E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বামন মিয়ার হ্যান্ড মাইক

২০১৬ মে ০৬ ১৫:০৫:২৪
বামন মিয়ার হ্যান্ড মাইক

আশিক মুস্তাফা : রন্টির বাবা ছোট্টমোট্ট একটা মানুষ। বয়স হলেও লম্বায় তেমন বাড়েননি। আকৃতিতে সেই শৈশবেই পড়ে আছেন। মাত্র তিন ফুট সাড়ে তিন ইঞ্চি। এই নিয়ে গ্রামের বড়রা তাকে উপহাস করে। ক্ষেপায়। বলে, 'ব্যাটা, পাড়ার পিচ্চিকাচ্চিরা লম্বায় তোকে ছাড়িয়ে গেছে। একেবারে ব্যাঙাচির মতো হয়ে আছিস। এক কাজ কর, একটা ছাগল কিনে নে; তারপর সেই ছাগলের পিঠে চড়ে হাইওয়ে রেস্টুরেন্টের টুলে গিয়ে বসে হ্যান্ডমাইকে মানুষ ডাকিস।'

গ্রামের লোকদের এমন কথায় রন্টির বাবা ক্ষেপেন না। হেলেদুলে ছোট ছোট পায়ে আনমনে হাঁটেন হাইওয়ে রোডের দিকে। রন্টিদের বাড়ি ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে রোড থেকে তিন কিলোমিটার ভেতরে। আলেখার চর গ্রামে। রোজ সকালে গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে হাইওয়ে রোডের 'হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে' আসেন। এই রেস্টুরেন্টই তার কর্মস্থল। আগে 'দ্য লায়ন সার্কাস'-এ খেলা দেখাতেন। ক্লাউনের মতো সেজেগুজে একটা রশির ওপর দিয়ে হাঁটতেন। বেশ ক'বছর আগে লায়ন সার্কাসের মালিক দল গুটিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যান। সেই থেকে এই হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে চাকরি নেন। রেস্টুরেন্টের দরজায় উঁচু একটা টুলে বসে হ্যান্ডমাইকে মানুষ ডাকেন, 'হ্যাল্লো ভাই, আসেন-ন-ন...। ভেতরে এসে হাসেন-ন-ন...। স্বাদে-গুণে উন্নত খাবার-র-র...। ভোজনে তৃপ্তি পেতে ভেতরে আসেন-ন-ন...। নিজের খাওয়াতেই শেষ নয়; বাড়ির ছোট বাবুদের জন্যও নিয়ে যান কুমিল্লার রসমালাই-ই-ই...!'
এই পথে যারা নিয়মিত তাদের অনেকেই তাকে চেনেন। তাই আগ বাড়িয়ে কথা বলেন।

রন্টির বাবা মুখ থেকে মাইকটা একটু দূরে সরিয়ে তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলেন। নতুনদের অনেকেই কৌতূহল নিয়ে তাকাতে তাকাতে ভেতরে ঢোকেন। তিনি কিন্তু রাজ্যের কথা বলতেই থাকেন মাইকে। মাঝে মধ্যে হ্যান্ডমাইকে হোটেলের মেন্যু দামসহ মুখস্থ বলেন। আবার ঘড়িতে সময় দেখেন। একটা বাসের বিরতি ২০ মিনিট। যে বাসই এই হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে আসে সেই বাসের সময় তিনি মাথায় রাখেন। একটা বাস থামার ঠিক ১৭ মিনিটের মাথায় তিনি ঘোষণা করেন, 'ঢাকা থেকে নোয়াখালীর উদ্দেশে ছেড়ে আসা হিমাচল এক্সপ্রেসের সম্মানিত যাত্রী সাধারণের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাদের বাসটি নোয়াখালীর উদ্দেশে হোটেল ত্যাগ করবে-এ-এ!'

আবার বলেন, 'চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা ইউনিক সার্ভিসের সম্মানিত যাত্রী সাধারণের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাদের বাসটি ঢাকার উদ্দেশে হোটেল ত্যাগ করবে-এ-এ!'

যাত্রীরা এমন ঘোষণা শুনে তাড়াহুড়া খাওয়া শেষ করে বাসে উঠেন। বের হওয়ার পথে কেউ কেউ তার ছোট হাতে বকশিস দিয়ে যান। এই টাকা নিতে ভালো লাগে না। তবু নিতে হয়। ছোট হওয়ায় এই কাজ ছাড়া যে আর ভালো কাজ পান না তিনি। কেউ তাকে অন্য কাজও দেয় না। 'দ্য লায়ন সার্কাস' ছাড়ার পর ঢাকায় গিয়েছিলেন চাকরির আশায়। কিন্তু কেউ তাকে চাকরির যোগ্য মনে করে না। খেয়ে না খেয়ে বেশকিছু দিন কাটালেন। এর ভেতর একদিন ঢাকার কাকরাইল মোড়ে 'ক্যাফে আলীবাবা' রেস্টুরেন্টের মুখে টুলে বসা তারই মতো আরেক বামনকে দেখে এগিয়ে কথা বলেন। কথা থেকে বন্ধুত্ব। তারপর ছগির নামের এই বন্ধুর সঙ্গে বিজয়নগর পানির ট্যাংকের পেছনে তার বাসায় ওঠেন। দুই বন্ধুর কতো কথা, কতো গল্প! একে অন্যকে কষ্টের কথা শোনায়। দু'জনের কষ্টই মিলে যায়। ছোট ঘরটার ছিটকিনি লাগাতেও তাদের চেয়ারের সাহায্য নিতে হয়।

এই নিয়ে তাদের মনে তেমন কষ্ট না থাকলেও মানুষের অবহেলার কথা মনে পড়লেই বুকটা কেঁপে ওঠে দু'জনের। চাপা কষ্টে বুকটা তখন ফেটে যায়। তবু সেই কষ্ট বুকে চেপে দুই বন্ধু ঘুমিয়ে পড়ে।

এক সকালে ছগিরের পরামর্শে তিনি ঢাকার শান্তিনগর এলাকায় একটা পাতাল রেস্টুরেন্টের দরজায় দাঁড়িয়ে মানুষ ডাকার চাকরি নিয়ে নেন। কিছুদিন চাকরির পর আর মন টেকে না ঢাকায়। শুধু বাড়ির কথা মনে পড়ে। একদিন কাউকে কিছু না বলে সোজা গ্রামের বাড়ি আলেখার চরের বাস ধরেন। বাড়িতে দু'দিন থেকে ফের চাকরির খোঁজে নামেন পথে। হাইওয়ে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারকে বুঝিয়ে এ চাকরিটা নেন। সেই থেকে প্রায় সাত বছর হ্যান্ডমাইকে মানুষ ডাকছেন রেস্টুরেন্টে। এভাবেই ডেকে যেতে চান। যে যাই বলুক। তিনি চাকরিটা ছাড়তে চান না। তার ছেলে রন্টিকে যে বড় করতে হবে। বাবার মতো রন্টিও আকৃতিতে ছোট। তাকেও সবাই বামন বলে। তাই বলে ছেলের হাতে হ্যান্ডমাইক তুলে দিতে চান না তিনি। রন্টি আকৃতিতে ছোট হলেও মানুষ হিসেবে সে অনেক বড় হবে। সেও বড় বড় স্বপ্ন দেখবে। ভাববে বড়সড় বিষয়-আশয় নিয়ে; এটাই চান রন্টির বাবা। বামন বাবা হিসেবে আর কিইবা চাইতে পারেন তিনি!

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test