E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ভৌতিক নম্বর ৩৩৯

২০১৫ জুন ২৫ ১৩:১৪:৩২
ভৌতিক নম্বর ৩৩৯

আনিসুর রহমান আলিফ : আষাঢ় মাস। বৃষ্টি নামার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। ক্ষাণিক আগেই এক পশলা নেমে এখন বুঝি একটু বিশ্রাম করে নিচ্ছে। একটু বাদে যে আবার নামবে না তার কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।

নিয়মিত পানি পড়ার ফলে পথ-ঘাট একেবারে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেছে। এমন দিনে খুব বেশি বিপদে না পড়লে ঘর থেকে কেউ বের হয় না। আগামীকাল আমার একটা ইন্টারভিউ আছে। ঢাকায় গিয়ে ইন্টারভিউ দিতে হবে। একটি কর্পোরেট অফিসে এক্সিকিউটিভ পদে চাকরি। মাস্টার্স শেষ করে বাড়ি বসে আছি প্রায় এক বছর হলো। তাই মা-বাবার মুখের দিকে তাকালে আষাঢ়-শ্রাবণ কোনোটাকেই এখন আর কোনোকিছু মনে হয় না।

রাত দশটায় ট্রেন। সিলেট থেকে ঢাকা। প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে সেই সাড়ে আটটা থেকে অপেক্ষা করছি। ঘড়ির কাটা আলসে ভঙ্গিতে সময় দেখাচ্ছে রাত নয়টা ত্রিশ। প্লাটফর্মের ঐ পাশে একটি মালগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রিবাহী ট্রেনের কোনো খবর নেই। বর্তমানে ট্রেনের সিডিউলের যা অবস্থা তাতে নয়টার ট্রেন দশটা-এগারোটায় ছাড়বে এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে। সময় মতো ট্রেন এলেই যেন বিরক্তি লাগে। এইসব যখন ভাবছিলাম তখন দূর হতে ট্রেনের শক্তিশালী সার্চ লাইটের সরু আলো দেখতে পেলাম। চাতক দৃষ্টিতে এতক্ষণ যারা প্লাটফর্মে অপেক্ষায় রত ছিলো আলোটা দেখা মাত্রই তাদের মধ্যে যেন প্রাণের সঞ্চার শুরু হলো। তন্দ্রাচ্ছন্ন প্লাটফর্মটা এবার যেন নড়েচড়ে উঠতে শুরু করেছে।

ক্ষাণিক বাদেই পম-পম শিস বাজিয়ে ঝম-ঝম শব্দে আন্তঃনগর এক্সপ্রেস প্লাটফর্মে এসে থামলো। শেষ স্টেশন, তাই যাত্রী খুব বেশি কেউ নেই। যাত্রীদের নামা শেষ হলে সাইড ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে প্রথম শ্রেণির কামরায় উঠলাম। কাল পরীক্ষা, ট্রেনে বসে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের পাতাগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখবো ভেবে প্রথম শ্রেণির টিকিট আগে থেকেই কেটে রেখেছিলাম। কামরায় উঠে দেখলাম কোথাও কেউ নেই। জানি ট্রেন ছাড়তে আরো মিনিট ত্রিশ সময় লাগবে। শেষ স্টেশনে এলে ট্রেনগুলির একটু আধটু যত্নআত্তি হয়।

