E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

৩ কারণে বিলুপ্তির পথে বাঘ

২০১৭ জুলাই ৩০ ১৩:৩১:৫০
৩ কারণে বিলুপ্তির পথে বাঘ

ফিচার ডেস্ক : বাংলাদেশের অহঙ্কার করার মতো সম্পদ রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাঘ হারিয়ে যাচ্ছে প্রধানত তিন কারণে। দায়ী ত্রয়ী হচ্ছে শিকারী-জলবায়ু-সরকার।

বাঘের চামড়া পাচার ও উচ্চমূল্যে বিক্রির উদ্দেশ্যে চোরা শিকারীরা নির্বিচারে বাঘ মেরে ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনের বৈরী পরিবেশ বাঘের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। সর্বোপরি সরকারের উদাসীনতায় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। বন্যসম্পদ রক্ষার করার অঙ্গীকার মেনে নিশ্চিত করা হচ্ছে না বাঘের নিরাপদ এবং উপযুক্ত আবাসস্থল। এসব কারণে গত ১৫ বছরে সুন্দরবনে ৮৬ শতাংশ বাঘ কমেছে।

বাঘ কমে যাওয়ার এই সংখ্যা এতোটাই উদ্বেগজনক যে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে বাঘ বিলুপ্ত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। পরিবেশবিদ, প্রাণিবিজ্ঞানী, দেশের প্রথম সারির দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অধ্যাপক, বন বিভাগ ও গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বনভূমি রয়েছে। কিন্তু বাঘ রয়েছে মাত্র ১৩টি দেশে। বাঘসমৃদ্ধ দেশকে টাইগার রেঞ্জ কান্ট্রি (টিআরসি) বলা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অথচ আমাদের দেশে বাঘ বসবাস করছে সবচেয়ে অবহেলা আর অনিশ্চয়তায়। বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের অন্য যেসব দেশে বাঘ রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম ও রাশিয়া। এমনকি আন্তর্জাতিক দিবস হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবছর মাত্র এই কয়েকটি দেশেই ‘বিশ্ব বাঘ দিবস’ পালিত হয়। বাঘ রক্ষার অঙ্গীকারে এ বছর দিবসটি পালিত হয়েছে।

সুন্দরবন একাডেমির উপদেষ্টা রফিকুল ইসলাম খোকন দাবি করেছেন, ২০০১ সালে সুন্দরবনে বাঘের অস্তিত্ব ছিল ৪৪০টি, ২০১৬ সালে সে সংখ্যা নেমে দাঁড়ায় ১০৬। এই সংখ্যা বর্তমানে ‘ডাবল ডিজিটে’ রূপ নিয়েছে। অর্থ্যাৎ ১০০-এর নীচে নেমে গেছে। যদিও সর্বশেষ জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে ২০১৫ সালে বনবিভাগ থেকে জানানো হয়, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা মাত্র ১০৬। ২০০৪ সালে বন বিভাগের জরিপে পায়ের ‘ছাপ’ গণনা করে বলা হয়, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০। তার মধ্যে পুরুষ ১২১টি, বাঘিনী ২৯৮টি ও বাচ্চা ২১টি।

বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে প্রাণী ও বাঘ বিশেষজ্ঞরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে একদিকে বন ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ধ্বংস হওয়া এলাকায় নতুন বসতি গড়ে উঠছে। এতে বনের ওপর নিভর্রশীল মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। আর এ কারণে বাঘের স্বাভাবিক চলাচলের স্থান ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। আবার, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সাইক্লোন, লবণাক্ত পানির প্রবেশ প্রভৃতি কারণে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব ঘটণার পেছনেও দায়ী হিসেবে বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছেন জলবায়ু পরিবর্তনকেই।

