E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সোনার তরী(শিশু কিশোর সাহিত্য)

২০১৬ আগস্ট ০৯ ১২:৪২:১৩
সোনার তরী(শিশু কিশোর সাহিত্য)









 


আসলাম সানী
আমার জীবন ভাই

কম্পিউটারে-বন্ধ ঘরে
পাই না খোলা মাঠ
সুইমিংপুলে হারিয়ে গেছে
শৈশবের সেই হাট—

এখন সবি মেকি
যেদিক চেয়ে দেখি
চোখ ধাঁধাঁনো একি!

প্রযুক্তি বিজ্ঞানে গড়া
যান্ত্রিকতার জটে ভরা
আমার জীবন ভাই
সবুজ-সরল প্রকৃতিকে
আবার ফিরে চাই।



সোহেল মল্লিক
বাবুই

দুইতলা এক বাসা দেখো
তালের গাছে ঝোলা
সেই বাসাতে দরজা এবং
জানলা আছে খোলা।
এই বাসাটার মালিক কে গো
সেই কথাটা বলি---
বুয়েট থেকে পাশ করা নন;
বাবুই প্রকৌশলী।

স্বপন দেলওয়ার
ছড়াকার

লেখেন তিনি ছড়া
মেজাজ ভারী কড়া
নবীন কবি দেখলে যে তাঁর
ভাবখানা হামবড়া।

পত্রিকাটা দ্যাখেন
মাঝেমধ্যে ল্যাখেন
বিকেলবেলা হরহামেশা
বন্ধ নড়াচড়া।

বইটা হাতে দিলে
চমকে ওঠে পিলে
একটা কিছু লিখতে
বলেন হয়নি পড়া



উত্তম সেন
চোখ নিয়ে

ভোমরার চোখ যায় বাগানের ফুলেতে,
নাপিতের চোখজোড়া পড়ে ঠিক চুলেতে।
দরজির চোখ থাকে সুঁই আর সুতোতে,
চামারের চোখ খোঁজে পায়ে থাকা জুতোতে।
শেয়ালের চোখ ঘোরে মোরগের আশাতে
কেউ কথা বলে শুধু চোখেরই ভাষাতে !
শিকারির চোখ থাকে জঙ্গল-বনেতে-
কারো চোখ সুন্দর, গড়মিল মনেতে !

আলমগীর কবির
চঞ্চলা টুনটুনি

চঞ্চলা টুনটুনি
বলো তুমি আজকে,
ভালবাসো ছুটোছুটি
নাকি বলো কাজকে?
মাঠ নদী বনে যেতে
রোজ নেই কি মানা?
চাইলেই পাড়ি দাও
সবুজের সীমানা।

সারাদিন টুনটুন
খাও লুটো পুটিরে,
তাই দেখে গোলাপের
হাসে দুটো জুটিরে।
মন চায় পড়া কাজ
পড়ে আজ থাক না,
তোমারই মতো করে
মেলে দিই পাখনা।


সৈয়দ মাশহুদুল হক
খোকার প্রশ্ন

খোকনসোনা মাকে শুধায়
সূর্য কোথায় থাকে
রোজ সকালে কেমন করে
পুবাকাশে উঠে ?
কেমন করে চন্দ্র-তারা
শূন্যে ভেসে থাকে
আকাশ কেন নীল দেখায় আর
উল্কা কেন ছুটে।

কোথা হতে ঝড় আসে আর-
বৃষ্টি কেন পড়ে
আকাশেতে ঝিলিক কিসের
বজ্র কেমন চিজ ?
কেমন করে ডিমের ভিতর
প্রাণের সঞ্চার হয়
কার ইশারায় চারা গজায়
বুনলে ক্ষেতে বীজ।

বড় হলে সব জানবে
মায়ের জবাব পেয়ে
খোকনসোনা ঘুমিয়ে পড়ে
ফীডারে দুধ খেয়ে।


সোহেল রানা
বিশ্বজয়ী খোকন

ও বাবারে
দেখে যারে
টাট্টুঘোড়ায় উঠছে কে?
ঘোড়ার পিঠে
খোকন উঠে
টগবগিয়ে ছুটছে রে।

