E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ক্ষয়িষ্ণু অবস্থানে কয়লা-পারমাণবিক বিদ্যুৎ

২০১৭ জুলাই ০৭ ১৩:২০:১৮
ক্ষয়িষ্ণু অবস্থানে কয়লা-পারমাণবিক বিদ্যুৎ

ফিচার ডেস্ক : লেক সুপেরিয়রের পশ্চিম প্রান্তছোঁয়া জমিতে পুঁতির মালার মতো গেঁথে আছে কাগজ ও আকরিক লোহার অনেকগুলো কারখানা। ২০০৫ সালে এসব কারখানায় বিদ্যুত্শক্তির ৯৮ ভাগ জোটাত কয়লাভিত্তিক উৎপাদন কেন্দ্রগুলো।

এখন ২০১৭ সাল চলছে। সত্যিই যুগ পাল্টেছে। মিসোটা, ক্লকেট, ইন্টারন্যাশনাল ফলস পেপার মিল, মেসাবি নাগেট, হিবিং ট্যাকোনাইট, আরসেলরমিত্তাল মাইনোক্রার কারখানায় কয়লা থেকে আসা বিদ্যুতের পরিমাণ এখন নিয়মিতই কমছে। ২০২৫ সাল নাগাদ এসব কারখানা ও নিকটবর্তী ডুলুথ শহরের কয়লানির্ভরতা এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নোংরা জ্বালানি বলে পরিচিত কয়লা থেকে মিনেসোটার এ শিল্পাঞ্চলকে দূরে সরানোর পরিকল্পনাটি এসেছে স্থানীয় পরিষেবা সংস্থার তরফ থেকেই। বায়ুকল ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য উত্স থেকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের ৪৪ শতাংশ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিনেসোটা পাওয়ার।

এরই মধ্যে মিনেসোটা পাওয়ারের আটটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ছয়টিই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সংস্থাটি এখন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছে বলে গত মাসে এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

মিনেসোটা কোনো বিচ্ছিন্ন ছবি নয়। যুক্তরাষ্ট্রজুড়েই পরিচ্ছন্ন জ্বালানি মানচিত্র দিন দিন বড় বড় হচ্ছে। কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো মার্কিন পাওয়ার গ্রিড থেকে একে একে ঝরে পড়ছে। আর সে জায়গায় সংযুক্ত হচ্ছে একের পর এক প্রাকৃতিক গ্যাস, বায়ু ও সৌরশক্তিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র।

বৈরী স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুৎ সঞ্চালন নেটওয়ার্কে ইতিবাচক এ পালাবদল হচ্ছে। খোদ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কয়লাকে পুনরুজ্জীবিত করার আভাস দিয়েছেন। মার্কিন জ্বালানিনীতি পর্যালোচনার ঘোষণা দিতে গিয়ে মঙ্গলবার তিনি এও বলেছেন, ‘আমি আমাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎ খাতকে পুরুজ্জীবিত ও প্রসারিত করতে চাই।’

কয়লা ও পারমাণবিক শক্তিকে প্রসারিত করতে হলে গ্যাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে সংকুচিত করা চাই। ট্রাম্পের ঘোষণায় তাই যুক্তরাষ্ট্রে এক ধরনের ‘পাওয়ার গ্রিড শোডাউনের’ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে: ফেডারেল সরকারের নতুন নীতি কি কয়লা ও পারমাণবিক শক্তিকে মুমূর্ষু অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনবে? নাকি গ্যাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি আরো বেশি বাজার-অংশ অধিকার করবে?

মিনেসোটা পাওয়ারের মতো তুলনামূলক ছোট কোম্পানিগুলো শুধু নয়, অনেকগুলো বড় করপোরেশনের জ্বালানি মিশ্রণেও রূপান্তর ঘটছে।

নর্থ ক্যারোলাইনার শার্লটভিত্তিক পরিষেবা সংস্থা ডিউক এনার্জি করপোরেশনের কথাই বলা যাক। পাঁচটি রাজ্যে বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করে ডিউক এনার্জি। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত বিদ্যুতের ৭ শতাংশ আসত গ্যাস ও নবায়নযোগ্য উত্স থেকে।

গত বছর ডিউক এনার্জির বিদ্যুতে নবায়নযোগ্য উেসর অবদান ছিল ৩২ শতাংশ। ২০২৬ সাল নাগাদ এমন পরিচ্ছন্ন জ্বালানির অংশ ৪৪ ভাগে উন্নীত করার আশা করছে প্রতিষ্ঠানটি।

নবায়নযোগ্য ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানির দিকে পরিষেবা সংস্থাগুলোর ঝোঁকের পেছনে মুনাফারও ভূমিকা রয়েছে।