সুন্দরবনের বাঘ কমে যাওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ, শিকারীদের দৌরাত্ম। আন্তর্জাতিক বাজারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়ার চড়া মূল্য থাকায় এখন বাঘ শিকারী ও পাচারকারীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে সুন্দরবনের বাঘ। শিকারিরা জেলে সেজে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে বনে যায়। এরপর খাদ্যে বিষ মিশিয়ে, ফাঁদ পেতে এমনকি বন্দুক দিয়ে গুলি করে বাঘ হত্যা করে। হত্যার পর স্থানীয় পদ্ধতিতে বাঘের চামড়া সংরক্ষণ করে। পরে তা পাচারকারী চক্রের সাহায্যে বিদেশে পাচার করে।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণের খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বশির আল মামুন জানান, বন বিভাগের হাতে থাকা তথ্য মতে, এই অঞ্চলে ছয়টি শিকারী দল বাঘ হত্যায় তৎপর রয়েছে। ১৯৮০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চোরা শিকারী ও বনদস্যুদের হামলা, গ্রামবাসীর পিটুনি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে সুন্দরবনের ৭০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে।

বাঘ বিলুপ্তির ‘তৃতীয়’ কারণ হিসেবে সরকারের অবস্থানকেই সবচেয়ে বেশি দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বাঘ রক্ষায় সরকার ইতিমধ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন সংশোধন করেছে। এতে বাঘ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি ১২ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। বন্যপ্রাণীর আক্রমণে মানুষ নিহত হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে জনপ্রতি এক লাখ টাকা এবং আহত হলে জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু এই আইন বাস্তবায়নে যথেষ্ট অনিয়ম রয়েছে বলে ব্যাপক অভিযোগ আছে।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সরকারের সঠিক পরিকল্পনার অভাবে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া দূরের কথা উল্টো আশঙ্কাজনক হারে কমেছে।

বন বিভাগের মাধ্যমে সরকার বাংলাদেশ টাইগার অ্যাকশান প্ল্যান (২০০৯-২০১৭) অনুসরণ করে বাঘ রক্ষায় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এছাড়া ২০১৫ সাল থেকে ১২ মিলিয়ন ডলারের চার বছর মেয়াদী ‘বাঘ’ প্রজেক্টের কাজ শুরু করেছে। এই প্রজেক্টটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে বাঘ রক্ষায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

কিন্তু খুলনা বিভাগীয় বন বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম গোপন রেখে জানিয়েছেন, এই দুটো প্রকল্পেই যথেষ্ট অনিয়ম রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে তা তদারকি করা হচ্ছে না। কাগজে কলমে কর্মসূচির অগ্রগতি থাকলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। আর সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার সংরক্ষণে ২০০০ সালে ‘টাইগার প্রজেক্ট সুন্দরবন’ প্রকল্পের প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু তা আর আলোর মুখ দেখেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘বাঘ সংরক্ষণে সরকারের পাশাপাশি আমাদেরকেও ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। ইতিমধ্যে এ লক্ষ্যে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে শুধু উদ্যোগ নয়, এসব বাস্তবায়ন করতে হবে।

ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশের এই প্রধান নির্বাহী আরো বলেন, ‘সবচেয়ে জরুরী হিসেবে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বাঘ বিশেষজ্ঞ মনিরুল এইচ খান বলেন, ‘বাঘ সুরক্ষায় চাই নির্মল প্রতিবেশ। এ বছর দিবসটির আন্তর্জাতিক প্রতিপাদ্যও এটি। আর নির্মল প্রতিবেশ নিশ্চিত করার মুখ্য দায়িত্ব সরকারের। পাশাপাশি জনগণের সম্পৃক্ততা জরুরী।’

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক ড. তপন কুমার দে বলেন, ‘বাঘ আমাদের জাতীয় প্রাণী ও বীরত্বের প্রতীক। বাঘ সংরক্ষণে আমাদের আরো আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন।’

তিনি আরো বলেন, ‘বাঘ সুরক্ষায় ২০১৮ সাল থেকে ১০ বছরের জন্য ‘বাংলাদেশ টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান’ নামে দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে। বাঘের হুমকি ও চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি বাঘ রক্ষার নানা পদক্ষেপ এই কর্মপরিকল্পনায় থাকবে। আশা করছি তখন পরিস্থিতির বদল হবে।’

(ওএস/এসপি/জুলাই ৩০, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test