E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দায়িত্বশীল সংবাদ প্রকাশের অনুরোধ : জয়শ্রীর ৫০ বন্ধু ও সহকর্মী

২০১৪ সেপ্টেম্বর ১৯ ২০:৩৮:৫০
দায়িত্বশীল সংবাদ প্রকাশের অনুরোধ : জয়শ্রীর ৫০ বন্ধু ও সহকর্মী

নিউজ ডেস্ক : সম্প্রতি দুই সন্তানহারা সাংবাদিক জয়শ্রী জামানকে নিয়ে কিছু গণমাধ্যম দায়িত্বহীনভাবে কুৎসা রটনা করছে। এর প্রতিবাদ জানিয়ে শোকবিধ্বস্ত জয়শ্রী জামানের প্রতি সমবেদনামূলক এবং দায়িত্বশীল সংবাদ প্রকাশের জন্যে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন জয়শ্রী জামানের  ৫০ জন বন্ধু ও সহকর্মী । বৃহস্পতিবার এক বিবৃতির মাধ্যমে তারা সদ্য সন্তানহারা মায়ের আর্তচিৎকার অন্তরের অন্ত:স্থলে ধারণ করে সহকর্মীর চরম দু:সময়ে সাংবাদিকতায় পেশাদারীত্ব প্রত্যাশা করেন। শুক্রবার দিনব্যাপী চ্যানেল আইতে এই আবেদন প্রচার করা হয়। বিভিন্ন অনলাইনেও এই বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। বিবৃতিটি এখানে তুলে ধরা হলো।

দু’ দিন ধরে দুঃসহ সময় পার করছি আমরা। সাংবাদিক জয়শ্রী জামান ও আলীমুল হকের দুই সন্তান চিরশ্রী জামান মনমন (১৭) ও মোহাম্মদ বিন আলীম (১৫) গত সোমবার আত্মহত্যা করলে শুধু সাংবাদিক সমাজই না গোটা দেশ শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে। জয়শ্রী ও আলীমুলের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে বেশ ক’বছর আগে। তাদের দুই সন্তানের একসঙ্গে আত্মহত্যার ঘটনাটি বাবা-মায়ের বন্ধন অটুট না থাকলে যে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে, সেই নির্মম সত্যটাই প্রমাণ করে দিয়েছে। অথচ এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়ার বদলে আমরা মেতে উঠেছি কুৎসিত সাংবাদিকতায়। নারীর চরিত্র হননে মত্ত হয়েছে আমাদের গণমাধ্যমের একটি অংশ। কয়েকটি পত্রিকায় এই ঘটনায় আঙ্গুল তোলা হয়েছে জয়শ্রী জামানের দিকে, যা আমাদের ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে।

একইরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত। সাংবাদিকতার নীতির বাইরে গিয়ে কল্পিত গল্পগাথা যে সমাজকে বিভ্রান্ত করতে পারে সে কথাটাও আমরা ভুলে গেছি। ২০১১ সালে স্বামীর নির্যাতনের শিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোমানা মঞ্জুরের কথা আমরা এখনো ভুলে যাইনি। রোমানার স্বামী হাসান সাইদ মারা যাবার পর পুরো পরিস্থিতিই বদলে গেল। রোমানা ওপর হওয়া অত্যাচারের কথা সমাজ, গণমাধ্যম ভুলে গেল। তখন প্রকাশিত হতে থাকলো কথিত “ইরানি বন্ধুর” সঙ্গে রুমানা মঞ্জুরের ছবি আর সূত্রবিহীন মেইল। অথচ রুমানা দেশের বাইরে পড়াাশুনা করছিলেন। তখন যে কারো সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠতেই পারে। এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এজন্য তো তার ওপরে করা অত্যাচার জায়েয হয়ে যায় না।

