E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মাসুম বিল্লাহ’র গল্প

২০১৬ আগস্ট ২৮ ২৩:১৩:২২
মাসুম বিল্লাহ’র গল্প







 

ডানা ভাঙা সাইকেল

সজীবের নানা বললেন, 'তুই কি কারোর কথা শুনবি না?'
সজীব চিৎকার দিয়ে বলে, 'তোর মতো বুড়োর কথা শোনার টাইম নাই।'
কথাটা বলে এক লাফে উঠোনে নামে সজীব। তারপর কাঁঠাল গাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে যায় । পেছন থেকে গলা ফাটিয়ে ওর নানা ডাকতে থাকেন, 'ও সজীব দুপুরবেলা কোয়ানে যাচ্ছি? দাঁড়া যাস নে, শুইনে না কচ্ছি...'
পেছনে ফেরে না সজীব। সে বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাইকেল চালায়। সাইকেল তো নয় যেন উড়ন্ত পাখি। সজীব ক্লাশ ফোরে পড়ে। বন্ধুরাও ওর সাইকেল চালানো দেখে জানতে চায়, 'তোর সাইকেলে কয়ডা ড্যানা লাগানো রে?' বন্ধুদের প্রশ্নে সজীব রহস্যের হাসি হাসে।
নির্জন নদীর পাড়। মাথার ওপর খাঁ-খাঁ রোদ্দুর। মাঝ নদীতে ডিঙি ভাসিয়েছে জেলে। জেলে নয় মালো পাড়ার সাধন কাকু। সবাই কাকুকে সাধন জাইল্লা বলে ডাকে। কিন্তু সজীব ডাকে সাধন কাকু বলে। পথে দেখা হলে বলে, 'ও সাধন কাকু, আমারে তোমার ডিঙিতে কবে চড়াবা?'
জবাবে সাধন জেলে বলে, 'চড়িস চড়িস, একদিন চড়াবানি-'
আজ সুযোগ দেখে সজীব গলা ফাটিয়ে ডাক দিল, 'ও সাধন কাকু, আজ চড়াবা?'
- 'আইজ না অন্যদিন, মাছ পাচ্ছি নে বুজলি? মেজাজ খারাপ আছে...'। হাঁক মেরে জানায় সাধন জেলে।
সজীব আর কিছু না বলে চুপ করে থাকে। মন খারাপ হয় ওর। তার কথা কেউ শোনে না। নিজেই নিজেকে শোনায় ও- সাধন জাইল্লার বড় ভাব বেড়েছে। কোনদিন দিবানি ডিঙি ফুটো কইরে! আর বুড়োর বাচ্চারও [সজীবের নানা] দিন দিন বড় বাড় বেড়েছে, সারাদিন খালি পড় পড়, এটা করিস নে, ওটা করিস নে-খালি করিস নে করিস নে; বুড়োর মাথা না ফাটালি আর হচ্ছে না! এবার মা আসুক, থাকপো না তোগে বাড়ি। মা আসলি মারে কবো- 'মা, আমারে সঙ্গে নিয়ে চল, আমি তোমারে ছাড়া থাকতি পারি নে...'
- 'কেমন আছো বন্ধু?'
সজীব চমকে ওঠল। কে কথা বলে? চারপাশে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেল না। গা ছমছম করে ওঠে। তাহলে কী ভর দুপুরে ভূতের খপ্পড়ে পড়ল! ইচ্ছে করছে এক দৌড়ে এখান থেকে পালায়। পালানোর আগেই আবার শুনতে পেল-
- 'এই যে বন্ধু, এদিকে- নদীতে তাকাও- আমি পুঁটি, পুঁটি মাছ-'
- 'পুঁটি মাছ আবার কথা বলে নাকি? তুমি ভূত! পানি ভূত!'
- 'তোমার মন খারাপ বলে বন্ধুকে ভূত ভাবছো।' পুঁটি মাছটি অভিমানের সুরে বলল।
- 'পুচকে পুঁটি মাছ হবে মানুষের বন্ধু! চাপা মারার জায়গা পাচ্ছো না বুঝি?'
- 'তুমি কী আমাকে পায়ের তলায় পিষে মারতে পারবে?'
- 'খামোখা আমি তোমারে মারতি যাবো ক্যান?'
- 'আমি জানতাম তুমি এই কথাই বলবে। কিন্তু তোমার ওই সাধন জেলে আমাকে পেলে ছাড়বে না!'
- 'তা ছাড়বি ক্যান? মাছ ধরতি না পারলি সে খাবে কী?'
- 'সেজন্যেই আমিও পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। নদীর পাড়ে আশ্রয় নিতে এসে তোমার সঙ্গে দেখা হলো-।' ছোট্ট পুঁটি মাছ বলল।
- 'কিন্তু মাছেরা তো কথা বলতে পারে না!'
- 'সবাই কথা বলতে পারে-মাছ, গাছ, ফুল, পাখি, সব। তা তোমার মন খারাপ কেন বন্ধু?'
- 'আমারে কেউ ভালোবাসে না। কেউ পছন্দ করে না।'
- 'তোমার মা নেই?'
- 'অাছে। শহরে থাকে।'
- 'তুমি এখানে। তোমার মা শহরে। অাশ্চর্য কথা!'
- 'আমার মা আরেকটা বিয়ে করিছে-।'
- 'তোমার বাবা কোথায়?'
- 'সেও আরেকটা বিয়ে করিছে। সেজন্য আমি নানা বাড়ি থাহি।'
- 'তাহলে তো তোমার অনেক দুঃখ।
- 'হু। সেজন্যি এবার মা আসলি তার সাথে শহরে চইলে যাবো- মারে ছাড়া থাকা যায় কও?
- 'অবশ্যই থাকা যায় না। ইশ্ তুমি চলে গেলে আমি কার সঙ্গে কথা বলবো!'
- 'তুমি আমার সাথে শহরে যাবা?'
- 'যেতাম কিন্তু শহরে আমার দম বন্ধ লাগে।'
- 'ও। বন্ধু আজ যাচ্ছি, পেটে খিদে লাগিছে-ভাত খাতি হবে।'
- 'আচ্ছা, কাল কখন আসবে?'
- তুমি যহন আসতি কবা। আসলি তোমারে খুঁইজে পাবানি?'
- 'বন্ধু বলে ডাক দিও। ছুটে আসবো।'
- 'আচ্ছা। যাই। ভালো থেকো। সাবধানে থেকো।'
- 'তুমিও।'

