E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আরিফুন নেছা সুখী’র গল্প

২০১৬ ফেব্রুয়ারি ১৭ ১৬:১২:৪৪
আরিফুন নেছা সুখী’র গল্প







 

বর্ণমালার গল্প

'মালা ও মালা কোথায় গেলি মা, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে, ওদিকে পাত্রপক্ষের আসার সময় হয়ে গেছে। মালা ও মালা...!'

আজ বর্ণরা মালাকে দেখতে আসবে। পছন্দ হলে আজই বিয়ে। বর্ণরা মালাকে খুব পছন্দ করলো। তাই আর দেরি না করে ওদের বিয়ে হয়ে গেলো। প্রথমে মালা আপত্তি করলেও ওদের দেখে মালাও সম্মতি দিলো। বিয়ের পর মালা শ্বশুরবাড়ি চলে গেলো।

বর্ণ আর মালার সুখের সংসার। বেশ ভালো আছে ওরা। এর মধ্যে মালা লেখাপড়াও শেষ করেছে। ওদের বাড়ির নাম বর্ণমালা। শোনা যাচ্ছে বর্ণমালার ঘরে নতুন অতিথি আসবে, সেই নিয়ে ওদের ব্যস্ততা। প্রথম সন্তান মায়ের বাড়ি হওয়াই নিয়ম। কিন্তু বর্ণ ছুটি না পাওয়ায় মালাকে মায়ের বাড়ি পাঠানো হলো না। অগত্যা কী আর করা। মালার মা এলেন বর্ণ আর মালার বাড়িতে।

ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো সেই দিন। ঘর আলো করে মালার কোলজুড়ে এলো রাজপুত্র। তাও একজন নয়, দু'জন। আনন্দ যেন ধরে না। বাঁধভাঙা খুশিতে মাতোয়ারা সবাই।

ছেলে তো হলো। এবার ওদের নাম রাখার পালা। কি নাম রাখা যায়, কি নাম রাখা যায়, সবাই ভেবে আকুল। অবশেষে বর্ণর বাবা ব্যাকরণ বললেন ওদের নাম হবে- স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণ। সংক্ষিপ্ত করে স্বর ও ব্যঞ্জন। সবার খুব পছন্দ হলো নাম দুটি। আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে স্বর ও ব্যঞ্জন। এখন ওরা হাঁটতে পারে, কথাও বলে আধো আধো বোলে। ওরা দু'জনই খুব চঞ্চল। তবে স্বর একটু বেশি। দু'জনের মধ্যে যেমন ভাব, তেমন কারও কথা কারও গায়ে পড়ে না।

ওরা এখন বেশ বড়। স্কুলে ভর্তি করা হলো। স্বর স্কুলে যেতে খুব ঝামেলা করে। কিন্তু ব্যঞ্জন স্কুলে যেতে বেশ আগ্রহী। তবে লেখাপড়াতে দু'জনই বেশ ভালো। তারা দু'জন বুদ্ধিমানও। ওদেরকে স্কুলের মাস্টারমশাইরা বেশ আদর করেন। প্রথমে স্বর স্কুলে যেতে না চাইলেও এখন স্কুলে যেতে বেশ পছন্দ করে। প্রতিদিন ওরা স্কুলে যায়।

সামনেই ওদের বার্ষিক পরীক্ষা। কিন্তু ওদের নানু, মানে মালার মা খুব অসুস্থ। তাই বর্ণ-মালা দু'জনই যাবে উনাকে দেখতে। কিন্তু স্বর ও ব্যঞ্জনকে কী করবে ওরা তো সঙ্গে যেতে পারবে না। ওদের তো পরীক্ষা চলছে। আবার থাকবে কার কাছে?

অগত্যা ব্যাকরণ দাদু বললেন, 'ওরা আমার কাছে থাক। তোমরা ঘুরে আসো।'

মালা বললো, 'আপনি ওদের সামলাতে পারবেন? ওরা যা দুষ্ট!'

কি আর করা, ব্যাকরণ দাদুর কাছে স্বর ও ব্যঞ্জনকে রেখে বর্ণমালা গেল মালার মাকে দেখতে। সারা রাস্তা মালা স্বর-ব্যঞ্জনের জন্য চিন্তা করলো।

আর এদিকে স্বর ও ব্যঞ্জন ওদের দাদুর কাছে বহাল তবিয়তে আছে। আগামীকাল ওদের বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা। তাই ব্যাকরণ দাদুর কাছে বাংলা দ্বিতীয় পত্র পড়ছে। দাদু ওদের বর্ণ বোঝাচ্ছেন, 'বর্ণ দুই প্রকার_ স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ। প্রথমেই স্বরবর্ণ কাকে বলে_ যে বর্ণ কারও সাহায্য ছাড়া একা একা উচ্চারিত হতে পারে তাকে স্বরবর্ণ বলে। যেমন_ অ, আ, ই, ঈ ইত্যাদি। স্বরবর্ণ ১১টি। অন্যদিকে যে বর্ণ স্বরবর্ণের সাহায্য ছাড়া উচ্চারিত হতে পারে না, তাকে ব্যঞ্জনবর্ণ বলে। যেমন_ ক, খ, গ, ঘ ইত্যাদি। ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৯টি।

এখন তোমরা এই সংজ্ঞা দুটি মুখস্থ করো, আমি একটু আসছি' _বলেই বাইরে গেলেন ব্যাকরণ দাদু। স্বর ও ব্যঞ্জন পড়ছে।

হঠাৎ স্বর বললো, 'দেখেছিস ছোট, তুই আমাকে ছাড়া উচ্চারিতই হতে পারিস না। হা হা হা... কি অসহায় তুই!'