ইঞ্জিনগুলোকে ঘুরিয়ে সামনে আনতে হয়, তেল মবিল দিয়ে ইঞ্জিনটাকে আরো একবার লম্বা সফরের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এর মধ্যে দু’এক জন যাত্রী আমার কামরায় উঠবে এই আশায় বসে রইলাম। দুর্যোগের এই রাতে একটা আস্ত কামরায় আমি একা যাত্রী! ভাবতেই কেমন যেন একটা গা ছমছমে ভাব জাগছিলো। আষাঢ় মাসের গরমটা কিন্তু বেশ বিরক্তিকর। চারিদিকে কেমন যেন ভ্যাপসা একটা গরম। প্রথম শ্রেণির কামরা, তাই ফ্যান মাথার উপরে ঘুরছে ঠিকই কিন্তু বাতাসটা এখনও ভারি হয়ে আছে। একটু স্বস্তির আশায় জানালাটা খুলে দিলাম, দেখলাম বৃষ্টি আবার শুরু হয়েছে। ঝিরি-ঝিরি অবিরাম বৃষ্টি। ক্ষাণিক বাদে পম-পম শব্দে কয়েকবার শিস দেওয়ার পরেই গার্ডের বাঁশির শব্দ শুনলাম। ছোট্ট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটা চলতে শুরু করলো।

বাস অথবা ট্রেন যেটাই হোক যাত্রী বেশি হলেই মানুষ বিরক্ত হয়। অন্যদিকে সম্পূর্ণ খালি কামরাও যে মহা-বিরক্তির একটা বিষয় হতে পারে একলা কামরায় বসে সেটা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলাম। মনে মনে ভাবলাম এমন আষাঢ় মাসে আমার মতো আর কার এতো দায় পড়েছে। যা হোক, মাঝে মাঝেই ট্রেনটি দম দিয়ে বড়-বড় স্টেশনে এসে থামছিলো আর আমারই মতো দু’চার জন করে যাত্রী তাদের নির্ধারিত কামরায় উঠে পড়ছিলো। কুলাউড়া স্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় বারোটা।

হঠাৎ দেখলাম দরজা ঠেলে চাঁদর গায়ে একজন লোক আমার কামরায় উঠলো। আষাঢ় মাসের এমন ভ্যাপসা গরমে কেউ যে গায়ে চাদর জড়াতে পারে ভাবতেই নিজের মধ্যে কেমন একটা অস্থির ভাব হচ্ছিলো। লোকটি কামরার চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে আমার সামনের সিটে এসে বসে পড়লো। খেয়াল করলাম লোকটি মোটা চাদরে তার গোটা শরীর ছাপিয়ে মুখ অবধি ঢেকে রেখেছে। মধ্য রাতের ট্রেনে এমন বেশে কাউকে আশা করিনি। মনের মধ্যে তাই কেমন যেন ভয় হচ্ছিলো আমার। চোর ডাকাত নয় তো? কথাটা মনে হতেই আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। কামরায় জ্বলে থাকা লাইটের আলোয় তার চেহারাটা একবার দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু লোকটি চাদর দিয়ে তার মুখটা এমন ভাবে ঢেকে রেখেছে যে, চেহারাটা কোনোভাবেই দেখা যাচ্ছে না। খুবই সন্দেহজনক। এই গরমে গায়ে চাদর জড়িয়ে রাখার মানে কী? চাদরের নিচে অস্ত্র-টস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে নাকি? শুনেছি ট্রেনে নাকি বিভিন্ন ধরনের উৎপাত হয়। চোর-ডাকাত, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, আরো কতো কী। আমার কাছে অবশ্য তেমন কিছু নেই। পকেটে হাজার দুয়েক টাকা আর ব্যাগে সার্টিফিকেট, শার্ট-প্যান্ট। লোকটি সেই কখন এসে বসেছে অথচ একটা কথাও বলেনি।

মাঝে মাঝেই কী এক কারণে শুধু পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে। যা হোক আমি শক্ত হয়েই বসে আছি। নিশি রাতের ট্রেন ঝম-ঝম ঝম-ঝম শব্দে মাঠ-ঘাট পেরিয়ে ছুটে চলেছে। ট্রেনের মধ্যে বসে বৃষ্টির শব্দ শোনা যায় না, তবে বিদ্যুতের আলো মাঝে মাঝেই জানালার কাঁচ ভেদ করে আমাদের কামরার ভেতরে এসে পড়ছিলো। লোকটি ক্ষাণিক বাদে বাদেই সতর্ক ভাবে পেছন ফিরে দেখছিলো। লোকটির হাব-ভাব আমার কাছে ভালো ঠেকছিলো না।