আমরা ভুলে যাই নি ২০১০ সালে জুরাইনে দুই সন্তান নিয়ে মায়ের আত্মহত্যার কথা। সেখানেও একজন নারী সাংবাদিককে নিয়ে বিস্তর লিখেছে গণমাধ্যম। কয়েকটা দিন পার হওয়ার পর দেখলাম, মূল ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে দেদারসে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে লিখা হচ্ছে সেই নারী সাংবাদিককে নিয়ে। আত্মহত্যার মূল ঘটনাটি লিখতে মজা না পেয়ে নারী সহকর্মীকে নিয়ে হলুদ সাংবাদিকতাতেই বিকৃত আনন্দ ছিলো অনেকের। সমুদ্র সৈকতে কিংবা ঘরের ভেতরে তোলা টিশার্ট পরা ছবি দিয়ে সেই ঘটনার আপডেট জানানো হয়েছে বহুদিন।

ঐশীর ঘটনাটিও আমাদের সমাজকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াটাই যেন একমাত্র কারণ ছিলো কিংবা জিন্স-টিশার্ট। ঘটনার মূলে যাওয়ার চেয়ে ঐশীকে নিয়ে লেখালেখিই আনন্দের বিষয় ছিলো অনেকের। লক্ষ্য ছিল জিন্স-টিশার্ট পরা টিনএজ একটি মেয়ের ছবি দিয়ে নিউজ করে পত্রিকার পাঠক আর অনলাইনগুলোর হিট বাড়ানো।

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি নিহত হওয়ার পরও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আমাদের প্রিয় বন্ধু-সহকর্মী রুনির মৃত্যুর পর কতো কথা শুনেছি। হ্যাঁ...সব কথাই হয়েছে রুনিকে নিয়ে(প্রিয় বন্ধু সাগরকে নিয়ে বললেও সেটা সুখকর হতো না আমাদের কাছে)। রিপোর্টের লাইনে লাইনে রুনির চরিত্র হনন করা হয়েছে নানা ভাবে। যার কারণে এখনো আমরা সাগর-রুনি হত্যারহস্য জানতে পারি নি। তবে রুনির বেলায় আমরা রুনির বন্ধু-সহকর্মী ও স্বজনেরা প্রতিবাদ করেছিলাম। জয়শ্রী জামানকে নিয়ে লেখা সংবাদগুলোর বেলায়ও আমরা একযোগে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। জয়শ্রীর দুই সন্তানের আত্মহত্যার ঘটনা তো প্রত্যেক অভিভাবকের বিবেককে জাগিয়ে তোলার কথা। নিজের সন্তানের নিরাপদ জীবনের জন্য সচেতন হয়ে উঠার কথা।

আমাদের মনে রাখতে হবে, বাচ্চা দুটি ছিল জয়শ্রী জামানের প্রাণ। এই দুই সন্তানের জন্যই জয়শ্রী জামানকে ছুটে বেড়াতে হতো রাজধানীর এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। মনমন আর আলীমকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চেয়েছিল জয়শ্রী। আজ যখন ওরাও চলে গেলো তখন তার আর তো হারাবার কিছু নেই। তবুও সব হারানো নি:স্ব জয়শ্রীকে আমরা বাঁচতে দিচ্ছি না। একজন সন্তানহারা মায়ের আর্তচিৎকার আমাদের কর্ণকুহরে পৌঁছে না। আমরা মানবিকতার হাত প্রসারিত করে তার পাশে দাঁড়াইনি। বরং কিভাবে তার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল ‘সম্মানটুকু’ ধুলিসাৎ করা যায় সেজন্য যেনো কেউ কেউ আদাজল খেয়ে লেগেছে। যার সব হারিয়েছে তাকে চরম অনৈতিক ,অশালীন এবং অন্যায়ভাবে দায়ী করা হচ্ছে । হায়রে সাংবাদিকতা!

