E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সোহেল নওরোজ’র গল্প

২০১৬ অক্টোবর ০৬ ১৮:০০:৪২
সোহেল নওরোজ’র গল্প







 

একটি লাল সাইকেল এবং কিছু সলজ্জ সাধ

একবার বাইরে বেরিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে আবার ঘরে ঢুকেছে লামিয়া। আজ শুক্রবার। স্কুলে যাওয়ার ভাবনা নেই। স্কুল থাকলে সময় কীভাবে পেরিয়ে যায় বোঝা যায় না। ছুটির দিনের সকালগুলো বরং দীর্ঘ মনে হয়। তালহা তার বছর খানেকের ছোট। সে আবার দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। ততক্ষণে লামিয়ার পুরো পাড়া একবার চক্কর দেওয়া হয়ে যায়। এবার বর্ষাকালে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। পাড়ার পুকুরগুলোতে স্বচ্ছ্ব জল টলমল করছে। তাতে সাদা হাঁসের দল ভেসে বেড়াচ্ছে। তাদের মধ্যে কী অদ্ভুত শৃঙ্খলা! স্কুলে পিটি করার সময় যেমন একই লাইনে দাঁড়িয়ে সারিবদ্ধভাবে চলতে হয়, হাঁসগুলোও তেমনি সারি বেঁধে পানির ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে। ছবির চেয়েও সুন্দর সে দৃশ্য। পুকুরের শেষ মাথায় একটা কদম ফুল গাছ। গাঢ় সবুজ পাতার ফাঁকে থোকায় থোকায় কদম ফুটে আছে। সেদিকে তাকালেই মন ভালো হয়ে যায়। সমস্যা বলতে একটাই। কিছু সময় বৃষ্টি হলেই গ্রামের রাস্তায় কাদা জমে। চলতে-ফিরতে তখন বেশ অসুবিধা হয়।

লামিয়া নানা বিষয় নিয়ে চিন্তা করে। আগে যা ভাবতো, তা-ই সবার কাছে প্রকাশ করতো। কিন্তু এখন সে বেশ ভেবে-চিন্তে, হিসাব করে কথা বলে। কারণ তার কথা শুনে অনেকেই আশ্চর্য হয়। কেউ আবার হেসে কুটিকুটি যায়। লামিয়া লজ্জা পায়। তালহা ছেলে হয়েও গাছে উঠতে পারে না, অথচ লায়িমা তরতর করে গাছে উঠে আম-লিচু পেড়ে আনে। প্রথম যেদিন তার মুখ থেকে বাড়ির লোকজন গাছে ওঠার কথা শুনেছিল, সবার চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। বলে কী এ মেয়ে! সে কেন গাছে উঠবে? মেয়ে হয়ে জন্মেছে কি গাছে ওঠার জন্য? পাছে গাছ থেকে পড়ে না জানি কোন দুর্ঘটনা ঘটায়! হাত-পা ভেঙে ঘরে পড়ে থাকে! হাত-পা ভাঙা মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে কী কী অসুবিধা তা-ও শুনতে হয়েছিল তাকে। সাময়িকভাবে খারাপ লাগলেও লামিয়া বিষয়টি মেনে নিয়েছিল। সে স্কুলে শিখেছে- গুরুজনের কথা মানতে হয়। তাদের ভক্তি করতে হয়। তারা নিশ্চয় তার মঙ্গলের কথা ভেবেই পরামর্শ দিয়েছেন।

গত বছর বর্ষাকালে তালহাকে সাঁতার শেখাতে বাবা রোজ পুকুরে নামতেন। এর আগে বাবা তার নিজের সাঁতার-বিষয়ক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। প্রথমে বুক সমান পানিতে সাঁতার শেখানোর চেষ্টা চলে। কিন্তু তালহা কিছুতেই সাঁতারের কৌশল রপ্ত করতে পারছিল না। পানির ওপরে ভেসে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করা এত কষ্ট, তালহাকে না দেখলে বোঝার সাধ্য কার! অথচ বাবার দেখানো কায়দায় অল্প সময়ের মধ্যেই লামিয়া সাঁতার শিখে ফেলে। তাই দেখে বাবা হো হো করে হেসে ওঠেন। ‘তুই না হয়ে লামিয়া ছেলে হলেই বোধ হয় ভালো হতো। আমাকে এত কষ্ট করতে হতো না। ও দেখা মাত্রই সাঁতার শিখে ফেললো।’- তালহাকে উদ্দেশ্য করে বলা বাবার কথাগুলো শুনে প্রথমে খুশিই হয়েছিল লামিয়া। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, ‘সে ছেলে হলে ভালো হতো’-বাবার কথার এ অংশ পুরোপুরি সঠিক নয়। মেয়েদের কি ছেলেদের আগে সাঁতার শেখা অন্যায়? তা তো নয়। তবে এটা নিশ্চয় তার কৃতিত্ব। ভাবনা থেকে সরে আসে লামিয়া। সে আগে শিখে ফেলায় একটা লাভ ঠিকই হয়েছে। বাবাকে আর রোজ পুকুরে নামতে হবে না। এখন সে-ই তালহাকে শেখাতে পারবে।

