E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সামনে যাওয়ার আগে

২০১৪ এপ্রিল ২৩ ১০:৫৮:৩৬
সামনে যাওয়ার আগে

অহনা মণ্ডল

'মিষ্টি, আয় স্নান করে নে৷'

'হ্যাঁ, মা আসছি৷'

বলেই পাঁচ বছরের মিষ্টি বাথরুমের দিকে ছুটলো৷ বাথরুমের মধ্যে যেতেই দুটো হাত ওকে ধরে একটা কাচের পাতের উপর দাঁড় করিয়ে দিলো৷ তারপর আবার সেই দুটো হাতই ওর গায়ে হাতে পায়ে সাবান মাখিয়ে দিয়ে স্নান করিয়ে দিলো৷ তারপর গা মুছিয়ে জামা কাপড় পরিয়ে বাথরুমের বাইরে নিলে এলো৷ সেখান থেকে কিছুটা হেঁটে পড়ার টেবিলে বসতেই যেন হাঁপ লেগে গেলো মিষ্টির৷ পা-গুলো টনটন করে উঠলো৷

তাই মা'কে মিষ্টি বলল, 'কত করে বলি, যে নতুন গাড়িগুলো বেরিয়েছে সেটা কিনে দাও৷ তা না৷ আমি কি এতটা হাঁটতে পারি?'

এখন এক ধরনের গাড়ি বেরিয়েছে যেগুলো খুব কম দূরত্ব যাওয়া আসার জন্য তৈরি হয়েছে৷ মা ছুটে এলো রান্নাঘর থেকে হাঁপাতে-হাঁপাতে৷

'কথাটা কম বলে একটু পড়াশোনায় মন দাও৷ কিনে দেওয়া হবে যখন বলা হয়েছে, তখন নিশ্চই দেওয়া হবে৷' বলে আবার হাঁপাতে-হাঁপাতে রান্নাঘরে চলে গেলেন৷
মা চলে গেলে মিষ্টি সামনে থাকা লেন্সের উপরে হাত রেখে 'বই' বলতেই সব বই ওর টেবিলের উপর হাজির৷ তারপর আবার সেই লেন্সে হাত রেখে 'সায়েন্স' বলতে বিজ্ঞানের বই খুলে গেল৷ এইভাবে ইংরাজি বললে ইংরাজি, বাংলা বললে বাংলা বই হাজির হয়ে যায়৷

মিষ্টির বাবা সুজয় বোস একজন বিজ্ঞানী৷ সম্প্রতি ইউরেনাস টু নামে একটি গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে৷ মিষ্টির বাবা সেখানে গিয়েছে একটি প্রজেক্টের কাজে৷ এখন বিভিন্ন গ্রহে কৃত্রিমভাবে বায়ু আর জল তৈরি করে সেখানে শহর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ এবং পৃথিবী থেকে প্রচুর মানুষ সেখানে বসবাসের জন্য পাঠানো হয়েছে৷

মিষ্টি হোমওয়ার্ক করার জন্য চোখের সামনে একটা সেন্সর বসিয়ে নিল৷ এবার বইয়ের উপর চোখ রাখলেই লেখাগুলো মেমোরিতে লোড হয়ে যাচ্ছে৷ ফলে মানুষকে এখন পড়ার জন্যও খাটতে হচ্ছে না৷ এখন মানুষের বেশিরভাগ কাজই করে দিচ্ছে যন্ত্র৷ যেমন মানুষের বিছানা তুলে দেওয়া, ঘর গুছিয়ে দেওয়া৷ তারপর, মানুষের কোনও জিনিস হয়তো লাগবে, যেটা অন্য জায়গাটায় রাখা আছে, সেটাও মানুষ রোবটকে দিয়ে আনিয়ে নেয়৷ সিনেমা হলে বড়সড় ক্যাপসুলের মতো অসংখ্য জিনিস থাকে৷ সেগুলোতে বসে মানুষ হলে গিয়ে ঘুরে-ঘুরে সিনেমা দেখে৷ তাতে ভিতর থেকে বাইরে, বাইরে থেকে ভিতরে সব কিছু দেখা যায়৷ যাকে বলে পুরোপুরি থ্রিডি৷ কলকারখানার কর্মীরাও রোবোট হয়ে গিয়েছে৷ আগে অন্য জায়গায় থেকে রোবোট দিয়ে অপারেশন করিয়ে নিত ডাক্তার৷ মানে রিমোট কনট্রোল দরকার পড়ত৷ এখন ডাক্তারদের আর কিছু করতেই হয়না৷ রোবোট নিজেরাই অপারেশন করে দেয়৷