ভাবলাম সামনের স্টেশন এলে এই কামরা থেকে অন্য কামরায় চলে যাবো। হঠাৎ কী হলো জানি না, কামরার সবগুলো আলো একসঙ্গে বন্ধ হয়ে গেলো। লোকটি ভয়ার্ত এক চিৎকার করে আমার কোলের উপর এসে পড়লো। আকস্মিক এমন পরিস্থিতিতে ভয়ে আমিও চিৎকার করে উঠলাম। কামরার মধ্যে ঘন অন্ধকার, কোনো কিছুই দেখা যায় না। বিদ্যুতের চমকে ওঠা আলো মাঝে মাঝে কামরার মধ্যে পড়ে জায়গাটাকে আরো ভয়ার্ত করে তুলছিলো। ছাড়ুন ছাড়ুন বলে ধাক্কা দিয়ে লোকটিকে আমার থেকে সরাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে আমাকে জাপটে ধরেই থাকলো। কামরার আলোগুলো হঠাৎ করে যেমন বন্ধ হয়েছিলো তেমন হঠাৎ-ই আবার জ্বলে উঠলো। লোকটি এবার আমাকে ছেড়ে তার চেয়ারে গিয়ে বসলো।

এদিকে প্রচণ্ড ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। লোকটিকে দেখলাম সন্ধানী চোখ মেলে চারিদিকটা দেখছে। সাইকো খুনি নাকি? এর হাবভাব দেখে তো মনে হয় খুন করতেই সে ট্রেনে উঠেছে। ভয়ে আমার শরীর কাঁপছিলো। খেয়াল করলাম, লোকটিও আমার মতো ঠকঠক করে কাঁপছে। আমার মতো লোকটিও ভয় পেয়েছে নাকি? নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে একটু পানি মুখে ঢেলে দিতেই শরীরে স্বস্তি এলো। লোকটিকে দেখলাম আমার পানির বোতলটির দিকে তাকিয়ে আছে।