দেশ বিদেশে
বীরের বেশে
করছে খোকন বিশ্বজয়
ফিরলো যখন
সবাই তখন
আনন্দেতে মগ্ন হয়।


সামস সোহান
শিশুরা

স্বর্ণমুকুল সুগন্ধি ফুল
হাস্নাহেনা গোলাপ বকুল
শিশুরা
ফুলকি ঝরা মিষ্টি রোদ
ভাবুক মনের অবুঝ বোধ
শিশুরা।
স্বপ্ন সুখের নাও ভাসাবে
কান্না মুছে লোক হাসাবে
শিশুরা
যতই আসুক আঁধার ঘোর
নতুন সূর্য আনবে ভোর



মাসুমা আক্তার রুমা

মধ্য রাতের খেলা


মনটা আমার বিভোর থাকে
লেবু ফুলের গন্ধে
দূর আকাশে উড়বো আমি
পাখির মতো ছন্দে।

চাঁদটা কেমন মুচকি হেসে
জড়ায় কালো শাড়ি
ঘুম পাড়ানী গল্প গানে
জ্যোৎস্না ভাঙে আড়ি।

আকাশ জুড়ে তাঁরার মিছিল
আলো ঝলমল করে
একটি তাঁরা হঠাৎ যেন
হাওয়ায় ভেসে চলে।

অবাক চোখে চেয়ে দেখি
মধ্য রাতের খেলা
ঘুমের শেষে সূয্যি মামা
উঠলো সকালবেলা।




সৈয়দ শরীফ
ঠাট্টারুভূত


দুষ্টু যে কী ছিলাম আমি
ছিলাম বড্ড পাজি,
মাকে দেখলে ঠিকই আবার
হতাম পুরোই হাজী।

ছোট্ট-বড় সবার সাথেই
করতাম রে যা ঠাট্টা,
এই কারণে ঠাট্টারু ভূত
ফেললো আমার দাঁতটা।

কী লাভ পেলি ও রে ভূতু?
ফেলে আমার দাঁতটি,
তোর সনে আর খেলবো না ভাই
এই নে জনমকাট্টি।



খোন্দকার শাহিদুল হক
আলোড়ন

বনের মাঝে বাঘ থাকে তো
কামড়িয়ে দেয় যদি
পাশ দিয়ে তো যাচ্ছে বয়ে
কুমির ভরা নদী।


মৌমাছিরা হুল ফোটালে
বাড়বে দেহে জ্বালা
বনে হাজার জন্তু থাকে
দেখার আগেই পালা।

বনের ছবি থাকলে ঘরে
থাকবে মনে শান্তি
ভাবলো দেশের জ্ঞানী-গুণী
বন রাখাটা ভ্রান্তি।

তাই তো তারা খাচ্ছে নদী
খাচ্ছে গিলে বন
তারা এসব খাবেই খাবে
নেইতো আলোড়ন।


অভিজিত বড়–য়া বিভু
খুকী ও মেঘ

নীল আকশে মহাসুখে
ছুটছে মেঘ দল,
তাই দেখে খুকীর মনে
বাড়ল সাহস বল।
চড়বে খুকী মেঘের ভেলা
ভেসে ভেসে কাটাবে বেলা
আকাশ জুড়ে নানান সুরে
গাইবে অনর্গল।


জুলফিকার আলী

মেঘের খেলা


খোকন সোনার মন আকাশে
নিত্য মেঘের খেলা,
মেঘমালা দেখতে দেখতে
কাটায় সারাবেলা।

ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি নামে
আকাশ বেজায় কালো,
গর্জন তুলে ডাকে মেঘ
ডোবে বিল-খালও।

পাটক্ষেতে স্বপ্ন আঁকে
নতুন ধানে চাষী,
বর্ষা মানে কাদা ভরা
পুকুর জলে ভাসি।

টাপুরটুপুর বর্ষা মেয়ে
দিচ্ছে গালে চুম,
প্রকৃতিতে সবুজ শোভা
কাড়ে চোখের ঘুম।



বাতেন বাহার
বঙ্গবন্ধু আছেন


বঙ্গবন্ধু আছেন আমার
মনের মনি কোঠায়
অমর কবি আছেন তিনি
হাজার ফুলের বোটায়।
ঐক্যতানে আছেন তিনি
আছেন পাখির গানে
বুঝবে তারা সঠিক যারা
পাখির ভাষা জানে।

বঙ্গবন্ধু আছেন আমার
মায়ের প্রিয় ভাষায়
আছেন তিনি স্বপ্নে এসে
দেখেন মায়ের রুপ
বাঙালিদেও ভাবনা এখন
তাইতো অপরুপ।