ওয়ারেন বাফেটের কোম্পানি বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের মালিকানাধীন প্যাসিফিকর্প বায়ু ও সৌরশক্তিতে ১ হাজার ৩৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। ওরেগনভিত্তিক কোম্পানিটি গত সপ্তাহে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে এ-সংক্রান্ত পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। প্যাসিফিকর্প বলেছে, ‘নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো আগামী ২০ বছরে ক্রেতাদের জ্বালানি চাহিদা মেটানোর সবচেয়ে সাশ্রয়ী বিকল্প।’

ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্য অনুযায়ী, গ্যাস, বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি চাহিদার ৪০ ভাগ মেটাচ্ছে। এক দশক আগে এসব উত্স থেকে জ্বালানি চাহিদার ২২ ভাগ মিটত।

দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন জ্বালানি চাহিদার বড় অংশ মিটিয়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ। কিন্তু গ্যাস ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের প্রসারের কারণে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়েছে কয়লার কারবার। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে তিনটিই বিগত পাঁচ বছরে চূড়ান্তভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।

পারমাণবিক বিদ্যুৎও একসময় যুক্তরাষ্ট্রের বড় নির্ভরতা ছিল। কয়লার মতো কালো দিন দেখছে এ খাতটিও। ২০২৩ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রে হয়তো ৫৪টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র টিকে থাকবে। অথচ এক দশক আগে সে দেশে এমন বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল ৬৫টি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা বলছেন, নতুন করে ভর্তুকি পেলেই শুধু এসব কেন্দ্র বন্ধ হওয়া ঠেকানো যাবে।

কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রকে বেস-লোড পাওয়ার বা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ জুগিয়েছে। গ্যাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির কাছে কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুতের পরাজয়ে অনেকে আশঙ্কা করছেন, নতুন উত্সগুলো হয়তো বিদ্যুৎ সঞ্চালন গ্রিডকে স্থিতিশীল রাখতে পারবে না।

মার্কিন জ্বালানি মানচিত্রের এ রূপান্তরে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে গ্যাস। হাউড্রলিক ফ্র্যাকচারিংসহ নতুনতর কিছু কৌশলের সুবাদে গ্যাসের জোগান যেমন বেড়েছে, তেমনি কমেছে দাম। নিউ মেক্সিকোর পরিষেবা কোম্পানি পিএনএম রিসোর্সেসের চেয়ারম্যান ও সিইও প্যাট ভিনসেন্ট-কোলান বলেন, ‘এটাই (গ্যাস) কয়লাকে দূরে হটিয়ে দিচ্ছে।’ গত বছর পিএনএম রিসোর্সেসের উৎপাদিত বিদ্যুতের ৫১ শতাংশ কয়লা থেকে এসেছিল। আগামী বছর কয়লার অংশ ৪১ শতাংশে নেমে আসবে।

গ্যাসে নির্ভরতা বৃদ্ধির পেছনে জোগান বৃদ্ধি ও মূল্য হ্রাসের পাশাপাশি অন্য কারণও রয়েছে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এখন পাঁচ বছর আগের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষ। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস এনার্জি ইনস্টিটিউটের রিসার্চ ফেলো জশ রোডস বলেন, ‘আমরা শুধু মাটি থেকে আগের চেয়ে বেশি গ্যাসকণা আহরণ করছি না, আহরিত গ্যাসকণা থেকে আগের তুলনায় অনেক বেশি বিদ্যুৎও বের করে নিচ্ছি।’

কয়েক বছর আগেও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রায় ৩০ ভাগ সময় কার্যরত থাকত। বর্তমানে এসব কেন্দ্র অর্ধেকের বেশি সময় ধরে সচল থাকছে। কিছু কেন্দ্র বিরতিহীনভাবে চলছে। এভাবে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো ক্রমশ বেস-লোড পাওয়ার জোগানোর সক্ষমতা অর্জন করে নিয়েছে; একসময় যে কৃতিত্ব কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছিল।

কলোরাডো, মিনেসোটা ছাড়াও আরো ছয়টি রাজ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে এক্সসেল এনার্জি। কোম্পানিটির চেয়ারম্যান ও সিইও বেন ফোউকি বলেন, ‘কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুতের সংকোচনের জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে দায়ী করার কিছু নেই। আসল কথা হলো, বায়ুকলের মতো উত্স আমাদের ক্রেতাদের অর্থ সাশ্রয় করছে।’

পারমাণবিক বিদ্যুৎ কয়লার মতো ময়লা নয়। কিন্তু প্রাকৃতিক গ্যাস ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য উত্স থেকে যেভাবে সস্তা বিদ্যুৎ মিলছে, তাতে পারমাণবিক বিদ্যুতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ক্রমশ অসাধ্য হয়ে উঠছে।

(ওএস/এসপি/জুলাই ০৭, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test