E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বন্ধুর পাশে বন্ধু

২০১৬ সেপ্টেম্বর ০২ ১৬:২০:৫৭
বন্ধুর পাশে বন্ধু

রুবেল রানা :


আজ তামিম স্কুলে আসেনি। কারণ কী? রাসেলের খুব জানতে ইচ্ছে করছে। এমনিতে কিন্তু রাসেল তামিমকে সহ্য করতে পারে না। কারণ ক্লাসে তামিম হলো ফার্স্টবয় আর রাসেল সেকেন্ডবয়। তামিমের সাথে রাসেলের পড়ালেখায় হাড্ডি হাড্ডি লড়াই। কিন্তু রাসেল কিছুতেই কোন দিনও তামিমকে ডেংগিয়ে রেজাল ভালো করে কোন ক্লাসেই ফার্স্ট হতে পারে না। রাসেলের মা প্রায় প্রতিদিনই তাকে বকাবাজি করে পড়ালেখা নিয়ে। বলেন, ‘তোকে তো খাবার কম দেই না, খাবার তো খারাপও খাস না।’ তামিমকে উদ্দেশ করে আরো বলেন, ‘ওই দাসীর পোলার চেয়ে ভালো ভালো খাবার খাওয়াই তোকে। তার পরেও কী তোর মাথায় গবর রয়ে গেছে?’

মা’র বকাঝোকা শোনে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে নীরবতা পালন করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না রাসেলের। কিছুক্ষন পর মা নিজেই থেমে যান। যাই হোক, মা’র বকাঝোকার কথা মনে করে রাসেল মনে মনে বলে, তামিম আজ স্কুলে আসেনি তাতে আমারই ভালো হয়েছে। আজ যা পড়া দিবে ক্লাসে তাতো সে জানতে পারবে না। আগামীকাল স্কুলে এসে ক্লাসের পড়া দিতে পারবে না।

পরদিনও তামিম স্কুলে এলো না। আজ রাসেল গতকালের চেয়ে অনেকটাই বেশি খুশি। ফুরফুরে মনে আছে। এভাবে তামিম স্কুলে না এলে প্রতিদিন ক্লাস মিস হয়ে পড়ালেখায় পিছিয়ে যাবে এ সুযোগে রাসেল এগিয়ে যাবে।

এভাবে একদিন দুদিন করতে করতে চারদিন যাবৎ স্কুলে আসছে না তামিম। ক্লাসে একদিন বাংলা স্যার ছাত্রছাত্রীদের কাছে জানতে চাইলেন, তামিম কেনো স্কুলে আসছে না? কেউ কিছু বলতে পারল না। কারণ কেউ তো কোন খবর নেই নি যে, তামিম কেনো স্কুলে আসছে না। রাসেল মনে মনে চিন্তা করল আজ স্কুল ছুটির পর তামিমদের বাড়িতে যাবে খোঁজ নিতে। প্রথম দুদিন রাসেলের কাছে তামিমের অনুপস্থিত ভালো মনে হলেও আজ খুব খারাপ লাগছে। মনের ভিতর এক মায়া অনুভূতি কাজ করছে। নিজের মেধা দিয়ে পড়ালেখায় এগিয়ে যেতে না পারলে তাতে কোন মূল্য নেই। তামিম ক্লাসে অনুপস্থিত থাকলে তো আমিই নিশ্চিত ক্লাসে ফার্স্টবয় হয়ে যাব। এমন ফার্স্টবয় হওয়ার মূল্য কী? নাহ, এমনটি আমি চাই না। বর্তমানে ছাত্র হিসাবে যা আছি তা খারাপ কী?

স্কুল ছুটির পর রাসেল নিজেদের বাড়িতে না গিয়ে সরাসির চলে গেল তামিমদের বাড়িতে। তামিমের মা চকির উপর একটি কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন। তামিমের বাবা নেই। বাবা তার মাকে ডিভোর্স দিয়ে আরেকটি বিয়ে করেছে। এরপর থেকে মা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন বা মাঝে মধ্যে দালান বাড়ি তৈরির ইটভাঙার কাজ করেন। এভাবেই টেনেটুনে কষ্টে চলছে তামিমদের বেঁচে থাকার লড়াই। রাসেল তামিমের মাকে সালাম জানিয়ে বলল, ‘চাচি, তামিম কোথায়? আপনার কী শরীর খারাপ?