ইয়াসিন আহমেদ
শ্রেষ্ঠনায়ক


ছোট্ট খোকা শেখ মুজিবুর
যাচ্ছে পথের ধারে,
গাছতলার এক রুগ্ন বুড়ি
দৃষ্টি খোকার কাড়ে ।
.
শীত মানে না বুড়ির জামায়
কাপছিল থরথরে,
খোকার চাদর সেই বুড়িকে
দিল উজাড় করে ।

ইউসুফ রেজা
আগস্টের এলিজি -- ১

আজকে আগস্ট এই বর্ষায়
আজকে শোকের দিন
যতই কাঁদি শেষ হবে না
পিতা তোমার ঋণ।

খুন হয়েছে জাতির আশা
স্বাধীন বাংলাদেশ
খুনি কিছু আজও আছে
হয়নি তারা শেষ ।

জাতির পিতার হত্যাকারী
মানবতার নামে
বন্ধু দেশেই বহাল আছে
নিমন্ত্রিত খামে।

সভ্য বলে দাবি করে
খুনিকে দেয় ঠাঁই
দুই মুখি এই বখিল বন্ধু
আর দরকার নাই।

.
এমন খোকা ক'জন পাবে
সারা দেশে ঘুরে?
মুজিব সে তো শ্রেষ্ঠনায়ক
এই পৃথিবী জুড়ে!


গল্প-১


সুনিকার কান্না
আব্দুস সালাম

মনিকা ও সুনিকা দুই বোন। মনিকা বড় আর সুনিকা ছোট। বাবা সরকারি চাকরি করে। সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে তাদের বাসা। বাসাটি নিচতলায়। কোয়ার্টারের সামনে একটু খালি জায়গা রয়েছে। সেখানে সকাল-বিকাল কোয়ার্টারের ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে। মনিকাদের পাশের ফ্লাটে মীমদের বাসা। একমাস হলো তারা এখানে এসেছে। মীমের বয়স মনিকা ও সুনিকার বয়সের মাঝামাঝি। তাই দুই বোনের সাথেই মীমের ভাল সম্পর্ক। মীম দুই বোনেরই বান্ধবী। তারা সুযোগ পেলেই একসাথে খেলাধুলা করে। পাশাপাশি বাসা হওয়ার কারণে কিছুদিনের মধ্যে তাদের পারস্পারিক সম্পর্কটা বেশ ঘনিষ্ঠ হয়।

মীমের মা কড়া মেজাজের। যেকোন বিষয়ে চট করে রেগে যায়। আগে পিছে চিন্তাভাবনা না করে যার তার সাথে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে। একদিন মীম, মনিকা ও সুনিকা একসাথে খেলা করছিল। খেলা করতে করতে মীম মাটিতে পড়ে যায়। পায়ে সামান্যও ব্যথা পায়। অমনি মীমের মা অভিযোগ করে যে, মনিকা না হয় সুনিকা মীমকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। যদিও দুই বোনের কেউই মীমকে ধাক্কা দেয়নি। এনিয়ে দুই মায়ের মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটি হয়। অন্য একদিন সুনিকা মীমের সাথে খেলা করার সময় মীমকে পঁচা বলে। তা নিয়েও মীমের মা সুনিকার মার সাথে ঝগড়া করে। সে মনিকা ও সুনিকাকে কড়া নিষেধ করে দেয় এ ধরণের কথা না বলার জন্য। সে আরও বলে, “যদি কখনও শুনি তোমরা আমার মেয়েকে বাজে কথা বলেছো, তাহলে তোমাদের সাথে আমার মেয়েকে খেলতে দেব না।”

মীমের বাবা ভাল মানুষ। স্ত্রীর ব্যবহারে সে অসন্তুষ্ট। তার এ ধরণের কড়া নিষেধ সে মানতে রাজী না। তার কথা হল- একসাথে খেলাধুলা করলে এরকম হতেই পারে। তাই বলে বাচ্চাদের খেলাধুলা বন্ধ থাকবে কেন? মীম যদি কখনও রাগ করে মনিকাদের না মেশে তখন সে নিজ উদ্যোগে মনিকা ও সুনিকার সাথে মীমের মিল করে দেয় এবং তাদেরকে একসাথে খেলাধুলা করতে বলে। তখন তারা আবার একসাথে খেলাধুলা করে। কিন্তু তাদের মায়েরা কেউ কারোর সাথে কথা বলে না। কারণ ইতিঃমধ্যে বাচ্চাদের নিয়ে তারা বেশ কয়েকবার ঝগড়াঝাটি করেছে। যদিও দুই বাবা একে অপরের সাথে কথা বলে এবং তাদের মধ্যে কখনও রাগারাগি কিংবা কথা কাটাকাটি হয়নি। তারা বাচ্চাদের কখনও ভুল ধরে না। তারা জানে ছেলেমেয়েদের ভালভাবে বেড়ে ওঠার জন্য সমবয়সী সঙ্গীদের খুব প্রয়োজন। বড় বড় শহরে যার খুব অভাব রয়েছে। স্ত্রীদের কোন অভিযোগ পেলে তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে মিটিয়ে ফেলে।

