E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ইবনুল কাইয়ুম’র গল্প

২০১৬ নভেম্বর ০৪ ১৬:১৫:১৯
ইবনুল কাইয়ুম’র গল্প







 

সান্টুর স্কুল গমন

প্রথম স্কুলে যাবে সান্টু। তার স্কুলে যাবার কথা কয়েকদিন থেকেই বাড়ির বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই সঙ্গে তার মনের ভেতরেও এক ধরনের আউলা বাতাস খেলা করে বেড়াচ্ছে। বাতাসের ধরনটা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। বাড়িতে নতুন কিছু রান্না হলে বা রাতে বাবা খাবার কিছু নিয়ে এলে ঠিকই বাতাস বুঝে ফেলে সে। অথচ এ বাতাসটা বুঝে উঠতে পারছে না।

বাড়িতে মা এবং দাদি তো ব্যাপক উৎসাহ দিচ্ছেন। দাদি বলেন- ওরে বাবা, আমাদের ফুলবাবু তো এবার বড় গেল দেখছি। স্কুলে যাবে। নতুন নতুন বন্ধু হবে, নতুন নতুন বই পড়বে। খুব মজা হবে। এ কথাগুলো শুনে সান্টুর ছোট্ট মনটি স্কুলের রঙিন রঙিন ছবিতে ভরে ওঠে। স্কুলে যাবার জন্য মনের ভেতরে হালকা ছটফটানি বোধ করে সে।

বিকেলে নদীর ধারে খেলতে গেলে ওপাড়ার দেলু বলল, স্কুলে যাবি মার খাতি? মাস্টারগুলো খালি লম্বা লম্বা লাঠি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। পড়া না পারলি ঠাস ঠাস। বলে ব্যথা পাবার নানান ভঙ্গিমা করে। দেলুর নাম আসলে দেলোয়ার রহমান। কুচকুচে কালো গোলগাল চেহারার এই ছেলেটিকে কেউ আর দেলায়ার বলে অযথা সময় নষ্ট করে না। সংক্ষেপে এবং সময় বাঁচাতে দেলু নামটাই যথেষ্ট। সেও তা মেনে নিয়েছে। সে আরো বলে, এই দেখ সেদিন পড়া পারিনি বলে হেডস্যার মেরে লাল করে দেছে। বলে হাফপ্যান্টটা পিছনে হালকা নিচের দিকে টেনে দেখাল। সান্টু উৎসুক হয়ে দেখল দেলুর ওই অংশের কালো চামড়া কালোই আছে, সেখানে লালের কোনো চিহ্ন নেই। তবু সে খানিকটা ভয় পেলো।

পাশে থাকা রফিকুল বলল, শুধু হেডসাার না, খালেক স্যারকে চিনিস? মেরে আলু ভর্তা করে দেয়। আর উহাব স্যারের চড় খালি দাঁত আর দাঁতের জাগায় থাকপে না। সুবান স্যারের হাতে একটা বাড়ি খালি নীল হয়ে যাবে তোর পাছা। জিজ্ঞেস করে দেখ ওদের কাছে। বলে পাশে খেলতে থাকা অন্যদের দেখিয়ে দিল। সে আরো নানানভাবে সান্টুকে স্কুলের বর্ণনা করতে লাগল। যা শুনল, তাতে স্কুলটাকে লাল-নীল নানা রকম ভয়ের আস্তানা মনে হতে লাগল সান্টুর কাছে।

এতো দিন ভালই ছিল, স্কুলে যাওয়ার কথা কেন এবং কে বাড়িতে ওঠালো এই ভেবে তার খুব রাগ হতে লাগল। দিব্যি ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে খেয়ে দেয়ে কোনো রকম অক্ষর বিদ্যার সঙ্গে পরিচিতি নিয়েই মার্বেল অথবা লাটিম নিয়ে পাড়ায় হারিয়ে যাওয়া। দুপুরে বন্ধুদের সঙ্গে নদীতে চোখ লাল করে হাপুস দেওয়া।

