E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়িতে অভিনবত্বের ছোঁয়া

২০১৭ জুন ১১ ১৩:১৬:০৬
টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়িতে অভিনবত্বের ছোঁয়া

রঞ্জন কৃষ্ণ পন্ডিত, টাঙ্গাইল : ঈদুল ফিতরে পোশাকের প্রতি বাঙালির অনুরাগ চেতনাগত- অভিনব শাড়ির প্রতি টান মজ্জাগত। যেকোনও অনুষ্ঠানে বাঙালি রমণীর  প্রথম পছন্দ শাড়ি। নিত্যনতুন ডিজাইনের টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি নারীদের পছন্দের তালিকায় প্রথম দিকেই থাকে। আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে তাই ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়িতেও এসেছে বৈচিত্র্যতা, অভিনবত্ব এবং বহুমুখী ব্যবহার। ঈদকে সামনে রেখে বেড়েছে তাঁতের শাড়ির বিকিকিনি। সার্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি ভাল থাকার কারণে বিগত দুই বছরের তুলনায় এ বছর শাড়ি বিক্রি বেড়ে গেছে বলে জানান শাড়ি ব্যবসায়ীরা। তবে বরাবরের মতোই দাম কিছুটা বেশি- অভিযোগ ক্রেতা সাধারণের।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি যুগ যুগ ধরে বাঙালি নারীর ফ্যাশনের প্রতীক হয়ে রয়েছে। এই শাড়িতেই যেনো ফুটে ওঠে বাঙালি নারীর চিরায়ত বাস্তব রূপ। বাঙালি নারীর সঙ্গে তাঁতের শাড়ির সম্পর্ক বহু দিনের। লালপাড়ে তাঁত আর আড়াআড়ি ডোরা শাড়িতে ফুটে উঠতো এক সময়কার বাঙালি নারীর কবিকল্পিত রূপ। ব্লক, বাটিক, প্রিন্টের শাড়ির ভিরে ৮০’র দশকে হারাতে বসেছিল এই শাড়ির ঐতিহ্য। তবে এখন আবার ফিরে এসেছে এই ঐতিহ্য। এখন শহরের ফ্যাশনেবল নারীরাও পছন্দ করছেন তাঁতের সুতি শাড়ি।

টাঙ্গাইল শাড়ি পড়ার মধ্যেও রয়েছে শিল্পের ছোঁয়া। এই শাড়ি কেমন করে পড়বেন সেটি অধিকাংশ সময় নির্ভর করে শারীরিক নানা বৈশিষ্ট্যের ওপর। তবে চিকন পাড়ের তাঁতের শাড়ি সবসময় ব্যবহারের জন্য বেশি আরামদায়ক। আবার উৎসবে-পার্বণে যেমন ঈদে নিজেকে ভিন্নমাত্রায় উপস্থাপন করতে বেছে নেওয়া যায় এরকম শাড়ি। শুভ্রতার সঙ্গে মিলিয়ে তাঁতে বোনা শাড়িটি হবে একেবারে ছিমছাম এবং সাধারণ। সঙ্গের আপনার সাজটাও হতে হবে এক মানানসই। আবার মোটা পাড়ের একরঙা শাড়িও বেছে নিতে পারেন। হালকা গোলাপি, উজ্জ্বল আকাশি, হলুদ, গেরুয়া, হালকা সবুজ ও নীল রঙগুলোই বেশি মানানসই হতে পারে। তবে সবকিছুই নির্ভর করবে ক্রেতার রুচির ওপর।

তাঁত শাড়ির রাজধানী হিসেবে পরিচিত টাঙ্গাইলের পাথরাইলের তাঁতী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শেষ সময়ের ব্যস্ত সময় পাড় করছেন তাঁত শ্রমিকরা। বিরামহীন দক্ষ হাতগুলো মাকু চালিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের শাড়ি তৈরি করছেন। এখানকার তাঁতিরা যুগ যুগ ধরেই তৈরি করছেন বেনাসরি, সিল্ক, জামদানিসহ বিভিন্ন ধরনের শাড়ি। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শাড়ি কিনতে আসছেন ব্যবসায়ীরা। ইদানিং অবশ্য শাড়ির বহুমুখী ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাঁতীরাও তীব্র দৃষ্টি রেখেছেন সেদিকে।