মায়েদের মধ্যে কথা বলা বন্ধ থাকার কারণে বাচ্চাদের উপর তার বেশ প্রভাব পড়ে। মনের আনন্দে তারা সুন্দরভাবে খেলাধুলা করতে পারে না, কথা বলতে পারে না। সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে। একদিন তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে মীমের মা মীমকে নিষেধ করে দিল যে, সে যেন কোনভাবেই মনিকা ও সুনিকার সাথে না মেশে। এমনকী তাদের সাথে যেন কথাও না বলে। মায়ের আদেশ মীম ঠিক ঠিকভাবে পালন করছে। সে আর মনিকাদের সাথে কথা বলে না, মেশে না। মীম যখন ফ্লাটের অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে খেলা করে তখন মনিকা ও সুনিকা তাদের সাথে খেলে না। আবার মনিকা ও সুনিকা যাদের সাথে খেলা করে তখন মীম তাদের সাথে খেলে না। শুধু দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। ফ্লাটের বাচ্চারা বাইরে না খেললেও দুই বোন একসাথে খেলা করে। তখন মীমের খুব ইচ্ছা হয় মনিকাদের সাথে খেলা করতে। খেলা করার জন্যে তার জানটা ছটফক করে। কিন্তু মায়ের কড়া শাসনের কাছে তার ইচ্ছা হার মানে।

সুনিকা সবার ছোট সে মান অভিমানের কিছুই বোঝে না। সে সবার সাথে খেলতে চায়। তবে মীমের মাকে সে ভয় পায়। পাশাপাশি থাকার কারণে তাদের মধ্যে আবার মিলও হয়ে যায়। আবার তারা একসাথে খেলা করে এবং কথাবার্তা বলে। কিন্তু তাদের মায়েদের মধ্যে কোন কথাবার্তা হয় না। যাহোক, এভাবে প্রায় বছর পার হয়ে যায়। ক্রমেক্রমে মনিকা ও মীমদের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্কের খুব অবনতি হয়। কেউ কারোর সাথে কথা বলে না। মেয়েরাও এখন আর কেউ কারোর সাথে কথা বলে না। যদিও দুই ঘরের দুই দুয়ার মুখোমুখি। দুয়ার খোলা থাকলে একজন অপরজনকে দেখতে পায়। অথচ কেউ কারোর সাথে মেশে না। এভাবেই তারা দিনাতিপাত করছে।

মীমের বাবা কিছুদিন আগে অন্য একটি সরকারি কলোনিতে ভাল বাসা বরাদ্দ পেয়েছে। ক’দিন পরেই তারা সেখানে চলে যাবে। নতুন বাসাতে ওঠার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। মীমের মনটা খারাপ। সে এই এলাকা ছেড়ে যেতে চাই না। এদিকে সুনিকা একদিন তার মাকে বলে: “মা, মীম আমার সাথে কথা বলে না কেন? আমার সাথে খেলে না কেন?”
: ওর সাথে তোমার খেলতে হবে না। ক’দিন পরেই ওরা এখান থেকে চলে যাবে। এখন ওর সাথে মেলামিশা না করাই ভাল।
এই ভালোর মর্মার্থ সুনিকা কিছুই বুঝলো না। সে শুধু বললো, “কোথায় যাবে?”
: অনেক দূরে। ওরা আর কখনও এখানে আসবে না। নতুন যারা আসবে তুমি তাদের সাথে খেলবে।
: তারা কি আমার সাথে কথা বলবে? খেলা করবে?
: অবশ্যই। তারা তোমার সাথে কথা বলবে, খেলা করবে, এমনকী তোমাকে আদরও করবে।
: তার মা যদি আমাকে বকা দেয়, আমার সাথে খেলতে না দেয়?
সুনিকার মা এই প্রশ্নের কোন সদুত্তোর দিতে পারেনি। শুধু নীরব থেকেছে।