দুপুরে সবাই ঘুমিয়ে গেলে পা টিপে টিপে বেরিয়ে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হই হই। বিকেলে হাঁটু পর্যন্ত ধুলো মেখে খেলেধুলে সেই সন্ধ্যে বেলায় দুরু দুরু বুকে ঘরে ফেরা। ফিরেই দাদির আঁচলের তলায়। দাদি সে সময় বলেন, কিরে ফুলবাবু এতক্ষণ কোথায় ছিলি? মা তোকে খুঁজছে- বলতেই বুকের কাছে রক্ত ছলাৎ করে ওঠা। তার শুকনো মুখ দেখে দাদি বলেন, জলদি হাত মুখ ধুয়ে আয় পড়তে বসতে হবে। এ কথা শুনে টচজলদি হাতমুখে পানি ছিটিয়ে অর্ধেক ধুলো সমেত পায়ে বই নিয়ে তাড়াতাড়ি পড়তে বসা।

এই একটা বই-ই সে কয়েক মাস থেকে পড়ছে। প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছে বইটা। তবুও জোরে জোরে আওড়াতে থাকা। মা এসে হাত ধরে টেনে তুলে আবারো কল তলায় নিয়ে গিয়ে আচ্ছা মতো ডলে ডলে প্রায় গোসল করিয়ে দেন। আর একই সঙ্গে নানান ধরনের শাসন ও হুমকি ধামকি চালান। পরে আবার পড়তে বসা। খানিক না যেতেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়া। ঘুমন্ত মানুষকে টেনে তুলে জোর করে খাইয়ে দেওয়া। খাওয়া ও ঘুম এক সঙ্গে চালিয়ে যাওয়া। পরে কোনো রকম খেয়েই ঘুমে অচেতন। সকালে দাদির ‘ফুলবাবু’ ডাকে ঘুম ভাঙা। তারপর আগের দিনের পুনরাবৃত্তি। ভালই চলছিল। কে যে স্কুলে যাওয়ার কথা বলল!

মাঝে মাঝে আচার বা কুল চুরি করে খেতে গিয়ে মায়ের হাতে মার খেয়েছে সে। মার খেয়ে দাদির আঁচলের তলায় লুকিয়েছে। আসলে মার খেয়ে সহ্য করে গেছে সে। তবে দাদি স্নেহ মাখা গলায় যখন জিজ্ঞেস করতেন, কি হয়েছে? তখন একেবারে গলা ছেড়ে ভ্যা...। দাদি হেসে বলতেন, একটু আধটু প্যাদনি না খেলে শক্ত হবি কি করে? মা কি খুব জোরে দিয়েছে? অনেকক্ষণ ফোঁপানোর পরে স্বাভাবিক হয়ে মাথা নাড়ত সে। বেশি জোরে মারেনি। শুধু কান মলে দিয়েছে। সেটাই একটু লাল হয়ে আছে এই যা।

বাবার কাছে এসব টুকিটাকি নানান অভিযোগ গেলেও বাবা কোনোদিন কিছু বলেননি। শুধু হালকা করে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন। দৃষ্টির সেই তাপেই গলে যাবার দশা তার। আর স্কুলে পেছন লাল-নীল করা প্যাদানি দিলে কি হবে সেটাই ভাবছিল সান্টু। রঙিন ঝলমলে একটা স্বপ্নময় স্কুলের আরেকটা চেহারা মাঝে মাঝেই ভেসে উঠতে চাইছিল মনের কোণায়।

রাতে দাদির কাছে শুয়ে গলা জড়িয়ে ধরে কানে কানে সে বলে, দাদি, স্কুলে স্যারেরা নাকি খুব মারে? দাদি হেসে বলেন, কে বলেছে? দেলু। কি বলেছে? দেলু বলেছে স্যারেরা ওকে মেরে নাকি লাল করে দিয়েছে। আর রফিকুল বলেছে নীল করে দেয়। দাদি বলেন, ওরা নিশ্চয়ই পড়া পারেনি অথবা কোনো দুষ্টুমি করেছে। তার শাস্তি হিসেবে স্যার শাসন করেছেন। যাতে আবারো ওমনটা করলে বা পড়া না করলে এই শাস্তির কথা মনে থাকে। এমনি এমনি স্যারেরা কাউকে মারেন না। পড়া পারলে আদর করেন। দাদি আরো বলেন, তুমি তো অনেক ভালো ফুলবাবু, পড়া করবে সবসময়। দুষ্টুমি করবে না। তাহলে তোমার কোনো ভয় নেই। এখন ঘুমাও। সে রাতে ভালই ঘুম হলো সান্টুর।