এবার তার চোখ দু’টো ভালো করে দেখলাম। তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ঐ চোখে কোনো হিংস্রতা, ধূর্ততা বা কোনো বদ মতলব নেই। ঘোলাটে চোখে কেবলই ভয়ের একটা মোটা প্রলেপ আঁকা। পানির বোতলটা তার দিকে বাড়িয়ে ধরতেই সে এক ঝটকায় আমার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে পান করতে শুরু করলো। এদিকে ট্রেনের গতি ধীরে ধীরে কমে আসছে, বুঝলাম সামনে কোনো স্টেশন আছে। ট্রেন থামলো। জানালা খুলে দিলাম। বৃষ্টি তখনও পড়ছে। আমার জানালা খোলা দেখে চায়ের ফ্লাক্স হাতে একটি ছেলে এগিয়ে এলো।
-চা গরম, চা গরম।
-চা দেবো চা, একেবারে গরম চা।
আমি খেয়াল করেছি স্টেশনের চা বেশির ভাগ সময়েই ঠাণ্ডা থাকে। ঠাণ্ডা চা আমার ভালো লাগে না। কিন্তু এমন একটি অবস্থায় চা ঠাণ্ডা অথবা গরম যাই হোক, চা হলেই হলো। একা একা লোকটির সামনে বসে চা খাওয়াটা ঠিক হবে কি? এই ভেবে লোকটির দিকে তাকিয়ে বললাম,
-চা খাবেন?
-লোকটি হালকা ভাবে মাথাটা নাড়লো। এটি ‘হ্যাঁ সূচক’ মাথা নাড়া। চা বিক্রেতার হাত থেকে চায়ের কাপ দু’টে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-ট্রেন এখানে কতক্ষণ থামবে? সে বললো,
-মিনিট পাঁচেক।
বৃষ্টির ছাঁট ভেতরে এসে পড়ায় জানালাটা বন্ধ করলাম। কামরায় এখনও আমরা দু’জন মাত্র প্রাণী। লোকটিকে দেখলাম এক হাতে চায়ের কাপ ধরে অপর হাতে মাথার উপর থাকা ঘোমটার মতো চাদরটি গলা পর্যন্ত নামিয়ে দিলো। এবার তাকে ভালো ভাবে দেখতে পেলাম। বয়স পঁয়তাল্লিশের মতো হবে। মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। বড়-বড় দু’টো চোখ লাল হয়ে বিকট ভাবে ফুলে আছে। ভাব দেখে মনে হয় যেকোনো সময় কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। চা খাওয়া শেষ হলে চা বিক্রেতা কাপগুলো নিয়ে গেলো। ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে। মনে মনে ভাবলাম, লোকটি কোথায় নামবে কে জানে? পরিচয় হলে ভালো হয়। আমি একটু আতু-মাতু করে বললাম,
-আমার নাম নাবেদ। ঢাকায় যাচ্ছি। কাল একটা ইন্টারভিউ আছে। আপনি কোথায় যাবেন?
লোকটি আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে বললো,
-বাড়ি যাবো। আমি বললাম,
-কী করা হয়?
লোকটি ক্ষাণিক নিরব থেকে বললো,
-টি-এস্টেটের ম্যানেজার।
মনে মনে ভাবলাম, টি-এস্টেটের ম্যানেজার! সেতো বিরাট ব্যাপার। কিন্তু তাকে দেখেতো তা মনে হয় না। ব্যাপার কী জানতে বললাম,
-তখন ওভাবে আমার উপর পড়ে গেলেন কেন? জানেন আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
লোকটি আবার ক্ষাণিকক্ষণ নিরব থেকে বললো,
-লম্বা কাহিনী।
আমি বললাম,
-ট্রেন সারারাত চলবে, কাহিনী লম্বা হলে ক্ষতি নেই।
লোকটি একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো,
-আমার নাম বীরেন, বীরেন মণ্ডল। গত তিন মাস হলো মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় একটি টি-এস্টেটে ম্যানেজারের দায়িত্ব পেয়ে আসি। প্রথম যখন সেখানে যাই তখন চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মনটা একেবারে ভরে উঠেছিলো। সীমান্তবর্তী এলাকা, চারিদিকে ছোট-ছোট টিলা, টিলার উপর চায়ের বাগান। কয়েকটি চা বাগানের মাঝখানে টিলার কোল ঘেসে একটু সমতলে আমার বাংলো। মেন্টা নামের এক উপজাতি চাকর আমার দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলো। মেন্টা আধো বাংলা আধো উপজাতি ভাষা মিশিয়ে কথা বলে। তার আধো বাংলা আধো উপজাতীয় ভাষা বেশ উপভোগ করছিলাম। প্রথম দিনেই মেন্টা বাগান সহ চারিদিকটা আমাকে ঘুরে দেখালো। যারা চা বাগান পরিচর্যার দায়িত্বে ছিলো তাদের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিলো। আমাদের বাগানের একেবারে শেষ প্রান্তে দেখলাম কাঁটা তারের বেড়া। বেড়া দেখিয়ে মেন্টা বললো,
-বাবু, বেড়ার উ পাছেই ইন্ডিয়া। কুখোনো বেড়ার খুব কাছে যাবেক লাই। কাছে গেলে উ পাছ থেকে গোলি চালাই দে। খুব ছাবধান বাবু, খুব ছাবধান।