মীমরা বাসা ছেড়ে দেওয়া জন্য জিনিসপত্র গুছিয়েছে। ট্রাকে মালসামানা উঠানো হয়েছে। মীম বারবার ঘরের বাইরে আসা যাওয়া করছে। তার গায়ে সুন্দর একটি জামা রয়েছে। জানালায় দাঁড়িয়ে মনিকা ও সুনিকা মীমকে লক্ষ্য করছে। কিন্তু কেউ কারোর সাথে কোন কথা বলছে না। কিছুক্ষণ পর মালসামানা নিয়ে ট্রাকটা চলে গেল। মীম ও তার বাবা-মা একটি মাইক্রোবাসে উঠলো। মীমের মনটা খুব খারাপ। চোখদুটো জলে ভরে গেছে। মনিকা সুনিকাকে বললো, “মীমরা চলে যাচ্ছে। আর আসবে না। ওদের সাথে আমাদের আর দেখা হবে না।” এই কথা শুনে সুনিকা ঘরের ভিতর চলে গেল এবং খাটের উপরে একটা বালিশের নিচে মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করলো। ঘরের ভিতর সুনিকার কান্নার শব্দ শুনে মনিকা ও তার মা সুনিকার কাছে ছুটে গেল। মা সুনিকাকে বললো: “কী হয়েছে? কাঁদছো কেন?”
: না কিছু হয়নি। আমার মন খারাপ।
: কেন?
: মীমরা চলে গেল তো, তাই।
====

গল্প-২

একটি খুন ও মুরাদ
ফয়সাল শাহ

মুরাদের গ্রামের বাড়ি যমুনা নদী ঘেষা টাঙগাইল জেলার ঘাটাইল থানার কাশবন ঘেরা নন্দীপাড়া গ্রামে। সে তার সদ্য বিধবা ফুফুর কাছে বসবাস করে। তার ফুফু অত্যান্ত পরহেজগার সুফী প্রকৃতির মহিলা। মুরাদ দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে, তার শ্রেণীর ভূগোল শিক্ষক নিতাই বাবু একজন পন্ডিত ব্যক্তি ও সর্বজন শ্রদ্বেয় নিবেদিত প্রাণ আদর্শ শিক্ষক। তিনি ছাত্রদের কাছ থেকে কিভাবে পাঠ আদায় করতে হয় তা ভালভাবেই জানেন। ছাত্ররা তাঁকে ভয়, সমীহ ও শ্রদ্ধা করে আবার তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। মুরাদ নিতাই স্যারের ক্লাসে দৈনিক পড়া মুখস্ত করে আসত। যদিও অন্যান্য শিক্ষকদের ক্লাসে সে ফাঁকিবাজি করত। অঙ্ক ও ইরেজীতে যদিও মুরাদ দূর্বল ছিল; কিন্তু ভূগোলে সে বরাবরই পাকা। বাংলাদেশের কোন অঞ্চলে কি ফসল উৎপন্ন হয়, বাংলাদেশের পর্যটন সমৃদ্ধ এলাকা কোথায় সব কিছুই তার জানা ছিল। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে করে মাঠে ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সাথে মিশে বেড়াতে মুরাদের ভাল লাগত। বাবুই পাখি কেমন করে বাসা গড়ে তোলে, মাছরাঙ্গা কিভাবে ডাব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায়ও দোয়েল আর টুনটুনি পাখির বাসা খুজে সারা গ্রাম চষে বেড়াত সে। হাডুডু, দাঁড়িয়াবাধা খেলত, নদীর পানিতে লাফ দিয়ে, কাদা পানিতে ভিজে খুব আননদ্ করত। ছোট্ট ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের কথাবলা ও শিস দেয়া শেখানো, বানর ও কুকুরের বাচ্চা পুষা সবই মুরাদ করত। এই পোষা পাখি, জীব-জন্তুর প্রতি এতোটুকু অবহেলা মুরাদ করত না। আবার এগুলো দেখাশুনা করতেন মুরাদের ফুফু।

