E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সান্টু ও তেলাভো

২০১৬ সেপ্টেম্বর ২৭ ২৩:৫৯:৩৮
সান্টু ও তেলাভো

ইবনুল কাইয়ুম :


তেলাভো, তেলাভো, তেলাভো..... সুর করে ডাকতে ডাকতে ছোট্ট ছেলে-মেয়ের দল রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে। তাদের সামনে চকচকে ন্যাড়া মাথার এক লোক হেঁটে চলেছে। বেশ লম্বা, হালকা পাতলা গড়ন। তাল পাতার সেপাই যেনো একটা। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। পরনে সাদা রঙের একটা লুঙ্গি, গায়ে ঘিয়ে রঙের গোল গলা ফতুয়া। পায়ে ট্রাক বা বাসের টায়ার কেটে বানানো একজোড়া চপ্পল। লোকটার মাথায় বা মুখে কোনো চুল-দাঁড়ির অস্তিত্ব নেই। সবই চকচকে।

সবাই জানে তার নাম তেলাভো। তার আসল নাম কি, তা কেউ জানে না। কোনোদিন জানতেও চায়নি কেউ তার কাছে। তার চাল চলনে একটা চকিত ভাব আছে। তেমনি চাহনিতেও। কোথায় কোন গ্রামে বাড়ি ছেলের দল তা জানে না। শুধু সপ্তাহে দুই অথবা তিন দিন সে হাটে যায় এটা জানে। আর জানে কি বললে লোকটা খেপে যায়।

হাটে যাতায়াতের জন্য তেলাভোকে প্রায় ১০ কিলোমিটার হাঁটতে হয়। লাল ইটের ভাঙ্গাচোরা রাস্তা ধরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে হাঁটু পর্যন্ত না হোক হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ধূলোর মিহি স্তর জমে লাল হয়ে ওঠে। তবে সান্টুর বয়সী বাচ্চাদের হাঁটু পর্যন্তই লাল হয়ে যায়। আবার বেশি দূর হাঁটাও লাগে না।

এই মুহূর্তে লোকটির অভিব্যক্তিতে চরম বিরক্তির বহিপ্রকাশ। মাঝে মাঝেই চোখ গরম করে সে তেড়ে যাচ্ছে ছেলেদের দিকে। তখন বাচ্চাগুলো উল্টো দিকে দৌড়ে পালাচ্ছে। আবার পেছন ফিরলে মৌমাছির মতো এসে জুটছে। আস্তে আস্তে ছেলেদের দল ভারি হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে বাড়ে তাদের হল্লা।

তাকে দেখলেই হয়। সান্টুদের পাড়ায় সাড়া পড়ে যায়। ছেলের দল তেলাভো, তেলাভো করে পিছনে ছুটতে শুরু করে। মাঝে মাঝে কোরাস তোলে ছেলেরা। কয়েকজন ‘তেলা’ পর্যন্ত বলে থেমে যায়, বাকি ‘ভো’ টা কয়েকজন কোরাস করে শেষ করে। এতে আরো খ্যাপে লোকটা। রাগে মুখ লাল হয়ে ওঠে। পথে আর কোনো যায়গায় সমস্যা নেই। এই গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময়ই কেবল সমস্যায় পড়ে সে। খেপে গিয়ে তাড়া দিলে খ্যাপানোর মজা বেড়ে যায় ছেলেদের। না খেপলে খেপিয়ে মজা কোথায়?

একবার তেলাভোর তাড়া খেয়ে হুড়োহুড়ি করে পালাতে গিয়ে সান্টু পড়ে গিয়েছিল। এবড়ো থেবড়ো রাস্তায় দাঁত বের করা ইটের ওপর পড়ে গিয়ে হাঁটু, পেট আর কনুই ছড়ে যায় ওর। বাড়ি ফিরে মাকে কি বলবে সেই চিন্তায় কান্না চলে আসে। মা তো ঠিকই দেখে ফেলবেন ওর এই অবস্থা। মা বার বার করে বলে দিয়েছেন, কাউকে যেনো কখনো বিরক্ত না করে। যদি কোনোদিন ওর নামে বাড়িতে নালিশ আসে, তাহলে মেরে তক্তা বানাবে। এখন তো সে একজনকে খ্যাপাতে গিয়ে পড়ে গেছে। ব্যাথা যেটুকু পেয়েছে সেটা সামলে নিয়েছে, কিন্তু তক্তা হওয়ার ভয়ে সে কেঁদেই ফেলে।