বাড়ির পথে ছুটল সজীব।
ওর মন ভালো হয়ে গেছে। একটা পুচকে পুঁটি মাছ তার সঙ্গে কথা বললো। বন্ধু বলে ডাকল। কিন্তু মানু্ষগুলো যেন কেমন! সজীব মনে মনে ভাবল, পুটি মাছের কথা বন্ধুদের বলবে কিনা। বললেই কী ওরা বিশ্বাস করবে? ওকে পাগলটাগল বলে ক্ষেপাতে শুরু করে দেবে। ঠিক করলো, বলবে না ওদের। দ্রুত সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরে এল। ওকে দেখেই নানা বাজখাঁই কণ্ঠে বললেন, 'সারাদিন কোয়ানে ছিলেন আপনি? নাওয়া-খাওয়া লাগবি না?'
সজীব কিছু বললো না। নানা আবার বলেন, 'ও নানা, খুশির খবর আছে, তোমার একটা ভাই হয়েছে। তোমার মায়ের আসতি কিছুদিন দেরি হবেনে।'
কথাটা প্রথমবার বুঝতে পারে না সজীব। পরে যখন বুঝল তখন তার রাগ হলো। কান্না চাপল। আবার সে সাইকেলের ডানা মেলল। পেছন পেছন বৃদ্ধ নানা ছুটছেন। কিন্তু সাইকেলের সঙ্গে পেরে উঠলেন না। সজীবের চোখ ভিজে ওঠল। চোখের সামনে সবকিছু ঝাঁপসা দেখছে। ধীরে ধীরে সাইকেলের গতি কমে এল। পা দুটিতেও জোর পাচ্ছে না। অনেক কষ্ট করে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়াল সজীব। তারপর কান্নাভেজা কণ্ঠে ডাকল, 'বন্ধুু ও বন্ধু....'
ছুটে এল পুঁটি মাছ। পানি থেকে মাথা বের করে অবাক কণ্ঠে বলল, 'কী ব্যাপার বন্ধু, ফিরে এলে যে? খাওয়াদাওয়া করোনি?'
- 'বন্ধু, আমার নতুন একটা ভাই হয়েছে। মা নাকি এখন আসতে পারবি না।'
- 'এ তো খুব আনন্দের কথা। তুমি মন খারাপ করছো কেন?'
- 'তুমি বুঝতিছো না, মাছেরা সব বুঝতি পারে না..., নতুন ছেলেরে পেয়ে মা আমার কথা ভুলে যাবে, আমারে দেখতেও আসতি পারবে না...'
কান্নায় ভেঙে পড়ল সজীব।
- 'এবার বুঝেছি আমি, তুমি মন খারাপ করো না বন্ধু। তুমি কেঁদো না।'
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। সজীব আর ওর নতুন বন্ধু পুঁটি মাছের মধ্যে কথা-বার্তা তখনও চলছে...

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test