলার ঐতিহ্য, চিন্তাধারা, সমাজ ব্যবস্থার সুর পুরোপুরিই পাওয়া যায় লালনের গানে। আধ্যাত্ম চেতনা আর ঐশ্বর্যের মাধুর্যে লালন সাঁই যে মরমী জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন আজ তার মানবলীলা সম্বরণের এতো বছর পরও তার গানের চেতনায় ভাটা পড়েনি বরং চর্যাপদের মতো তার গানের অন্তর্নিহিত বিষয়াদি দিনের পর দিন মানুষের বোধকে ত্বরান্বিত করেছে চিরভাস্কর সাম্যবাদিতা আর অসাম্প্রদায়িকতার দিকে। জাতভেদ আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লালন সাঁইর গান এক নীরব মূলমন্ত্র, চেতনার শানিত মারণাস্ত্র।

(এসপি/এএস/মার্চ ১০, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test