E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

সময় থাকতেই সাধন করতে হয়, এটাই বড় সুযোগ

২০১৭ জুলাই ১১ ১৫:৪৬:০৬
সময় থাকতেই সাধন করতে হয়, এটাই বড় সুযোগ

প্রবীর বিকাশ সরকার


গতকাল আমি কুমিল্লা শহরস্থ টমসমব্রিজ নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিলাম ফেইসবুকে। বিভিন্ন মন্তব্য এসেছে। কিন্তু কোনোটাই আন্তরিকতাপূর্ণ নয়। না থাক এতে আমার কিছু যায় আসে না।

তবে কয়েকজন আমাকে ইনবক্সে হতাশাব্যঞ্জক মন্তব্য দিয়েছেন। কেউ বলেছেন, ‘হবে না দাদা।’ কেউ কেউ বলেছেন, ‘শহরটা এখন গার্বেজের শহর! এটা আর ফুলের শহর হবে না!’ কেউ বলেছেন, ‘নোংরা রাজনীতি এর জন্য দায়ী।’ একজন বলেছেন, ‘এই অবস্থার জন্য মেয়র, এমপি, ডিসিসহ সব উচ্ছপদস্থ কর্মকর্তারা দায়ী! কেউ কারো কথা শোনে না!’ একজন তরুণ বলেছেন, ‘আঙ্কেল, বিষাক্ত পানির মধ্যে আমরা বেড়ে উঠছি! অচিরেই আমরা ঝরে যাবো! এই যুগে শহর কি এরকম হওয়ার কথা! অথচ বড় বড় চমৎকার সব ভবন, ফ্লাট একটার পর একটা উঠছে। অথচ ময়লা, আবর্জনা ফেলা এবং পরিষ্কার করার কোনো নিয়মনীতিপদ্ধতি নেই! শহরে হাঁটাচলার পথও নেই!’ একজন স্কূল শিক্ষক বললেন, ‘একটু বিষ্টি হলেই শহরটা নর্দমা হয়ে যায়। দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা জল যার মধ্যে মানুষের প্রস্রাব এবং মল মেশানো--সেসব পায়ে নিয়ে অফিসে, মন্দিরে, মসজিদে , হাসপাতালে, বিদ্যালয়ে এবং বাসায় ফিরি। নানা ধরনের জীবাণু আমাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত কিলবিল করছে, আমরা টের পাই না, অসুস্থবোধ করলে ডাক্তারের কাছে যাই আর টাকার শ্রাদ্ধ করি! দাদা কিছু লিখুন, কিছু করুণ অন্ততপক্ষে শিশু-কিশোর-কিশোরীদের দিকে তাকিয়ে। ওদের কোনো দোষ নেই, ওরা নিষ্পাপ, রাজনীতি আর দুর্নীতির ঊর্ধ্বে। ওরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ!’ ইত্যাদি, ইত্যাদি।

এরকম আরও বড় মন্তব্যও এসেছে ইনবক্সে। তারা ইনবক্সে কেন মন্তব্য পাঠালেন তা সহজেই অনুমেয়, নিরাপত্তা নেই বলে।

এবং এও জানি এই কারণে অনেকেই আমার বিবৃতিটি এড়িয়ে গেছেন। সে যাক। এই শহরের একজন স্থায়ী নাগরিক হিসেবে আমার সুবিধা-অসুবিধার কথা বলতেই পারি। সরকার তো বলছেই, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ। তা হলে ভয় কীসের? আমি সরকারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও শ্রদ্ধা রেখেই গণতান্ত্রিকভাবে কুমিল্লা শহরের সমস্যাদির কথা তুলে ধরছি কারণ নাগরিক সুবিধা ও পরিবেশ থেকে আমার মতো সকল করদাতা অধিবাসীকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আমি, আমার (বিদেশি) স্ত্রী এবং মেয়েকে নিয়ে এই শহরে সুপরিবেশে বসবাস করতে চাই। আমার বংশধররাও বসবাস করবে অদূর ভবিষ্যতে। এটা আমাদের অধিকার। সেই অধিকার বাস্তবায়ন করা নগর-কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এর সঙ্গে ভোট বা রাজনীতি জড়িত নয়। নগর-শাসক বা কর্তৃপক্ষ যারাই হবেন এটা তাদের কিরণীয় নাগরিকের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা মাথায় রেখে কাজ করে যাওয়া। জাপানেও তাই, অন্যান্য দেশেও। এটা কমন সেন্সের ব্যাপার, অন্য আর কিছু নয়। কর্তৃৃপক্ষ আমাদের শত্রু নন, আমরাও তাদের শত্রু নই। এটা তো পরিষ্কার যে মান-অভিমানেরও কিছু নেই।

নাগরিকরা কর দেবেন এবং সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। নগর কর্তৃপক্ষ সকল রাজনীতি, দুর্নীতি এবং পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে নগরবাসীর সুযোগ-সুবিধা দেখবেন, সমস্যার সমাধান করবেন। তারপরও কথা থাকে, শুধু নগর কর্তৃপক্ষের দায়-দায়িত্ব পালন করলেই চলবে না, নগরবাসীরও অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। নিয়মিত কর পরিশোধ করা, নিজের বাড়িঘর পরিষ্কার রাখা, বাসাবাড়ির চতুর্দিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, যত্রতত্র ময়লা না ফেলা, শহরে অবর্জনা না ফেলা, যেথাসেথা প্রস্রাব না করা, থুথূ না ফেলা, নাক না ঝাড়া ইত্যাদি দৈনন্দিন কমন সেন্স বজায় রাখা।