এখানে এসেছি প্রায় পনেরো দিন হয়ে গেছে। টি-এস্টেটের ম্যানেজারের দায়িত্ব কম নয়। সারাদিন ধরে কাজ করতে হয়। প্রতিটি বাগান, বাগানে চায়ের পাতা, শুকনো পাতা, পরিচর্যার লোকজন সহ বিপুল বিষয় তদারক করতে হয়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এলাকাটা ঘুরে-ঘুরে দেখি। এই ক’দিনে বুঝেছি জায়গাটা যেমন সুন্দর তেমন দুর্গম। সর্বত্রই কেবল উঁচু-নিচু টিলা আর পাহাড়। টিলা আর পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে আঁকা-বাঁকা রাস্তা মাড়িয়ে দোকান বা বাজারে যাওয়া আসা করতে হয়। এখানে মোবাইল ফোনে নেটওয়ার্ক পায় না। বাংলোয় একটা টেলিফোন আছে সেটা দিয়েই কাজ চালাতে হয়। মাস দুই কাটার পরে এখানে বর্ষা নামলো। বর্ষার সময় টিলা আর পাহারের মধ্যে দিয়ে চলা আঁকা-বাঁকা পথ ভীষণ পিচ্ছিল হয়ে পড়ে। চলাচলের অভ্যাস না থাকলে রীতিমতো মুশকিলে পড়তে হয়। মেন্টা প্রায় সব সময় আমার সাথে সাথেই থাকে কিন্তু একদিন তাকে বাজারে পাঠিয়েছিলাম বলে একাই বাগান থেকে বাংলোয় ফিরছিলাম। এইসব এলাকায় সন্ধ্যাটা নামে খুব দ্রুত। সন্ধ্যার পরেই চারদিকটা গভীর রাতের মতো অন্ধকার হয়ে যায়। আমার হাতে কোনো লণ্ঠন নেই তাই একটু দ্রুত হাঁটছিলাম। হঠাৎ দেখলাম, দুর থেকে কে যেন একটা লণ্ঠন হাতে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। কাছে আসতে বুঝলাম, ওটা মেন্টা। আমাকে দেখে মেন্টা বললো,
-বাবু, তোকে না কহেছি, ছন্ধার পরে ইধার বাহার থাকবেক লাই। ছন্ধার পরে ইধার বাহার ভালো না বাবু। চল জলদি বাংলো ফিরে চল।
হাঁটতে হাঁটতে তাকে বললাম,
-কেন বলোতো? মেন্টা বললো,
-উ তুই বুঝবি না বাবু।
-কেন বুঝবো না? তুমি বলো, আমি বুঝবো।
-বাবু আগে বাংলো ফিরে চল তারপর ছব বুলবো।
বাংলোয় ফিরে হাত মুখ ধুয়ে বসার ঘরে বসেছি। ক্ষাণিক বাদে মেন্টা আমার জন্য চা করে আনলো। গরম টাটকা চায়ে মুখ দিয়ে বললাম,
এবার বলো দেখি, কেন সন্ধ্যার পরে বাইরে থাকা যাবে না। মেন্টা বললো,
- বাবু, ইধার ছন্ধার পরে এক মুছিবত আছে। আমি বলাম,
- কী মুছিবত? মেন্টা বললো,
-লম্বর দিখা যায়।
-মানে, কীসের নম্বর?
-তা জানিনা বাবু, ও উনেক বাবু তো ঐ লম্বর দেখে ভয় পেয়ে মরে গেল।
-মানে!
-হ্যাঁ বাবু। শুনেছি ছাদা ছাহেবদের আমোলে এখানে একটা ঘটনা ঘটেছিলো। উ তার পর থেকেই এ ছব হইছে বাবু।
-কী ঘটনা? তুমি জানো কিছু?
-ছুনেছি ছাদা ছাহেব খুব বদরাগী আদমি থে। একদিন উ ছাহেব রাগ করিয়ে উপজাতি এক গার্ডের পেটে ছুরি চালাই দিলে। উ উপজাতি গার্ড তো তক্ষুণি মরে গেলো। ছাদা ছাহেব লাশ গুম করার জন্যে উ গার্ডের লাছ কো বাগানের উ ধারে মাটি চাপাই দিলো। এর পর থেকেই বাগানে উ লম্বর দিখা ছুরু হলো। কেউ কেউ বলে উ নম্বর নাকি উ গার্ডের গার্ড নম্বর। ছাবধান বাবু, খুব ছাবধান।
-তুমি দেখেছ কখনো?
-না বাবু, আমি কখনও উ নম্বর দেখি লাই। অনেকে দেখেছে ছুনেছি।