ওর কান্না দেখে কয়েকজন ওকে সান্তনা দেয়। বলে, সামান্য একটু ছিলে গেছে বলে কাঁদছিস! ধূর বোকা, এতে এতো কান্নার কি আছে? যেখানে ছিলে গেছে, সেখানে একটু থুথু লাগালেই ঠিক হয়ে যাবে। বলার অপেক্ষা মাত্র, অমনি মুখ থেকে এক দলা থুথু বের করে ছড়ে যাওয়া পেটে মাখিয়ে দেয় কবির। তা দেখে সান্টুর কান্না আরো বেড়ে যায়। চৌদ্দ পাটি দাঁত বের করে হে হে করতে করতে চলে যায় কবির।

সেবার মায়ের কবল থেকে দাদি তাকে বাঁচিয়ে দেন। কি হয়েছে বলে বুকে জড়িয়ে ধরে মাকে বলেন স্যাভলন লাগিয়ে দিতে। মা জিজ্ঞেস করলেন, কিভাবে হয়েছে? দাদি কিছুটা রাগত স্বরে বলেন, আগে স্যাভলন লাগাও পরে শোনা যাবে। মা স্যাভলন আর তুলা আনতে গেলেন। সান্টুর আবার স্যাভলনে খুব ভয়। লাগালেই ছ্যাত করে জ্বলে ওঠে। দাদি তুলা ভিজিয়ে ছড়ে যাওয়া স্থানে স্যাভলন লাগিয়ে দিতে থাকেন। আর সান্টু চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সহ্য করে। তার মাঝে মাঝেই চিৎকার দিতে ইচ্ছে করে। খুব সামলে নেয় সে। দাদি স্যাভলন লাগাতে লাগাতে বলেন- যেভাবেই পড়ুক না কেনো, ওর তো ডাবল শাস্তি হয়ে গেল বৌমা। পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছে, আবার স্যাভলন লাগানোর জ্বলুনি। আর কিছু বলার দরকার নেই। বলে হাসতে থাকেন দাদি।

কয়েকদিন পরের কথা, তেলাভোকে খ্যাপাচ্ছে সবাই। সান্টু তখন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেরা ওকে ডাকল। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। ওদের দলে যোগ দিল না। অবশ্য মনের ভেতরে যে আকুপাকু করছিল না, তা নয়। তবু নিজেকে সংযত করে সে। হঠাৎ মাথার ভেতর একটা দুষ্টু বুদ্ধি গজিয়ে ওঠে ওর। চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। মুচকি হাসি মুখে ঝুলিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

বিকেলে গড়িয়ে গেলে তেলাভো বাড়ির দিকে ফিরতি পথ ধরে। এ গ্রাম দিয়েই যেতে হয় তাকে। অন্য রাস্তা না থাকায় ছেলের দলের খ্যাপানোর ভয় নিয়েই তাকে এ রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। আজ সে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। দ্রুত পায়ে মাথা নিচু করে একমনে পথ চলে সে। সান্টুদের পাড়ায় এলে তার পা আরো দ্রুত চলে।

এদিকে, তেলাভোর প্রতিক্ষায় সান্টুর আর সময় কাটতে চায় না। সে রাস্তার ধারে আটছুটি বাগানে বসে মশার কামড় খেতে খেতে তেলাভোর জন্য অপেক্ষা করছে। হাতে তার একটি মাঝারি সাইজের কাগজের ঠোঙ্গা। ঠোঙ্গার মুখটা ভালো করে মোড়ানো। মুখ থেকে হলুদের গুঁড়ো বেরিয়ে ঠোঙ্গার গায়ে লেগে আছে। রাস্তা দিয়ে কত লোক আসে যায়, তেলাভো আর আসে না। এমন করে সে আর কখনো কারো জন্য অপেক্ষা করেনি।