কয়েকদিন পর সান্টু বাবার হাত ধরে স্কুলে চলেছে। এ কয়দিনে দাদি ভালই বুঝিয়েছেন। মা তাকে ভালো করে বিদ্যাসাগরের বর্ণমালা আর এক থেকে একশো গোনা শিখিয়েছেন। সান্টু কৈ খৈ গৈ ঘৈ পর্যন্তও পারে। কিছুটা ভয় আর অজানা উত্তেজনা নিয়ে স্কুলে চলেছে সে। স্কুলে পৌঁছে সে দেখল, লম্বা বারান্দা ওয়ালা দোতলা একটা বাড়ি। বাড়ির উঠোনে অনেক ছেলে মেয়ে খেলে বেড়াচ্ছে। কিচির মিচির শব্দে কান পাতা দায়। কোথায় যেনো ঢং ঢং একটা শব্দ হলো। ওমনি ছেলে-মেয়েরা সবাই দৌড়ে ঘরে গিয়ে উঠল। সান্টু অবাক হয়ে দেখল ঘরে কোনো খাট নেই। কেবল কয়েটা লম্বা লম্বা বেঞ্চ। এগুলোকে বেঞ্চ বলে সেটা পরে জেনেছিল সে। আর একটা চেয়ার এবং একটা টেবিল। এমনি কয়েকটা ঘর পেরিয়ে আরেকটা বড় ঘরে গিয়ে পৌঁছল সে।

সে ঘরে অনেকগুলো টেবিল আর চেয়ার। সুন্দর করে সাজানো ঘরটা। কয়েকজন নারী পুরুষ বসে আছেন সেখানে। সেখানে ঢুকে বাবা সবাইকে সালাম দিলেন। সবাই বাবাকে কেমন আছেন তা জানতে চাইলেন। আরো কত কথা। বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে কয়েকজন সান্টুর দিকে তাকাচ্ছিলেন। একজন হাসি মুখে বলে উঠলেন, এই বুঝি তোমার দস্যি? বাবা বললেন, হ্যা স্যার। নিয়ে এলাম আজ। ভর্তি করিয়ে নিন। হাসি মাখা কয়েকটি মুখ দেখে মনে অনেক সাহস হলো সান্টুর। দেলু আর রফিকুলের কথা মনে পড়তে একটু হাসল সে। একজন একটা খাতায় তার লিখে নিলেন। স্যারেরা বললেন, ভর্তি তো হলো। আজ তাহলে অল্প কিছুক্ষণ ক্লাস করুক, সবার সঙ্গে পরিচিত হোক।

হেড স্যার শুকুর বলে জোরে ডাক দিলেন। দৌড়াতে দৌড়াতে ১৫/১৬ বছরের একটি ছেলে রুমে ঢুকল। স্যার বললেন, ওকে নিয়ে বড় ওয়ানের ক্লাসে নিয়ে যাও। শুকুর তাকে নিয়ে ক্লাসের দিকে চলল। সে ভেবেছিল তার সঙ্গে বাবাও আসবেন। বাবা আসলেন না। বললেন, স্কুল ছুটি হলে নিয়ে যাব। তুমি ক্লাসে যাও। অজানা আশঙ্কা নিয়ে দুরু দুরু বুকে ক্লাসের দিকে চলল সান্টু। শুকুরের দিকে চেয়ে দেখল, সে মিটি মিটি হাসছে।

ক্লাসরুমে গিয়ে সান্টু দেখতে পেলো মোটামতো একজন লোক কি যেনো পড়াচ্ছেন। সে বুঝে নিল এই লোকটিই স্যার হবেন। সে দরজায় গিয়ে সালাম দিল। মা আগেই শিখিয়ে দিয়েছিলেন। শুকুর বললো, স্যার এ এই ক্লাসে নতুন ভর্তি হয়েছে। স্যার তাকে ভেতরে গিয়ে বসতে বললেন। কোথায় বসবে সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কিছু দূর গেলেই ‘সান্টু’ ডাক শুনে সেদিকে তাকাল সে। তাকিয়ে দেখে পেছনের সারির একটি বেঞ্চ থেকে দেলু দাঁত বের করে আছে। কালো চেহারার মধ্যে একপাটি সাদা মানিক ঝলকাচ্ছে যেনো। দেলুকে সে এখানে আশা করেনি। মুখে কাঁপা হাসি নিয়ে সান্টু তার দিকে এগিয়ে গেল।