মিষ্টির কাছে ইতিমধ্যে তার প্রিয় গাড়ি চলে এসেছে৷ ফলে এখন ওকে আর ওর মাকে আর একটুও হাঁটতে হয়না৷ এখন মানুষ একতলা থেকে দুতলা যেতে হলেও লিফটে চড়ে যায়৷ ফুটপাতে আর মানুষকে হাঁটতে দেখাই যায় না৷ সবাই ছোটো ছোটো মিনি গাড়িতে যাতায়ত করে৷ পরিস্থিতি এমন, মিষ্টি গাড়িতে ওঠা নামার শক্তিও হারিয়ে ফেলতে লাগল৷ মিষ্টির মতো সবারই একই অবস্থা৷ ফলে সেই গাড়িগুলির সঙ্গে এমন একটা যন্ত্র লাগানো হলো যা মানুষকে গাড়িতে উঠিয়ে দেবে, বসিয়েও দেবে৷ আর কোনও কাজ না করতে-করতে মানুষ একেবারে অকোজো হতে থাকলো, এবং আয়ুও কমতে থাকলো৷

মিষ্টির মা আর মিষ্টি একদিন শুয়ে আছে৷ মিষ্টির বয়স এখন ১২ বছর৷ ওর বাবা কয়েকদিন ধরে গবেষনার কাজে বাড়ির বাইরে আছেন৷ কাল ফেরার কথা৷

'আচ্ছা মা, বিজ্ঞানের এখন কত অগ্রগতি? এখন তো আর আমাদের একটুও হাঁটতে হয় না৷ আর আগে তো ৬-৭ ফুট হাঁটতে হতো৷'

'কিন্ত্ত তুমি কি জানো, আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর আগে মানুষ ২-৩ কিলোমিটার অনায়াসে হাঁটতে পারতো?'

'কী, দু-তিন কিমি! এটা কীভাবে সম্ভব?'

'হ্যাঁ, আর চার পাঁচ তলা পর্যন্ত সিড়ি বেয়ে উঠতো৷ আর আগেকার বাচ্চারা একসঙ্গে খেলতো, দৌড়াতো৷'

মিষ্টি ঘুম চোখে ভাবতে লাগলো, 'আগে বাচ্চারা কতো লাফালাফি করত, খেলা করত৷ আর আমাদের খেলা কম্পিউটারেই শেষ!'

পরের দিন সকালে বাবা বাড়ি ফিরলেন৷ কিন্ত্ত বাবা এলেন হেঁটে হেঁটে৷ আর হাঁটতে গিয়ে হাঁপিয়ে গিয়েছেন৷ পা ফুলে লাল হয়ে গিয়েছে৷

মা বলল, 'কী হলো, তুমি গাড়িতে করে না এসে হেঁটে আসলে কেন?'

'সব বলছি তুমি আগে আমাকে একটু জল দাও৷'

মা সেই গাড়িতে করে রান্নাঘরে গিয়ে বাবার জন্য জল নিয়ে আসল৷

'নাও, এবার বলো৷'

'আগে মিষ্টিকে ডাকো৷'

মা গেলো মিষ্টিকে ডাকতে৷ মিষ্টি এলো৷

'আমাদের আয়ু ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে কেন, তাই নিয়ে গবেষনা করছিলাম৷ সেই গবেষনায় দেখা যাছে যে আগেকার মানুষ যারা বেশি হাঁটাচলা করত, বেশি স্বনির্ভর থাকত তারা বেশিদিন বাঁচত৷ আজ আমরা এতটাই যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়েছি, যে আমাদের আয়ুও দিন দিন কমে যাচ্ছে৷ আমাদেরও আস্তে আস্তে এইসব যন্ত্রের উপর নির্ভর করে থাকা ছেড়ে দিতে হবে৷ স্বনির্ভর হতে হবে৷ মানে হাঁটাচলা করা, কাজ করা অভ্যাস করতে হবে৷ প্রথম প্রথম একটু অসুবিধাতো হবেই৷ কিন্তু আস্তে-আস্তে হাঁটার দূরত্ব ও ক্ষমতা দুটোই বাড়তে থাকবে৷'

'কিন্ত্ত বাবা আমরা পারব কী করে?'

'কেন? মানুষের পক্ষে কোনটা অসম্ভব!'

এরপর থেকে বাবা রোজ ওকে ধরে ধরে হাঁটা শেখায়৷ মিষ্টির মাও এখন হাঁটা প্র্যাকটিস করে৷ যেন শিশুরা নতুন হাঁটা শিখছে৷ মিষ্টিরা একটা সংগঠন তৈরি করে সবাইকে বোঝাচ্ছে৷ তার আশা, পাঁচ-ছ বছরের মধ্যে আবার ফুটপাথে লোক হাঁটতে শুরু করবে৷ মানুষ স্বনির্ভর হবে৷ বাচ্চারা একটু আধটু খেলতেও শুরু করবে৷

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test