এই গরমের মধ্যে কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন কেনো?’ তামিমের মা আস্তে করে মিহি গলায় সালামের জবাব দিয়ে চুপচাপ রইলেন। এবার রাসেল তামিমের মা’র মাথায় হাত রেখে দেখে গায়ে প্রচুর জ্বর। জ্বরে গা যেনো পুড়ে যাচ্ছে। রাসেল আবার বলল, ‘চাচি, তামিম কোথায়?’ এবার তামিমের মা’র দু’চোখের কোণ বেয়ে জল ঝরতে থাকল। রাসেল হকচকিয়ে গেল। কান্না করতে করতে তামিমের মা বললেন, ‘বাবা, আজ চারদিন যাবৎ আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। কাজে যেতে পারছি না। ঘরে খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। আবার আমার ওষুধ কিনতে হয়। তাই কোন উপায় না পেয়ে তামিম চারদিন যাবৎ ইটভাঙার কাজে যাচ্ছে।’ বলা শেষে আরো অঝরে কান্না করতে থাকেন। রাসেল আর তার নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারল না।

‘চাচি, কাঁদবেন না। কাল তামিমকে বাড়িতে থাকতে বলবেন।’ এই বলে রাসেল বাড়ি ফেরার জন্য উঠে দাঁড়াল। তখন তামিমের মা বললেন, ‘বাবা, মেঝেতে জগে পানি আছে, আমাকে এক গ্লাস পানি দিতে পারবে কষ্ট করে। বিছানা ছেড়ে উঠতে আমার কষ্ট হচ্ছে।’ রাসেল জগ থেকে এক গ্লাস পানি দিল। এরপর তার শার্ট ও প্যান্টের পকেট হাতরিয়ে দেখল কোন টাকা আছে কিনা। থাকলে কিছু কিনে দিত। নাহ, পকেটে কোন টাকা পেল না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এরপর রাসেল সে বাড়ি থেকে বেরোয়ে এলো। মন খারাপ করে রাস্তায় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়ল গতকাল বাবা তাকে টিফিনের জন্য বিশ টাকা দিয়েছিল। সেই টাকা সে খরচ করেনি। স্কুল ব্যাগে রেখেছে। চলতি পথে থেমে গেল। ব্যাগের সাইট পকেটের চেইন খুলে দেখল যে, বিশ টাকা আছে। তাৎক্ষণিক রাস্তার পাশে এক দোকান থেকে একটি কলা আর রুটি কিনে আবার তামিমদের বাড়িতে গেল। তামিমের মাকে রুটি-কলা দিল। আসার সময় আবার মনে করিয়ে বলে এলো কাল যেনো তামিম বাড়িতে থাকে।

বাড়ি আসার পর রাসেল মনমরা হয়ে বেশ চুপচাপ আছে। মা জানতে চাইলেন কী হয়েছে? মা’র প্রশ্নে কোন উত্তর দিল না। মা আর এনিয়ে তেমন ঘাটাল না। পরদিন রাসেল স্কুলে গিয়ে ক্লাসের সকল ছাত্রছাত্রী বন্ধুদের বলল, তামিমের স্কুলে না আসার কারণ কি।

রাসেল সিদ্ধান্ত নেয় তামিমের মা যতদিন সুস্থ হয়ে না উঠবেন ততদিন ক্লাসের সকলে টিফিনের টাকা বাচিয়ে তামিমকে সাহায্য করবে। যেন সে আর ইটভাঙার কাজে না গিয়ে নিয়মিত স্কুলে আসে। যা ভাবা তাই করা। ক্লাসের সকলে রাসেলের কাছে যার যার টিফিনের টাকা জমা দিল। স্কুল ছুটি শেষে রাসেল তার সঙ্গে আরো দুজনকে নিয়ে তামিমদের বাড়িতে গেল। রাসেল তামিমের হাত ধরে বলল, ‘তামিম, ক্লাসে তোমাকে ছাড়া আমরা অতগুলো ছাত্রছাত্রী থাকলেও তোমার অনুপস্থিতিতে ক্লাসটা খালি খালি লাগে। ক্লাসের ফার্স্টবয় উপস্থিতি না থাকলে ক্লাস শুরুটা ভালোই লাগে না। ক্লাসে স্যারেরা যখন হাজিরা খাতায় রোলকল করে প্রথম রোল নং-১ অনুপস্থিত শোনে ভীষণ খারাপ লাগে। তাই আজ থেকে তুমি স্কুলে যাবে নিয়মিত। আর আমরা ক্লাসের সবাই মিলে একটা নিদ্ধান্ত নিয়েছি যতদিন না তোমার মা সুস্থ হয়ে উঠবেন ততদিন আমরা টিফিনের টাকা খরচ না করে প্রতিদিনের টাকা জমা করে তোমাকে দেব। তুমি মানা করতে পারবে না।’ রাসেলের এহেন মহান কথা শোনে আনন্দে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তামিমের দু’চোখ বেয়ে। পরদিন থেকে তামিম আবার স্কুলে যেতে থাকল।

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test