মুরাদ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠার চেষ্টা করত। একদিন রাত্র বারটা কি একটা হতে চিল্লাচিল্লির শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দূর থেকে কানে ডাকাত ডাকাত চিৎকারের শব্দে শুনতে পায়। বাড়ি থেকে অনেকেই হুড়মুড় করে বের হয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল। মুরাদ ভয় পেয়ে গেল সে ঘরের এক কোনায় জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল আর তার মনে হচ্ছিল এই বুঝি ডাকাত তাদের বাড়িতেই আক্রমন করছে। ফুফু মুরাদকে টেনে এনে বিছানাতে শুইয়ে দিল আর বল্ল ভয়ের কোন কারণ নেই। লোকজন যেহেতু জেগে উঠেছে ডাকাত আর এ দিকে আসবে না, পালিয়ে যাবে। মুরাদ একটু আস্বা¯ত হলে, একটু একটু করে ভয় কমতে লাগল। ফুফুকে জিজ্ঞাসা করল, মানুষ কেন ডাকাত হয়। ফুফু উত্তর দিল আদিকাল থেকেই সমাজে এক শ্রেণীর দুস্কৃতিকারী লোকছিল যারা অন্যের সম্পদ জোর করে ছিনিয়ে নিত, এখনো এ ধরণের লোক সব দেশে, সব সমাজেই আছে। অনেকে বিভিন্ন কারণে এ জঘণ্যতম পেশা বেছে নেয়। এতক্ষণ মুরাদ চিন্তা করতে লাগল না জানি ডাকাতেরা কাদের বাড়ি আক্রমন করেছে, কি কি সম্পদ ডাকাতি করেছে, কাউকে আঘাত কিংবা হত্যা করেছে কিনা। এ সব চিন্তা করে মুরাদের মনে ডাকাতের উপর প্রচন্ড ক্ষোভ ও ঘৃণা হতে লাগল। মানুষ এত হিংস্র, জগণ্য ও নিশংস হতে পারে। অপরের সম্পদ কেড়ে নিতে পারে, বিনা কারণে মানুষকে হত্যা করতে পারে। মনে মনে সে প্রচন্ডভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠে, জীবনে সে বড় হয়ে সুযোগ পেলে ডাকাত শ্রেণীর মানুষদের সায়েস্তা করবে।

মুরাদ আরো চিন্তা করতে লাগল সমাজে যারা চুরি, প্রতারণা, ঘুষ, জমি দখল, ওজনে কম দেয়, পাওনা সম্পদ ফেরত না দিয়ে অপরাধ করে থাকে তারাও ডাকাতদের চেয়ে কম অপরাধী নয়। এ সকল অপরাধসমূহ সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং অন্যের অধিকার হরণ করে। সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে ও ধর্মীয়ভাবে এগুলো জঘন্যতম অপরাধ। আর এ সকল অপরাধের জন্য বিভিন্ন মাত্রার শাস্তির বিধান রয়েছে। যে সমাজে আইনের শাসক যত কঠোর সে সমাজে এসব অপরাধের মাত্রা তত কম হয়ে থাকে। কাররণ অপরাধীরা শাস্তি ছাড়া আর কিছু ভয় করে না। শাস্তির ভয়ে অনেক অপরাদ থেকে বিরত হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করে, সাথে সাথে সৎ পন্থায় জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। আর সে সমাজ সুখী ও সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠে।

মুরাদ রাত্রে আর ঘুমুতে পারল না সামাজিক অপরাধ সম্পর্কে বিভিন্ন চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। আর সামাজিক অপরাধের বির“দ্ধে তার মন বিদ্রোহী আকার ধারণ করতে লাগল। সারা জীবন যেখানেই অপরাধ ঘটবে সে প্রতিরোধের চেষ্টা করবে এবং নিজেও এসব অপরাধ থেকে বিরত থাকবে। ফুফুকে আবার জিজ্ঞেস করে মানুষ কেন অপরাধী হয়ে উঠে, জবাবে ফুফু বললেন, ক্রোধ, হতাশা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, অভিভাবকের অসচেতনতা, সমাজের দুর্বল আইনের শাসনব্যবস্থা নৈতিক শিক্ষার অভাব, সমাজের আদর্শ স্থানীয় ব্যক্তিত্বের অনুপস্তিতি ইত্যাদি কারনে মানুষের মনে অপরাধ প্রবণ হতে সহায়তা করে।