লুকিয়ে থাকতে থাকতে তার হঠাৎ মনে হলো, কেউ যদি তাকে এভাবে লুকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে, সে এখানে কি করছে? সে কি জবাব দেবে? এ কথা মনে হতেই সান্টু হাতের ঠোঙ্গাটি সেখানে রেখে বেরিয়ে এলো। বাজারের দিকে খানিকটা এগিয়ে গেলো। তেলাভোকে দেখা গেলে সে তার কাজ শুরু করবে।

সান্টুকে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষায় রেখে দ্রুত পায়ে তেলাভোকে আসতে দেখা গেল। তার হাতে একটি সদাই ভর্তি প্যাকেট। কোনো দিকে না তাকিয়ে রাস্তার দিকে চোখ নিবন্ধন করে সে ঘাড় গুঁজে হাঁটছে। সান্টু এক দৌড়ে তার ঠোঙ্গার কাছে চলে এলো। এসে দেখে টোঙ্গার মুখ খুলে গেছে। হায় হায় কেমন করে হলো? ঠোঙ্গার মুখ খোলা থাকলে তো তার প্লানই বানচাল হয়ে যাবে। একটু পাটের সুতো পেলে কি ভালই না হতো! প্যাকেটটা ভালো করে বাধা যেতো। ওদিকে তেলাভোও কাছে চলে এসেছে। এখন কি করে?

আটছুটি বাগানে দাঁড়িয়ে মশার কাড়র অগ্রাহ্য করে সে ভাবতে লাগল। চট করে মাথায় তার একটা বুদ্ধি চলে এলো। পাশের বেল গাছটার দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবছিল সে। হঠাৎই বুদ্ধিটা এলো। দুষ্টু বুদ্ধিতে তার মাথা ভর্তি। গিজ গিজ করে বুদ্ধিগুলো। শুধু মায়ের ভয়ে সে ঠিক মতো কাজে লাগাতে পারে না সেগুলো। তা না হলে এতোদিনে সে বিখ্যাত হয়ে যেতো পাড়ার মধ্যে। সবাই তাকে বোকা ভাবে। সেটা আর ভাবতে পারত না।

বেলগাছের একটা কাঁটা ছিঁড়ে কাগজের ঠোঙ্গার মুখে লাগিয়ে দিল সে। খুব খেয়াল না করলে বোঝা যাবে না। হলুদের গুঁড়ো দিয়ে কাঁটার মুখ ঢেকে দেয় সে। এবার আর বোঝাই যাচ্ছে না। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল আশপাশে কেউ নেই। তবে তেলাভো একেবারে কাছে এসে পড়েছে। তবু সান্টু রিস্ক নেয়। বাগান থেকে বেরিয়ে কাগজের ঠোঙ্গাটি সে রাস্তার মাঝখানে রেখে সোজা ভালো মানুষের মতো রাস্তা পার হয়ে ওপাশে চলে যায়। রাস্তা পার হয়েই লাগায় দৌড়। তেলাভো মাথা নিচু করে থাকায় ওকে দেখতে পায়নি।

খানিকটা গিয়ে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি দেয় সান্টু। দেখে তেলাভো পথে পড়ে থাকা ঠোঙ্গাটার সামনে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে। সান্টু উদগ্রীব হয়ে চেয়ে আছে। তোলে না ক্যান? মনে মনে তাগাদা দেয় সে। সান্টুর ইচ্ছাকে পূর্ণতা দিতেই যেনো চট করে ঠোঙ্গাটা তুলে নেয় তেলাভো। তারপর সেটি হাতের প্যাকেটে ঢুকিয়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে।

