E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আরিফুন নেছা সুখী’র গল্প

২০১৫ নভেম্বর ০৩ ১৬:২৩:১৭
আরিফুন নেছা সুখী’র গল্প







 

ছেলেবেলার ডায়েরি

ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে খেলায় মেতেছে একদল ছেলেমেয়ে, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেব মেপে, লেবুর পাতায় করমচা যা বৃষ্টি ঝরে যা।’ আজ আর খেলব না রে, মা বকবে—বলেই বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল জেমিমা। বাড়ি পৌঁছে যারপরনাই বকা খেল।

সারা দিন টইটই করে বেড়ানো। আর বৃষ্টিতে ভিজে এ কী অবস্থা করেছ। যাও, পা-হাত ধুয়ে এসো, মাথা মুছিয়ে দিই। মাথা নিচু করে কলতলায় চলল জেমিমা। এদিকে একনাগাড়ে বকেই চলেছেন মা। রাত পর্যন্ত বকার জের চলল। অফিস থেকে বাবা বাড়ি ফিরলে আরেক ফিরিস্তি। বাবা তেমন কিছু বললেন না। জেমিমার দাদি বললেন, থাক না বৌমা, ও ছোট মানুষ, এ তো একটু-আধটু করবেই, তোমরাও করেছ। বড় হয়ে সব ভুলে গেছ।

-থাক মা, আপনি আর ধুয়ো দিয়েন না। আপনার আশকারা পেয়েই ও বেয়াড়া হয়ে গেছে। কোনো কথা গায়ে মাখে না। দেখেন তো, ঋন্তি কখনো বৃষ্টিতে ভিজে কি না। আর ওর বৃষ্টি হলেই মাথা খারাপ হয়ে যায়।

-ঋন্তির মা বৃষ্টিতে ভিজতে দিলে তবেই তো ভিজবে। যা-ই বলো ছোট বৌমা, বড় বৌমার সবকিছুতে একটু বেশি বাড়াবাড়ি। ঋন্তির বাপ ছোটবেলায় যে কী দুরন্ত ছিল, তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। আগে জানলে ভিডিও করে রাখতাম, আর এখন মেয়েটাকে একেবারে গিলে খায়। খাঁচার পাখিও অত পরাধীন হয় না। আবার দেখো, আমার রুবি ছোটবেলায় কত কিছু করেছে, কিন্তু এখন তার মেয়েদের চড়কগাছে তুলে রাখে। তোমরা সবাই যেন কেমন! আমরাও তো ছেলেমেয়ে মানুষ করেছি। এত খ্যাঁচখ্যাঁচ করতে হয়নি।
এসব কথোপকথনের মধ্যে ফোড়ন কাটে জেমিমা, দেখো দাদি, আমি বড় হলে একটুও বদলাব না। আমার ছেলেমেয়েকে পুরো স্বাধীনতা দেব।

-দেখুন মা, আপনার সাত বছরের নাতনি ঘর-সংসারের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে জেমিমারা ঋন্তিদের বাড়িতে বেড়াতে যায়। ও, এখনো তো বলাই হয়নি, কে এই ঋন্তি, ঋন্তি জেমিমার চাচাতো বোন। সেখানে গিয়ে দুই বোনের বেশ ভালো সময় কাটে। একদিন রাস্তায় খেলতে গিয়ে ওরা একটা কুকুরের বাচ্চা দেখতে পেল, তাকে কোলে করে বাড়ি নিয়ে আসে। এতে তো বিশাল হইচই। বেড়াতে এসেছে বলেও রেহাই পেল না জেমিমা। পটাপট বসিয়ে দিলেন ওর মা। জেমিমার বড় চাচা এতে খুব বিরক্ত হলেন, তিনি তাঁর ছোটবেলার গল্প শুরু করলেন। তাঁর দুরন্ত শৈশব ও কৈশোরের গল্প শুনে জেমিমা ও ঋন্তি বেশ মজা পেল।