সিটি কর্পোরেশন বা নগর কর্তৃপক্ষের যদি সদিচ্ছা থাকে তা হলে ছোট্ট এই শহরটিকে রূপময় বাসযোগ্য করা আদৌ কোনো কঠিন কাজ নয়। দরকার শুধু আন্তরিকতা, মানুষকে ভালোবাসা। ভালো কাজের জন্য মানুষ অবশ্যই মূল্যায়ন করে থাকে। কিন্তু বর্তমান যে নারকীয় অবস্থা, পরিবেশ-বিপর্যয় এবং মানুষের নাভিশ্বাস ওঠা তার জন্য কর্তৃপক্ষ ৫০% দায়ী। বাকিটা নগরবাসী দায়ী।

‘প্রয়োজন আবিষ্কারের জননী’ এটা চিরসত্য। কাজেই চিন্তা করতে হবে, পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে কর্তৃপক্ষ এবং নগরবাসীকে যৌথভাবে। সমস্যা আছে সমাধানও আছে। নাগরায়নের ফলে নানা সমস্যা দেখা দেয় এবং সমাধানও করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কমপক্ষে ১ দশক জাপানের রাজধানী টোকিও এমনই ছিল আজকে যেমন ঢাকা, তারা সমাধান করতে পেরেছে ১৯৬৪ সালেই অলিম্পিকের সময়। আর এখন তো রিসাইকেলের যুগ! জাপানের আবর্জনা পদ্ধতির ওয়েবসাইটটি দেখুন তা হলে বুঝতে পারবেন যুগ কোথায় চলে গেছে, কুমিল্লার মতো ছোট্ট একটি শহরের সিটি কর্পোরেশন কোথায় পড়ে আছে!

উপস্থাপিত ছবিগুলো প্রমাণ করছে যে, নগর কর্তৃপক্ষ ও নগরবাসীর উভয়ের জবাবদিহিতার প্রয়োজন রয়েছে। সেইসঙ্গে এমপি, ডিসি, এসপি এদেরও জবাবদিহির প্রয়োজন রয়েছে তাদের অবহেলার জন্য। যেহেতু তারা এই শহরে বসবাস করছেন এবং প্রতিদিন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন নীরবে কিন্তু কিছুই বলছেন না। এখানেও তাদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যায়। কেননা, প্রশাসনিকভাবে একটা শহরকে মনুষ্যবাসযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব সরকারি কর্মকর্তাসহ সাংসদেরও। শহরের নোংরা পরিবেশ যে নগরবাসীর স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি, শিশুদের দৈহিক-মানসিক প্রবৃদ্ধির পরিপন্থী; শুধু তাই নয়, সন্তানসম্ভবাদের প্রতিও অবজ্ঞাস্বরূপ এটা মেধাসম্পন্ন প্রশাসকদের বুঝিয়ে বলার প্রযোজন নেই। সুতরাং এই অবজ্ঞা-অবহেলা ক্ষমার অযোগ্য বলে বিবেচিত।

শহরটা আমাদের সকলের। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই অঞ্চলের শিক্ষা-সংস্কৃতির রাজধানী কুমিল্লাকে রক্ষা করা জরুরি। একটি আদর্শ বাসযোগ্য শহরে রূপান্তরিত না করলে নয়।স্মরণে রাখা দরকার যে, বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি হওয়া উচিত বৈশ্বিকমাপের নগরায়ন। কুমিল্লাসহ সারা বাংলাদেশেই যে নগরায়ন চলছে সেগুলো সম্পূর্ণভাবে ভুল এবং বিপদজনক। এই প্রবণতার এখনই লাগাম টেনে ধরতে হবে। তা না হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহ শিকার হবে প্রতিটি শহর ও জনপদ। কোনো রাজনীতিই এই আকস্মিক বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে পারবে না। পরাক্রমশালী আমেরিকা, জাপান, জার্মানি, ব্রিটেনও রক্ষা পাচ্ছে না! বাংলাদেশ তো ছোট্ট একটি বদ্বীপ মাত্র! যার অর্থনৈতিক শক্তি নেই দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতির মোকাবেলা করার।

মনে রাখবেন, জন্মভূমি, জন্মশহর, জন্মগ্রামই আপনার একমাত্র আশ্রয়, বিদেশ বা সুইসব্যাংক আপনার আশ্রয় নয়। জন্মভূমিকে অবহেলা করা মানেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মাশুল দিতেই হবে। দূর এবং নিকট অতীতে অনেকেই দিয়েছেন জীবদ্দশায় সেসব দেখার সাক্ষী আমিও।

শক্তি বেশিদিন থাকে না, সময় থাকতে পেশিকে জনস্বার্থে কাজে লাগানোই বুদ্ধিমানের কাজ। তা না হলে মৃত্যুর পরও অভিশম্পাত, অভিশাপ বয়ে বেড়াবে সন্তানরা, বংশধররা। কোনো সচেতন মানুষেরই এটা কাম্য হওয়া উচিত নয়।

লেখক : জাপান প্রবাসী সাহিত্য গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test