এই শুনে ব্যঞ্জন বললো, 'দেখ ভাইয়া, এভাবে বলিস না। তুই বুঝি আমার সাহায্য নিস না! তোর নামের বানানেও তো আমি আছি। আর তোর সংখ্যা ১১। আমার সংখ্যা ৩৯। আমি তোর চেয়ে সংখ্যায় বেশি।'

'দেখ ছোট, আমার রাগ বাড়াস না।'

'আমি তো স্বরবর্ণের সংজ্ঞা পড়ছিলাম। তুই শুধু শুধু আমার পেছনে লেগেছিস।' _ব্যঞ্জন বললো।

স্বর বললো, 'আমি তোর পেছনে লাগিনি, তুই-ই আমার পেছনে লেগেছিস।'

এই নিয়ে দু'জনের তুমুল ঝগড়া। এমন সময় বাড়ি ফিরলেন ব্যাকরণ দাদু।

'এই কী হয়েছে? একটু বাইরে গেছি না কেন এ কি অবস্থা তোমাদের!'

স্বর ও ব্যঞ্জন একে অপরের নামে নালিশ দিলো। সব কথা শুনে ব্যাকরণ দাদু বললেন, 'তোমরা এখনও অনেক ছোট, বড় হলে বুঝবে। তাও শোনো_ আমাদের বাংলা ভাষার জন্য স্বর ও ব্যঞ্জন দুই বর্ণেরই প্রয়োজন আছে।'

ব্যাকরণ দাদু ওদের বুঝিয়ে দিয়ে, আরও কিছু পড়া দিয়ে বললেন, 'তোমরা পড়ো, আমি খাবার কিনে আনি।'

দাদু চলে যাওয়ার পর দু'জন দুই দিকে মুখ করে বসে রইলো। কেউ কারও সঙ্গে কোনো কথা বলছে না। হঠাৎ স্বর বললো, 'দেখ ব্যঞ্জন, একটা পাকা আম। চল আমটা পাড়ি। তুই তোর মইটা একটু দে না।'

তখন ব্যঞ্জন বললো, 'কেন রে! আমাকে নাকি তোর কোনো কাজেই লাগে না! তুই নাকি একাই উচ্চারিত হতে পারিস! তাহলে আমার মই নিবি কেন?'

'দেখ ব্যঞ্জন, ম-এর পর ই কিন্তু আমার। এত ঝগড়া লাগিস না!'

ব্যঞ্জন বললো, 'আর আ-এর পর ম, সেটা তো আমি।' এই বলে দু'জন আবার ঝগড়া শুরু করলো। একসময় ক্লান্ত হয়ে হার মানলো। তারপর দু'জন মিলেমিশে মইটা দিয়ে আমটা পেড়ে ভাগ করে খেলো।

ব্যাকরণ দাদু ফিরে এসে ওদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে গল্প বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালে পরীক্ষা দেবে স্বর ও ব্যঞ্জন।

স্বর ও ব্যঞ্জন পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে স্বর ব্যঞ্জনকে বললো, 'তুই স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণে উদাহরণ কীভাবে লিখেছিস? ক, খ নাকি ১, ২ দিয়ে? আমি ১, ২ দিয়ে লিখেছি। পাশের জন বললো, আমি রোমান সংখ্যা দিয়ে লিখেছি।' ব্যঞ্জন বললো, 'আমি আমার ক, খ দিয়েই লিখেছি। দেখ স্বর, এর জন্য তোকে অঙ্ক চাচা বা রোমান আন্টির সাহায্য নিতে হয়েছে। আর তুই নাকি সব একা করতে পারিস!'

স্বর ভাবছে ব্যঞ্জনকে কীভাবে বোঝাবে, 'ও যা ভাবছে, তা আসলে ঠিক নয়। আমি মুখ গহ্বরের কোথাও বাধা না পেয়ে উচ্চারিত হতে পারি। কিন্তু শব্দ গঠন একা করবো কীভাবে! আর ক, খ এদের অন্তরালেও তো আমি আছি ক+অ = ক। কি আর করা!' স্বর কয়েক মুহূর্তের বড়; ওকে তো ছোট ভাইয়ের আবদার মানতেই হবে। স্বর বললো, 'আমি সারাজীবন তোর পাশে থাকবো।' ব্যঞ্জন বললো, 'আমিও।' ব্যাকরণ দাদু ওদের ভাব দেখে খুব খুশি হলেন। বর্ণমালাও ফিরে এলো মালার মাকে দেখে। এখন তিনি ভালোই আছেন।

ব্যাকরণ দাদু বললেন, 'সারাজীবন তোমরা মিলেমিশে থাকবে। তাহলে কেউ আর এত সংগ্রাম করে পাওয়া বাংলা ভাষাকে ভাগ করতে পারবে না।'

(ওএস/এএস/ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test