জেমিমা চাচার গলা জড়িয়ে বলল, তাহলে কি আমরাও বদলে যাব? চাচার নিজেরও অজানা এই প্রশ্নের উত্তর। শুধু টানা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, কী জানি মা, হয়তো হবে, না-হয় হবে না। তবে না হলেই ভালো। চলো, তোমাদের বাইরে থেকে বেড়িয়ে নিয়ে আসি।
বড় চাচার মন খারাপ দেখে জেমিমা তাঁর হাত ধরে বলল, দেখো চাচু, আমি বদলাব না। সারা জীবন এমনই থাকব। আমি তোমাকে কথা দিলাম।

বেড়ানো শেষে স্কুল শুরু হলে ওরা নিজেদের বাড়িতে ফেরে। এক রাতে মা ঘুমিয়ে পড়লে জেমিমা তার বাবাকে বলে, বাবা, তোমাকে একটা কথা বলব, রাখবে? বলো, রাখবে বাবা?
কী কথা, বলো, অবশ্যই রাখব।

-বাবা, তুমি আমার ছোটবেলার ঘটনাগুলো ডায়েরিতে লিখে রাখবে, যেন আমি বড় হয়ে তোমাদের সবার মতো বদলে না যাই। রাখবে বাবা।
-ঠিক আছে, রাখব। পাগলি আমার, বলেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন ওকে।
সত্যি সত্যি জেমিমার বাবা তার সব ঘটনা ডায়েরিতে লিখে রাখেন। আস্তে আস্তে সময় গড়িয়ে যায়, জেমিমা বড় হয়ে যায়। জেমিমার বাবা জেমিমাকে তাঁর লেখা সব ডায়েরি দেন। বাবার লেখা ডায়েরি দেখে সে একটু হতবাক হয়। তবে বাবার মুখে গল্প শুনে শুনে সে সব মনে করে এবং তার মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার দিনগুলোর কথা, মনের অজান্তে গেয়ে ওঠে—‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না...’

কেটে গেল আরও কিছু বছর। আজ ছোট্ট সেই জেমিমার বিয়ে। জেমিমা শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। সেখানে সঙ্গে করে নিয়ে যায় বাবার ডায়েরিগুলো। এরপর কেটে গেল আরও একটি বছর। জেমিমার ঘর আলো করে এল পুত্রসন্তান। সে বড় হয়ে কেমন হবে, এসব ভাবনায় অস্থির জেমিমা। বারবার ডায়েরি পড়ে আর ভাবে, আমার শৈশবের সব স্মৃতি ওকে উপহার দেব। ওর ছেলেবেলা কাটবে স্বাধীন। কোনো বাধা দেব না, শুধু পড়াশোনাটা ঠিকমতো করলেই যথেষ্ট। জেমিমার ছেলে বাপ্পী। সে মোটেই তার মায়ের মতো হয়নি। একদিনের ঘটনা—

আট বছরের বাপ্পী একটি বাচ্চা কুকুরের লেজ কেটে নিয়ে চলে এসেছে। কী বলবে জেমিমা একে। অথচ জেমিমা ছোটবেলায় কুকুর-বিড়ালের বাচ্চাদের কোলে করে নিয়ে ঘুরে বেড়াত, শুধু তা-ই নয়, চুপি চুপি করে খাবারও দিত, আবার সে তার বাবাকে বলত, বাবা, ওকে টাকা দিলে কিনে খেতে পারলে কত ভালো হতো, তাই না। মা জানতে পেত না।
ডায়েরির পাতাগুলো উল্টায় আর বিষণ্নতায় ভোগে সে। তাই বাবাকে চিঠি লিখে—বাবা, আমার বাপ্পী আমার মতো হয়নি। তুমি দেখে যেয়ো।

আবার সে তার বড় চাচাকেও চিঠি লিখে—বড় চাচু, আমি আমার কথা রেখেছি, আমি একটুও বদলায়নি। কিন্তু আমার ছেলে আমার মতো হয়নি। ও বৃষ্টির পানিকে নোংরা বলে, কুকুর-বিড়ালের লেজ কেটে নিয়ে বাসায় ফেরে। আমি কী করব, আমায় তুমি দেখে যেয়ো।
জেমিমার সব স্বপ্ন, আশা বাপ্পী ধূলিসাৎ করে দেয়। একদিন জেমিমার বাবা ও বড় চাচা বেড়াতে এসে খুশি হয় ওর সাজানো সংসার দেখে। অথচ বাপ্পী তার নানাদের সঙ্গে কোনো কথাই বলল না। এতে তাঁরা মর্মাহত হলেন। জেমিমা সব কথা খুলে বলল। বাধ্য হয়ে চিকিৎসক দেখানো হলো বাপ্পীকে। চিকিৎসক জানালেন, ও মাথায় সামান্য চোট পেয়েছিল, পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর বাপ্পী সম্ভবত ওর বাবার মতো হয়েছে। বাপ্পীর বাবার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সত্যিই বাপ্পীর বাবাও ছেলেবেলায় বাপ্পীর মতো ছিলেন।