এদিকে গাছের আড়ালে আনন্দে লাফ দিয়ে ওঠে সান্টু। হাসি তার দুকানে গিয়ে ঠেকেছে। এখন তেলাভোকে বোকা বানানোর গল্পটা কাকে বলবে সেই চিন্তায় বিভোর সে। খুঁ‍জতে খুঁ‍জতে কবিরকে পেয়ে যায় নদীর ধারে। এক মনে ছিপ দিয়ে মাছ ধরছিল কবির। পিছন থেকে একটা বড় একটা ঢিল ছোড়ে সে কবিরের ছিপের ফাতনা লক্ষ্য করে। কবির রাগ ভরা চোখে পিছনে তাকাতেই দেখল সান্টু দুকান প্রসারিত হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সে বলে- কিরে, খুব হাসছিস যে? আমার মাছ তাড়িয়ে দিয়ে এখন দাঁত দেখাচ্ছিস। দাঁত বের করা বন্ধ করে দিচ্ছি দাঁড়া, বলেই হাতের ছিপ ফেলে তেড়ে এলো সে। সান্টু বলে, আরে থাম থাম। দারুন একটা মজা হয়েছে। সেটাই তোকে বলতে এলাম। কোনো কথা শোনে না কবির, গোয়ারের মতো তেড়ে আসে। অবস্থা বেগতিক দেখে সান্টু দৌড় দেয়। খানিক দূর পেছনে ধাওয়া করে ধরতে না পেরে আবার ছিপের কাছে ফিরে যায় কবির। রাগে ফুঁসতে থাকে সে।

রাতে দাদির কাছে শুয়ে সান্টু বলে, জানো দাদি আজ একটা দারুন মজা হয়েছে। দাদি কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই সে বলে, আজ তেলাভোকে বোকা বানিয়েছি। কিভাবে জানো? দাদি বলেন, কিভাবে? সে বলে, একটা কাগজের ঠোঙ্গায় রাস্তা থেকে লাল ধুলো ভরে নিয়েছিলাম। ঠোঙ্গার মুখে একটু হলুদ গুঁড়ো ছড়িয়ে দিতেই মনে হলো এটা একটা হলুদ ভর্তি ঠোঙ্গা। তারপর তেলাভোকে আসতে দেখে তার সামনে রাস্তায় রেখে দিয়ে আড়াল থেকে দেখলাম তেলাভো কি করে।

দাদি জিজ্ঞেস করলেন, কি করল সে? সেটি তুলে নিয়ে চলে গেলো। বলেই সে হি হি করতে শুরু করল সান্টু। দাদি সামান্য হাসলেন। তারপর বললেন, আর কখনো এরকমটা করো না। এটা ভালো না। মানুষ ঠকানো কখনোই ভালো না। তা ছাড়া তুমি এতো ভালো ছেলে, তুমি এটা কেনো করতে গেলে? তোমার কাছ থেকে এ রকমটা আমরা কেউ আশা করি না। গলায় সামান্য কাঠিন্য এনে দাদি বলেন, আর যেনো না শুনি। দাদি তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অন্য গল্প শুরু করলেন।

সান্টুর খুব মন খারাপ হলো, সে ভেবেছিল দাদি তার বুদ্ধির খুব তারিফ করবেন। তা না, বকা দিচ্ছে! সে বলে, সবাই যে তেলাভোকে খ্যাপায়। তখন তো কিছু হয় না। আমি কি খ্যাপাই? সেদিন পড়ে গিয়ে পেট-টেট ছুলে যাওয়ার পর আর খেপাইনি। বলেই জিভ কাটল সে। ফস করে মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে। এখন মাকে বলে দিলে তো মহাশর্বনাশ!

কাউকে খ্যাপানো ভালো না, বলেন দাদি। যাকে খ্যাপানো হয় তার কেমন লাগে একবারও ভেবে দেখেছ? সেদিন স্কুলে সবাই তোমাকে ‘সান্টু, খোলো তোমার প্যান্টু’ বলে খ্যাপাচ্ছিল। তোমার ভালো লেগেছিল? সান্টুর মনে পড়ে গেল প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিনটি। সে খানিকটা লজ্জা পেলো। সত্যিই তো, এমনটা সে একবারও ভেবে দেখেনি।

দাদি মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শান্ত গলায় বলেন, তুমি তো ভালো ছেলে। তাই তোমার বুদ্ধিগুলোও ভালো কাজে লাগাবে কেমন? এবার ঘুমাও। সে ঠিক করল আর কখনো কাউকে খ্যাপাবে না সে। কাউকে ঠকাবেও না। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে নিজেও জানে না।

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test