কয়েক বছর আগে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি কেটে মেয়েদের আধুনিক ডিজাইনের থ্রি-পিছ/ ফোর-পিছ তৈরি করা হয়। ধীরে ধীরে তাঁতের তৈরি কাপড়ের থ্রি-পিছ/ফোর-পিছও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁতীরাও নানা কাউন্টের সুতা, রঙ ও ডিজাইনে থ্রি-পিছ/ ফোর-পিছ তৈরিতে এগিয়ে আসেন। হাল ফ্যাশনের সুতী নান্দনিক থ্রি-পিছটিও তৈরি হচ্ছে টাঙ্গাইলে। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী শাড়ির সাথে অভিনবত্ব নিয়ে যোগ হয়েছে সুতী কাপড়ের থ্রি-পিছ।

চট্টগ্রামের শাড়ি ব্যবসায়ী মোবারক মিয়া, বাবুর হাটের কিসমত আলী, কুষ্টিয়ার রাজ মোহন এসেছেন পাথরাইলে তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য শাড়ি নিতে। তারা জানান, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির চাহিদা প্রচুর। রোজার শুরুতে এসে যে শাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন তা প্রায় সব শেষ হয়ে গেছে। মাঝে ফোনে চাহিদা জানিয়ে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে শাড়ি নিয়েছেন। চাহিদা বেশি থাকায় আবারও নিজেরাই এসেছেন নতুন ধরনের শাড়ি নিতে।

তারা জানান, তঁতের শাড়ির সাথে এবার তারা সুতী হরেক ডিজাইনের থ্রি-পিছও নিচ্ছেন- বাজারে টাঙ্গাইলের সুতী থ্রি-পিছও একটি স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে। তারা আরো জানান, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি অনলাইনে মাকেটিং হওয়ায় ইদানিং প্রচারণাটা বেড়েছে। দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী-ভোক্তারা অনলাইনে দেখে-শুনে পছন্দের শাড়ির চাহিদা পাঠাচ্ছেন। মনে মণ্টুর শাড়ি, নীল কমল বসাকের শাড়ি সহ বেশক’টি শাড়ি ফ্যাক্টরি মালিক অনলাইনে শাড়ি কেনাবেচা করছেন।

টাঙ্গাইল শহরের বিশ্বাস বেতকার শারমিন আক্তার, সন্তোষের নাসরিন আক্তার, বটতলার রহিমা খাতুন সহ অনেকেই এসেছেন তার নিজের জন্য এবং আত্মীয়-স্বজনদের জন্য শাড়ি কিনতে।

তারা বলেন, উন্নতমানের সুতায় নিখুঁত বুননের জন্য এবং নতুন ডিজাইনের জন্যই টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তাদের বেশি পছন্দ। তাদের দাবি যেহেতু বাড়ির কাছেই তাঁত শাড়ির রাজধানী তাই ১০-১২টা আইটেম দেখে-বুঝে শাড়ি নিতে এসেছেন। অনলাইনে শাড়ির যে ছবি ও দাম দেওয়া থাকে তা অনেকটাই বাস্তবতার সাথে মিলেনা। এদিকে অনলাইন ব্যবসায়ীদের নজর দিতে হবে।

তাঁত শ্রমিক রমেশ চন্দ্র দাশ দীর্ঘ ১৩-১৪ বছর ধরে এই পেশায় জড়িত। তিনি জানান, স্বাভাবিকভাবে সপ্তাহে ৩টা দোতারি জামদানি শাড়ি উৎপাদন করেন। কিন্তু ঈদের আগে শাড়ির চাহিদা বেশি থাকায় দিনরাত কাজ করতে হচ্ছে।