সেদিন স্কুল থেকে ফিরে সান্টু সোজা দাদির কাছে। আজই প্রথম স্কুলে যাওয়া ওর। স্কুলের গল্প বলতে যেন তর সইছিল না। দাদিও যেন সেই অপেক্ষাতেই ছিলেন। হাসতে হাসতে দাদি বলেন, কিরে ফুলবাবু, কেমন কাটলো প্রথম দিনের স্কুল? মাস্টারেরা মেরে লাল করে দিয়েছে? কোথায় লাল হলো দেখি? বলে সান্টুকে ধরতে উদ্যত হলেন। সান্টু আদুরে হাসি হেসে দাদির কোলে গিয়ে গড়িয়ে পড়ল। বলল, মাস্টররা খুব ভালো, মারেনি। আর দেলুও আছে আমাদের ক্লাসে। অনেক বন্ধু হয়েছে দাদি।

চোখে মুখে আনন্দের ঢেউ তুলে বকবক করে চলল সান্টু। তার কথা যেন শেষ হবে না আজ। মা এসে একবার দেখে গেলেন। বললেন, খুব গল্প হচ্ছে বুঝি? তা হাত মুখ ধুয়ে এসে গল্প জমালে ভালো হতো না? যাও হাত-পা ধুয়ে এসো। সান্টুর যেতে ইচ্ছে হলো না। সে দাদির গলা জড়িয়ে ধরে বলে, একটু পরে যাচ্ছি মা। মা চলে গেলেন। আবার চলল গল্পের তুফান। খানিক পরে মা এসে নারকেল কোরানো আর গুড় দিয়ে মাখা চাল ভাজা দিয়ে গেলেন। এটা সান্টুর প্রিয় খাবারের মধ্যে অন্যতম একটা। অন্যদিন বায়না করেও পায় না। আর আজ মা নিজেই উপযাচক হয়ে দিয়ে গেলেন! ভাবতে পারছে না সে। এটা কিভাবে হলো!

এতোকিছু ভাববার সময় তার নেই। হাতে নিয়েই মুখে পোরা শুরু করে সে। দাদি পাশে রাখা পানির জগ এগিয়ে দিয়ে বলেন, হাত দুটো আগে ধুয়ে নে। হাত ধুয়ে খেতে খেতে সান্টু বলে- জানো দাদি, স্কুলে না অনেক ছেলে মেয়ে। আমি যে ক্লাসে ভর্তি হয়েছি, সেখানে ম্যালা ছেলে আছে। মেয়েও আছে অনেকগুলো। একটা মেয়ে খুব পড়া পারে। স্যারেরা শুধু ওকেই পড়া ধরে। আর ও পটাপট বলে দেয়। আর ছেলেরা একটু কম পারে। পড়া ধরলে মাথা নিচু করে থাকে।

ছেলেগুলো খুব পচা। ওরা খালি যাকে তাকে খেপায়। আমার নাম শুনে বলে- সান্টু, খোলো তোমার প্যান্টু। বারবার একই কথা বলে, আর মেয়েরা খালি হাসে। দাদি বলেন, তুই কি বললি? আমি কোনো কথা বলিনি। চুপচাপ ছিলাম। খালি কান্না লাগছিল। দেলু বলল, ‘চুপ করে থাক। উরা পাশের গিরামের। ওদের সঙ্গে মারামারি করে পারা যাবে না। স্কুল ছুটি হলি আমাদের গিরামের বড় ভাইদের বলে কাল মার খাওয়াব।’

আমি আর ওদের সঙ্গে কথা বলব না দাদি। দাদি বলেন, এতেই এতো ভেঙ্গে পড়লে চলে? তুই শুধু পড়া লেখায় মন দিবি। ভালো পড়া পারলে কেউ তোকে কিছু বলবে না। আর মারামারি করার কোনো দরকার নেই। যারা খেপাচ্ছে, একদিন দেখবি তারা তোর বন্ধু হয়ে যাবে। তুই না খেপলেই হলো। দাদির কথা শুনে মনে সাহস পেলো সান্টু। রাতে আব্বা নতুন নতুন বই কিনে আনবে বলেছেন। সেই আনন্দে বিভোর হয়ে রইল সে।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test