ভোর বেলায় মুরাদ খবর পায় নিতাই স্যারের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। ডাকাতরা রামদায়ে নিতাই স্যারের মাথায় আঘাত করে হত্যা করেছে; স্যারের স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে এবং কলেজ পড়–য়া মেয়ে কল্পনাকে কুপিয়ে জখম করেছে। বাড়ির যা সম্পদ ছিল সব কিছু লুন্ঠন করেছে। মুরাদ প্রচন্ডভাবে মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়। নিতাই স্যারের মত দেবতুল্য একজন মানুষকে ডাকাতেরা হত্যা করতে পারে তা মুরাদ ভেবে পায় না। নিতাই স্যারের বাড়িতে কিইবা সম্পদ ছিল। একজন স্কুল শিক্ষক তার আয় রোজগারইবা কত। পৈত্রিক সম্পদও তেমন ছিল না। এ হত্যাকান্ড নিছক ডাকাতি করতে এস বাধার সম্মুখীন হওয়াতে ডাকাতরা হত্যা করেছে, নাকি পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। মুরাদ এসব ভেবে তালগোল পাকিয়ে তার মাথারয় আর কিছুই আসছে না ঝিম মেরে কতক্ষণ শুয়ে রইল। এদিকে সকাল হয়ে এল। দলে দলে সারা গ্রামের ও আশ পাশের দশ গ্রামের লোক নিতাই স্যারের বাড়িতে ভিড় জমালো। মুরাদও যথারিতি নিতাই স্যারের বাড়িতে গিয়ে উপস্তিত। নিতাই স্যারের ঘরে প্রবেশ করে দেখে দুটো লাশ পড়ে আছে; একটি মেঝেতে অপরটি বিছানার উপরে। মেঝের উপর নিতাই স্যারের লামটি উপুড়ে হয়ে পড়ে আছে, তার মাথায় ঘাড়ের একটু উপরে রামদায়ের একটি কুপের গভীর আঘাত, রক্তে মাথা, শরীর ও সারা মেঝে ভেসে আছে। আর বিছানাতে নিতাই স্যারের স্ত্রীর লাশের সারা শরীরে হাতে পায়ে কাধে, মাথায় রামদায়ের আঘাত, বিছানা রক্তে ভিজে আছে। মুরাদ আর সহ্য করতে পারছে না তার মাথা কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে, শরীর শীতল হয়ে আসছে। জীবনে সে এ ধরণের বিভৎস্য দৃশ্য আর দেখেনি। কল্পনাও করতে পারেনি মানুষ মানুষকে এভাবে নিশংসভবে হত্যা করতে পারে। তার মনে হতে লাগল মানুষ পশুর চেয়েও জঘন্য ও হিংস্র হতে পারে। ঘৃণায়, ক্ষোভে, ক্রোধে, আতংকে, মুরাদের মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এদিকে নিতাই স্যারের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবসহ উপস্তিত পরিচিত জনেরা কান্নাকাটি ও আহাজারি করছে। এসব দেখে মুরাও বিমর্ষ হয়ে গেল। তার চোখ দিয়েও ছলছল করে অশ্রু বইতে লাগল।

সকাল নয়টার দিকে থানা পুলিশ এস হাজির হলো। পুলিশ প্রথমেই আহত কল্পনাকে হাসপাতালে নেয়ারন ব্যবস্থা করল। তারপর নিতাই স্যার ও তার স্ত্রীর লাশের সুরতহাল করে পোষ্ট মর্টেম করার জন্যে একটি ভ্যান গাড়ীতে করে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাকতির সময় কাজের মেয়ে আরতী খাটের নীচে লুকিয়ে সকল ঘটনা প্রতক্ষ্য করেছিল। পুলিশ আরতীকে জিজ্ঞাাবাদ করে খুনের রহস্য বের করার জন্য তাদের সাথে নিয়ে গেল। যথারীতি তদন্ত মামলা ও বিচারের কাজ চলতে লাগল।

নিতাই স্যারের খুনের ঘটনা সারা জীবনের জন্য মুরাদের স্মৃতিতে গভীর দাগ কেটেছিল। আর তার মনে দীপ্ত হয়ে উঠেছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার অদৃস্য স্পৃহা । আর পরবর্তী চাষা জীবন একাত্তরের যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে দেশের স্বাধীনতার লাল সবুজের পতাকা অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল।আর সমাজে মুরাদের মত দেশ প্রেমিক ছিল বলেই আজ আমরা স্বাধীন।

সম্পাদনা:-বদরুল হায়দার

লেখা পাঠানোর ঠিকানা:[email protected]

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test