মেন্টার কথা আমার একেবারেই বিশ্বাস হলো না। এ-কদিনে যা দেখেছি তাতে এটুকু বুঝেছি, এখানকার স্থায়ী বাসিন্দারা শিক্ষার আলো থেকে অনেক-অনেক দূরে রয়েছে। গুজব আর কু-সংস্কারই হচ্ছে একানকার একমাত্র শিক্ষা। যা হোক, একদিন বাগানের কাজ শেষ করে বাংলোয় ফিরব এমন সময় শুরু হলো প্রচন্ড বৃষ্টি। এসব পাহাড়ি এলাকার বৃষ্টি বড় বিপদের জিনিস। এই বৃষ্টির ভাব বোঝা যায় না। একবার যদি গো ধরে বসে তাহলে সারা রাত নামবে। সেই বিকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, এখন রাত প্রায় দশটা। বাগানের পাশে একটি গোলপাতার ছাউনির নিচে বসে আছি। আমার সাথে বাগান পরিচর্যাকারী দুটি মেয়ে ও একটি ছেলে রয়েছে। অবস্থা খুবই বেগতিক দেখে উপজাতীয় ভাষায় ছেলেটি মেয়ে দু’টিকে কী যেন বললো, মেয়ে দু’টি একবার আমার দিকে তাকিয়ে ‘যাইছে বাবু’ বলে চলে গেলো। ছাউনির নিচে এবার আমি আর পরিচর্যাকারী ছেলেটা। রাত যখন ১২ টা বাজলো তখন বৃষ্টিটা একটু যেন কমলো মনে হলো। ছাউনিতে থাকা লণ্ঠনটি নিয়ে আমরা বাংলোর দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। ছাউনি থেকে বাংলো বেশি দূরের পথ নয় কিন্তু আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু পথ বৃষ্টিতে পিচ্ছিল হয়ে পড়ায় আমাদের হাঁটতে খুবই কষ্ট হচ্ছিলো। এরকম অঞ্চলে গভীর রাত খুবই ভয়ঙ্কর। পথের দুই ধারের চায়ের বাগানগুলো দুই পাশ থেকে যেন আমাদেরকে চেপে ধরতে চাইছে। চারদিকে ঘন অন্ধকার আর কেমন যেন গা ছমছমে হাওয়া। পরিচর্যাকারী ছেলেটির হাতে লণ্ঠন। সে আমার একটু সামনেই হাঁটছে। অন্ধকারের ঘনত্ব এতটাই বেশি যে, লন্ঠনের আলো একটু সামনে যেয়েই হোঁচট খেয়ে পড়ছিলো। ক্ষাণিক এভাবে হাঁটার পরে হঠাৎ পাশের বাগানের মধ্যে কেমন যেন নীলাভ একটা আলো দেখতে পেলাম। আমি ছেলেটাকে বললাম,
-ওটা কী! সে ভয় পাওয়া গলায় বললো,
-ইধার উধার মাত দেখিয়ে বাবু। জলদি বাংলো চল।
-জোর পায়ে হাঁটছি। বৃষ্টি পরবর্তী মধ্য রাতের পাহাড়ি অঞ্চল যে কতটা আবছায় আর ভয়াবহ তা যে না দেখছে তার পক্ষে বোঝা শক্ত। বাংলোর প্রায় কাছে চলে এসেছি, হঠাৎ সেই আলোটা আবার দেখলাম। এবার কিন্তু আলোটাকে যেন চলতে দেখলাম। পাশের বাগানের চা গাছগুলোর মধ্য কেমন একটা পট-পট শব্দ শুনলাম। বুঝলাম কিছু একটা চা গাছগুলোকে ভেঙ্গে চুড়ে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। হঠাৎ অন্ধকারে নীলাভ আলোর কুন্ডুলির মতো কিছু একটা বাগানের এ পাশ থেকে রাস্তা পেরিয়ে ও পাশে ছুটে চলে গেলো। আমি থমকে দাঁড়ালাম। সাথে থাকা ছেলেটা বললো,
-জলদি চল বাবু, জলদি চল।