কয়েক বছর পর জেমিমার ঘর আলো করে জন্ম নিল একটি মেয়ে। নাম রাখল বেবি। বেবির মধ্যে জেমিমা তার ছেলেবেলা খুঁজে পেল। তার মনের মতো করে মেয়েকে মানুষ করার স্বপ্ন দেখা শুরু করল। জেমিমার সারা দিন কাটে মেয়েকে নিয়ে। ওদিকে বাপ্পী আর তার বাবা সারা দিন ব্যস্ত কম্পিউটার নিয়ে, পড়াশোনা নিয়ে। এদিকে জেমিমা ব্যস্ত মেয়ের সঙ্গে খেলাধুলা করায় বা বৃষ্টিতে ভেজা কিংবা কুকুর-বিড়ালের বাচ্চাকে গোসল করানো নিয়ে। আরও কত কি...!

জেমিমা তার বাবা ও চাচাকে তার সুখের কথা জানায়, জেমিমার মতো তাঁরাও খুব খুশি হন এবং তাঁরা জেমিমাকে দেখতে আসেন। সেদিন বিকেলে হঠাৎ বৃষ্টি নামে, তারা চারজন বৃষ্টিতে ভিজতে নামে, চারজন কে কে? জেমিমা, জেমিমার বাবা ও চাচা আর বেবি। ওরা গান গেয়ে গেয়ে মজা করে বৃষ্টিটা উপভোগ করে। তাদের হইচই শুনতে পেয়ে বাইরে আসে বাপ্পী ও তার বাবা। তাদের মজা করা দেখে প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে ওরা ভাবে, চলো না, একটু ভিজে দেখি। এক পা নামাতেই আরেক পা তুলে নেয়, এমন অবস্থা।

এ অবস্থা দেখে জেমিমা এসে ওদের হাত ধরে বৃষ্টিতে নামায়, প্রথমে বিব্রত হলেও পরে বেশ মজা পায় ওরা। কিন্তু বিপদ হলো রাতের বেলা, যখন জ্বর সাহেব ওদের অ্যাটাক করল। কাদের? আবার জিগায়, বাপ্পী ও তার বাবাকে। ওদিকে ওরা চারজন বহাল তবিয়তে আছে। আসলে, ওদের অভ্যাস নেই তো। কী আর করা, প্যারাসিটামল খেয়ে জ্বর বাবাকে তাড়াতে হলো। তারপর থেকে জেমিমা তার ছেলেমেয়েকে নিজের মতো করে পেল। এরপর আর ওদের জ্বর ওঠেনি। আবার জানো, ওদের বাসায় দুটো বিড়ালের বাচ্চা আছে, বাপ্পী ও বেবি দুজনই ওদের খুব আদর করে।

জেমিমা একা একা শুয়ে তার লেখা ডায়েরিটা পড়ছিল, এমন সময় মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। চশমার কাচটা মুছে দেখল, বাপ্পীর ফোন—
ওরা দুই ভাইবোন কানাডাতে লেখাপড়া করে। সামনের মাসে দেশে আসবে। খবরটা পোষা বিড়াল দুটোকে বলতে, ওরা মিউ মিউ করে উঠল। জেমিমা ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, পুষি, টুষি আমি এবার আমার ডায়েরিগুলো ওদের হাতে তুলে দেব, যেন ওরাও ওদের বাচ্চাদের আমার মতো করে শৈশব-কৈশোরকে উপহার দিতে পারে। ছোটবেলা আর বড়বেলা যেন দুই রকম না হয়। ছোটবেলার ভালো দিকগুলো বড়বেলায় কাজে লাগাতে হবে, আর খারাপ... সে তো সব সময় খারাপ, তাই তা বর্জন করতে হবে।

পাঠকের মতামত:

২৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test