চন্ডি গ্রামের স্বপন পাল ১৬ টা তাঁতের মালিক। তিনি জানান, ঈদের আগে শাড়ির চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। মহাজনের শাড়ির চাহিদা মেটাতে শ্রমিকদের স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি সময় ধরে কাজ করতে হয়। এ সময়ে শ্রমিকদের বোনাসটা তো দিতেই হয়। বোনাসের আশায় শ্রমিকরাও দিনরাত খাটে।
কালিহাতী উপজেলার রামপুর থেকে শাড়ি সরবরাহ করতে এসেছেন আবু বকর। তার তাঁত রয়েছে ১৮টি, অন্যের আরো ৮টিতে শ্রমিক দিয়ে শাড়ি বুনছেন তিনি।

তিনি জানান, তারা মূলত শাড়ি তৈরি করে মহাজনের গদিতে দেন। মহাজনরাই বাজারজাত করে থাকেন। মহাজনরা শারির ডিজাইন, নকশা ও সুতার প্রকার নির্ধারণ করে দেন। কখনো কখনো মহাজনের দেয়া পূঁজিতে শাড়ি তৈরি করে সরবরাহ করেন, শ্রমিক মজুরির সাথে বাড়তি কিছু টাকা পান। পরে বছর শেষে হিসাবান্তে মহাজনরা পুরো টাকা পরিশোধ করেন।

তিনি আরো জানান, বছরের এ সময়টাতে শাড়ির চাহিদা বেশি থাকে। এজন্য তাদের প্রস্তুতিও রয়েছে।

পাথরাইলের শাড়ি ব্যবসায়ীরা জানান, রোজার প্রায় তিন মাস আগে থেকেই ঈদুল ফিতরের বাজারকে টার্গেট করে নতুন নতুন নকশা তৈরি করে শাড়ি বুনন শুরু হয়। রোজার শুরুর ১০-১৫ দিন আগে থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীরা শাড়ি নেওয়া শুরু করেন। ঈদুল ফিতরের সপ্তাহখানেক আগ পর্যন্ত এ অবস্থা চলে। আর খুচরা ক্রেতারা ১৫ রোজার পর থেকে পুরোদমে আসা শুরু করেন। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর শাড়ি বিক্রি অনেক বেশি।

পাথরাইলের প্রবীণ শাড়ি ব্যবসায়ী ও জেলা তাঁত মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি রঘুনাথ বসাক জানান, গত দুই তিন বছরের তুলনায় এবার ঈদে টাঙ্গাইল শাড়ির বাজার বেশ ভালো। আড়াই থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা দামের শাড়িই বেশি বিক্রি হচ্ছে। সুতি শাড়িও বিক্রি হচ্ছে প্রচুর। ঈদকে কেন্দ্র করে আনুমানিক এক কোটি পিস টাঙ্গাইল শাড়ি বিক্রি হবে বলে আশা করেন তিনি। তিনি জানান, সুতী থ্রি-পিছ ইদানিং তৈরি শুরু হয়েছে- তবে এখনও তেমন প্রসার পায়নি।

রঘুনাথ বসাক আরো জানান, এবারের ঈদকে সামনে রেখে টিস্যু সিল্কের জামদানি, ছত্রিশ গড়ের মুগা সুতায় তৈরি শাড়ি, গিজা সুতায় শাড়ি উৎপাদন করেছেন তিনি। এছাড়াও উৎপাদন করেছেন, জামদানি, সিল্ক জামদানি, টিস্যু জামদানি শাড়ি। আর ৪০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দামের শাড়ি উৎপাদন করা হয়েছে। তবে দীর্ঘদিনের শাড়ি ব্যবসায়ী রঘুনাথ বসাকের দুঃখ অন্যখানে।

তিনি বলেন, আজকাল শাড়ির ব্যবহার কমে যাচ্ছে। তুলা উৎপাদন থেকে শুরু করে, আমদানি, সুতা তৈরি, শাড়ি উৎপাদন, বিপণন- সবকিছু মিলিয়ে আমাদের দেশে শাড়ি শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় তিন কোটি লোক জড়িত। যদি শাড়ির ব্যবহার কমে যায় তবে এই বিশাল জনগোষ্ঠি কর্মসংস্থান নিয়ে বিপদে পড়বে।

(আরকেপি/এসপি/জুন ১১, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test