লামিয়া আর তালহা একই স্কুলে পড়ে। ওদের স্কুল বাড়ি থেকে বেশ দূরে। স্কুলে যাওয়ার রাস্তা কাঁচা। সে রাস্তায় সাইকেল বাদে অন্য যানবাহন চলে না। রোজ হেঁটে এতটা পথ যেতে দুজনারই খুব কষ্ট হয়। ঈদের আগে তাই তালহা বাবার কাছে আবদার জানায়- ঈদ উপলক্ষ্যে সে কোনো জামা-কাপড় নেবে না। তাকে একটা বাইসাইকেল কিনে দিতে হবে। লামিয়া যোগ করেছে, সাইকেল হতে হবে লাল রংয়ের। যেটিতে চড়ে তারা স্কুলে যেতে পারবে। যেহেতু সাইকেলে চড়ে লামিয়াও স্কুলে যাবে, তাই তাকেও ছাড় দিতে হবে। ঈদে সেও বাবার কাছ থেকে কিছুই নেবে না। নতুন সাইকেলে চেপে স্কুলে যাবে- ভাবতেই লামিয়ার মন খুশিতে নেচে ওঠে। জামা-কাপড় তো প্রতি ঈদেই পেয়ে থাকে। গত ঈদেরটা দিয়ে এবারও চালানো যাবে। সাইকেল হলে তাদের স্কুলে যাওয়ার কষ্ট অনেকটাই লাঘব হবে। আচ্ছা, মেয়েদের সাইকেল চালানোর ব্যাপারে কি কোনো বিধি-নিষেধ আছে? সেও কি পারবে তালহার মতো সাইকেল চালাতে? প্রশ্নটা ঘুরেফিরে বারবার লামিয়ার মনের মধ্যে ঊঁকি দেয়। কিন্তু সংকোচে কাউকে বলতে পারে না।

ঈদের দিন দশেক আগে তালহাকে নিয়ে বাবা শহরে যান। লামিয়ারও খুব ইচ্ছা করছিল তাদের সঙ্গে যেতে। তাহলে তার পছন্দ-অপছন্দ বাবাকে বলতে পারতো। কিন্তু পরে বাবা কী না কী বলেন, তা ভেবে আর বলা হয়নি। তবে পুরো সময়টা জুড়ে সে দারুণ উত্তেজনা অনুভব করছে। যেন তালহার নয়, তার জন্য নতুন সাইকেল কেনা হচ্ছে! লামিয়ার একটা লাল জামা আছে। সেই জামা পরে লাল সাইকেলে চড়লে তাকে দেখতে নিশ্চয় দারুণ লাগবে। নতুন সাইকেলে চেপে স্কুলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সহপাঠীদের কাছে বলতে পারবে। তার বান্ধবীদের কেউ কেউ অবশ্য অভিভাবকদের সঙ্গে সাইকেলে করে স্কুলে আসে। তালহার দু-একজন বন্ধুরও সাইকেল আছে। দু-একদিন অন্যদের সাইকেলে আসা দেখে তার যে আফসোস হয়নি, তা নয়। কিন্তু সে বাবার সাধ্যের কথা ভেবে তার অনেক অপ্রকাশ্য সাধের মতো এটাও চেপে গেছে। তবে এবার সত্যি সত্যি তার সে শখ পূরণ হতে চলেছে! আজই বাড়িতে নতুন সাইকেল আসছে। তাও টুকটুকে লাল রংয়ের।

সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে বাবা আর তালহা বাড়ি ফেরে। সাইকেল কেনা হয়েছে, তবে একেবারে নতুন নয়। সেকেন্ডহ্যান্ড। সাইকেলের দু-এক জায়গা থেকে রং চটে গেছে। চাকাগুলোও দেখতে পুরনো লাগছে। লামিয়ার মুখের দিকে তাকিয়েই বাবা যেন ভেতরটা পড়ে ফেললেন। ‘নতুন সাইকেলের দাম অনেক বেশি। এটা সেকেন্ডহ্যান্ড হলেও কন্ডিশন ভালো। তেল দিয়ে ভালো করে মুছলে নতুনের মতোই লাগবে। আপাতত এটা দিয়েই চলুক। পরে না হয় এটা বেঁচে নতুন আরেকটা কেনা যাবে।’ বাবার কথা যৌক্তিক। তাছাড়া সামর্থ্য থাকলে তিনি নতুন সাইকেলই কিনতেন। বাবার মুখ থেকে কথাগুলো শোনার পর সাইকেলটা দেখতে ততো খারাপ লাগছে না। এতক্ষণে আরেকটা ব্যাপার তো মাথায়ই আসেনি। পুরনো হলেও সাইকেলের রং লাল। যার অর্থ বাবা সাইকেল কেনার সময় লামিয়ার পছন্দের বিষয়টিও বিবেচনায় রেখেছিলেন! তাকে কেউ গুরুত্ব দিলে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। এখন যেমনটি হচ্ছে।