-আমরা হাঁটার জোর বাড়িয়ে এবার দৌড়াতে শুরু করলাম। পথ পিচ্ছিল হওয়ায় আমাদের চলাটা আগাচ্ছিলো না। একবার পেছন ফিরে চাইলাম, দেখলাম নীলাভ আলোয় ধোয়ার মতো কিছু একটা আমাদের পিছু নিয়েছে। ভয়ে আমরা দুজনেই আরো জোরে দৌড়াতে থাকলাম। মাঝে মাঝেই পেছন ফিরে দেখছিলাম নীলাভ আলোর ধোয়াটা আছে কি না? দেখলাম সেটা আমার পিছু ছাড়েনি। উঁচু টিলার পথে তাড়াহুড়ো করে চলতে যেয়ে হঠাৎ আমার পা পিছলে গেলো। আমি গড়িয়ে পড়ে গেলাম। গড়াতে গড়াতে নিচের চা বাগানের মধ্যে এসে পড়লাম। হালকা আবছায়া আলোয় দেখলাম, সামনে একটি খুঁটি। খুঁটির উপর তিনটি মাত্র নম্বর। মধ্য রাতের এমন অন্ধকারেও নম্বরগুলো হালকা নীলাভ আলোয় জ্বলছে। তিনটি মাত্র সংখ্যা, তিন তিন নয়। হঠাৎ লক্ষ করলাম সেই পিছু নেওয়া নীলাভ ধোয়াটা খুঁটির কাছে চলে এসেছে। ধীরে ধীরে ধোঁয়াটা একটা আকৃতি নিতে শুরু করেছে। প্রচণ্ড ভয়ে বুকের মধ্যে একবার ধক করে উঠলো। এইটুকুই মনে আছে। জ্ঞান হওয়ার পরে দেখলাম আমি বাংলোয় শুয়ে আছি পাশে মেন্টা। আমার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। প্রচণ্ড শীত করছে দেখে বুঝলাম, আমার জ্বর এসেছে। পরের দিন বিছানা থেকে আর উঠতে পারি নি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে যখন আবার রাত নামলো তখন শুরু হলো উৎপাত। বাংলোর চারিপাশে সেই ছটফটানির শব্দ আর অদ্ভুত বিচিত্র নীলাভ আলো। মেন্টা ঘরের সব দরজা- জানালা বন্ধ করে করে দিলো কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হলো না। প্রতিটি জানালা, প্রতিটি দরজায় এক যোগে কে যেন করাঘাত করে চলছে। প্রচন্ড ভয়ে আমরা দুজন একেবারে চুপসে গেলাম। বিকট একটা শব্দে আমাদের সদর দরজাটা ভেঙ্গে পড়লো। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলো সেই অদ্ভুত আলো। আলোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেই তিনটি নম্বর, তিন তিন নয়। আবার জ্ঞান হারালাম। পর দিন সকালে মেন্টা উপজাতি এক ওঝাকে নিয়ে এলো। ওঝা সারাদিন মন্ত্র জপ করে বাংলোর চারদিকে কী সব পুঁতে রেখে চলে গেলো। আবার সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নামলো। রাত বাড়লো কিন্তু কোনো কিছু হলো না। ভাবলাম হয়তো রেহাই পেয়েছি কিন্তু না রাত নয়টার দিকে আবার সেই ছটফটানির শব্দ! মেন্টা বললো,
-বাবু ভয় পাবি না যেন। ওঝা তার কাজ করে গেছে, ভয়ের আর কিছু লাই।
মেন্টার কথাটা শেষ হতে না হতেই বিকট শব্দে আবার সদর দরজাটা ভেঙ্গে পড়লো। ঘরের মধ্যে থাকা আসবাবগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়তে লাগলো। মেন্টা বললো,
-পালা বাবু পালা।
মেন্টা আর আমি বাংলো থেকে বের হয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম। চা বাগানের রাস্তা আর মাঝে মাঝে বাগানের মধ্যে দিয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটে চলেছি। পেছনে সেই নীলাভ ধোঁয়া। প্রাণ বাঁচাতে আমরা দৌড়াতেই থাকলাম। মাঝে মাঝেই ধোঁয়ার কুন্ডুলিটা আমাদের সাথে পাল্লা করে ধাওয়া করছিলো। ঘণ্টা দুয়েক এভাবে দৌড়ানোর পরে আমরা কুলাউড়া বাজারের মধ্যে এসে পড়লাম। জনবহুল বাজারের মধ্যে এসে ভয়টা একটু কমলো। কিন্তু যেদিকেই তাকাই সেদিকেই যেন ঐ নম্বরটি আমাদের চোখে ধরা দিচ্ছিলো। মেন্টা আমাকে বললো,
-বাবু, তুই এখান থেকে যত দূর পারিস চলে যা। উ নম্বরওয়ালা গার্ড খুব খারাপ আত্মা আছে। ওর হাত থেকে আজ পর্যন্ত কেউ রেহায় পায় নি। জলদি পালা বাবু, জলদি পালা।