অত্যন্ত মেধাবী চীরশ্রী জামান মনমন ও আলীমকে নিয়েই দু‘চোখে রঙিন স্বপ্ন ছিল জয়শ্রীর। মনমন চারটি স্টার মাকর্সসহ ‘এ’ পেয়েছিল ‘ও’ লেভেলে। গিটার বাজাতো। জাপানী ভাষা জানতো। মনমনও মায়ের মতোই বিনয়ী ও ভদ্র ছিল। অথচ ওই দুটি বাচ্চাকে ‘মাদকাসক্ত’ বানানোর অপচেষ্টা হয়েছে। বুধবার কিছু পত্রিকা লিখেছে,“বাবা তাদের জীবন থেকে আগেই চলে গেছেন। মাও সে পথেই হাঁটছেন।” মা' যে সে পথে হাটঁছেন এটা কিসের ভিত্তিতে বলছে পত্রিকাগুলো?

অথচ কম্যুনিটির প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে এবং ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে দূরে সরে না থেকে আমরা যদি জয়শ্রী-আলীমুলের সাজানো সংসারটি ধরে রাখার চেষ্টা করতে পারতাম তা হলে হয়তো আজ দুটি মেধাবী শিশুকে অকালে ঝরে যেতে হতো না। আমরা যদি জয়শ্রীর চাকরী টি স্থায়ী করতে সহযোগিতা করতে পারতাম, অথবা মেধাবী মেয়ে চীরশ্রীর জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে পারতাম তা হলে হয়তো সন্তান দু‘টিকে নিয়ে আরেকটু ভালোভাবে থাকতে পারতো জয়শ্রী। এই সন্তানদেও মনে ও কোন হতাশা জন্মাতো না।

ডনজেদেও বিচ্ছিন্নতা এবং ব্যর্থতা নিয়ে আমাদের মধ্যে অনুতাপ তো নেই-ই, কেউ কেউ দু:খজনক বিষয়টিকে মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে ‘সংবাদ পণ্য’ করার চেষ্টা করছেন। সমাজের বিবেক, সমাজের দর্পণ হিসেবে যারা কাজ করছেন, তারা কি দয়া করে একবার ভেবে দেখবেন বিষয়গুলো? আমাদের বিবেক জাগ্রত হোক।

আমরা জয়শ্রী জামানের বন্ধু ও সহকর্মীরা:- দিল মনোয়ারা মনু, ইখতিয়ারউদ্দিন, ফরিদা ইয়াসমিন, মাহমুদ হাফিজ, কাওসার রহমান, সুপ্রীতি ধর, পারভীন সুলতানা ঝুমা, ফজলুল বারী, জাহিদ নেওয়াজ খান, শারমীন রিনভী, প্রভাষ আমিন, ইলিয়াস খান, মানস ঘোষ, রানা হাসান, অঞ্জন রায়, মেনন মাহমুদ, শাহনাজ গাজী, ফাতেমা জোহরা হক কাকলী, সুমি খান, গোধূলী খান, জুলহাস আলম, রোজিনা ইসলাম, জাহানারা পারভীন, নাদিরা কিরণ, জাকিয়া আহমেদ, ইশরাত জাহান ঊর্মি, সাবরিনা সুলতানা চৌধুরী, তানবীর সিদ্দিকী, শাহেদা ফেরদৌসী, ফারহানা লাকি, মুনমুন শারমীন শামস্, জেসমিন পাপঁড়ি, সাজু রহমান, লীনা পারভীন, মোরসালিন মিজান, তাসকিনা ইয়াসমিন, লাবনী গুহ রায়, দৌলত আক্তার মালা, শামীম আরা শিউলি, সুলতানা রহমান, ফারহানা মিলি, সেবিকা দেবনাথ, রুখসানা ইয়াসমিন, সাবরিনা করিম মোর্শেদ, আঙ্গুর নাহার মন্টি ,ঝর্ণামনি, আগুন সহমিকা, আলফা আরজু।

(অ/সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test