সাইকেল কেনার এক সপ্তাহ হতে চললো, অথচ তালহা ভালো করে চালানো শিখতে পারেনি। বাবা অবসর সময়ে শেখান। কিন্তু কিছুদূর গিয়েই তালহা পড়ে যায়। বাবা অভয় দেন- ‘হাঁটতে শেখার সময় যেমন আছাড় খেতে হয়, সাইকেল চালানোর শুরুতেও তেমনি পড়ে গিয়ে দু-এক জায়গায় ব্যথা পেতে হয়। তবে ধৈর্য্য হারালে চলে না।’ সাইকেল চালানোর কৌশলগুলো লামিয়া গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। পরদিন তালহার ঘুম ভাঙার আগে সাইকেলটা নিয়ে সে সন্তর্পণে বের হয়। বাড়ির পেছনের দিকের ফাঁকা জায়গায় বাবার নির্দেশমতো সাইকেল চালাতে চেষ্টা করে। আশ্চর্যের বিষয়, তালহা ভালোভাবে কলাকৌশল আয়ত্ত্ব করার আগেই লামিয়া চালাতে শিখে যায়! ব্যাপারটা যেন কেউ টের না পায়, সে জন্য তালহা ঘুম থেকে জাগার আগেই পূর্বের জায়গায় সাইকেলটা রেখে দেয়।

কাল রাতে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তা-ঘাটের কাদা এখনো পুরোপুরি শুকায়নি। তালহার সাইকেল চালাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। লামিয়া আজ লাল জামাটা পরে এসেছে। তালহা বলেছেÑ তাকে দেখতে লাল পরীর মতো লাগছে। পরীরা দেখতে কেমন হয় লামিয়ার অজানা। তবে এটা যেহেতু সুন্দরী অর্থে ব্যবহৃত হয়, তাই তাকে যথেষ্ট সুন্দর লাগছে বলাই যায়। লামিয়া যখন পরী-বিষয়ক ভাবনায় বিভোর, ঠিক তখনই ঘটে দুর্ঘটনা। সাইকেলের চাকা পিছলে দুজনেই কাদার ওপর পড়ে যায়। কেউ তেমন ব্যথা না পেলেও জামা-কাপড় কাদায় মাখামাখি হয়ে যায়। লামিয়ার লাল জামা কাদায় লেপ্টে যায়। কাছাকাছি একটা পুকুর দেখতে পেয়ে দুজনেই যতটা সম্ভব কাপড় থেকে কাদা ধুয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তালহা আর সাইকেল চালাতে রাজি হয় না।

বোঝা যাচ্ছে, ওর মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। তাই বাকিটা পথ হেঁটে যেতে চায়। ঠিক তখনি লামিয়া সাইকেল চালানোর ইচ্ছার কথা বলে। শুনে তালহা যেন আকাশ থেকে পড়ে। লামিয়া চালাবে সাইকেল! এটা কি সহজ কোনো কাজ? না শিখে এত বড় ঝুঁকি কেন নিবে? তালহার আপত্তি থাকলেও লামিয়ার চাপাচাপিতে রাজি না হয়ে পারে না। লামিয়া আর দেরি করে না। সাইকেলের সিটে চড়ে বসে। অনেকদিনের অভিজ্ঞতা থাকলে যেভাবে চালানো সম্ভব সেভাবেই চালাতে থাকে। তালহার মনে হয়, লাল জামা পরা পরী বোন তাকে পঙ্খীরাজে চড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেভাবেই শিখুক না কেন, লামিয়া সাইকেল চালাতে পারায় তার বিরাট উপকার হয়েছে। সে অসুস্থ থাকলে কিংবা আজকের মতো পড়ে গেলে, লামিয়া চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। তালহার কথা শুনে লামিয়া হেসে ওঠে। নিষ্পাপ সে হাসিতে নির্মল আনন্দ দোল খায়। চোখে-মুখে চাপা খুশি ঠিকরে পড়ে। সলজ্জ সাধের মতো উচ্ছ্বাসটাও চেপে রেখে আপাতত সে সাইকেল চালানোয় মন দেয়।

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test