মেন্টার কথা শুনে আর দেরি না করে এই ট্রেনে উঠে পড়লাম। তারপর আপনার সাথে এই কামরায়।
ভদ্রলোকের গল্প শুনে তার জন্য মনে খুব মায়া হলো। আমি তাকে অভয় দিয়ে বললাম,
-আশা করি আর কোনো সমস্যা হবে না। আমার কথা শেষ হতে না হতেই বিকট শব্দে কামরার দরজাটা খুলে গেলো। দেখলাম কামরার মধ্যে নীলাভ একটা ধোঁয়া প্রবেশ করেছে। ভয়ে লোকটি আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বুঝলাম ধোঁয়ার মতো বস্তুটা লোকটাকে ধরে টানতে শুরু করেছে। প্রচণ্ড বলশালি সেই ধোঁয়ার কুন্ডুলি লোকটিকে এক ঝটকায় আমার থেকে ছাড়িয়ে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চললো দরজার দিকে। লোকটি এবার দরজার হাতলটা শক্ত করে ধরে রেখেছে কিন্তু না শেষ রক্ষা হলো না আর্তচিৎকার করে লোকটি চলন্ত ট্রেনের দরজার বাইরে পড়ে গেলো। এমন ভয়াবহ অবস্থায় জ্ঞানত থাকা যায় না। আমার জ্ঞান যখন ফিরলো তখন দেখলাম ট্রেন থেমে আছে। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম ভোরের আলো ফুটেছে। ঢাকা পৌঁছে গেছি। ট্রেন থেকে নেমে এলাম। প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে এসে একটি বেঞ্চে বসলাম। দূরে রাতের ট্রেনটি দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষাণিক বাদে ইঞ্জিনটা দেখলাম চলতে শুরু করেছে, বুঝলাম আবার ঘুরবে। আবার রওনা হবে সিলেটের উদ্দেশে। ইঞ্জিনটি যখন আমার খুব কাছে চলে এলো তখন দেখলাম, ইঞ্জিনের সামনে লিখা রয়েছে বি.আর. তিন তিন নয়।

(এলপিবি/এএস/জুন ২৫, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

১১ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test