E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজের সংযুক্তি ছাড়া প্রেসক্লাব সংকট কাটবে না

২০১৫ মে ২২ ১৭:১৬:৩৯
বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজের সংযুক্তি ছাড়া প্রেসক্লাব সংকট কাটবে না

পুলক ঘটক : জাতীয় প্রেসক্লাবের কমিটির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করায় সংকট আরও ঘনিভূত হয়েছে। এরকম বাস্তবতায় সংগঠনটি কিভাবে চলবে তার কোনও দিক নির্দেশনা এর গঠনতন্ত্রে নেই।

রাষ্ট্রীয় আইন এবং সাংবাদিকদের সদিচ্ছায় নিশ্চয় এর একটা সমাধান আসবে। তবে সমাধানটি হওয়া উচিৎ বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজের স্বার্থে; মুষ্টিমেয় ব্যক্তির স্বার্থে নয়। এ জন্য প্রেসক্লাবকে জামায়াত-বিএনপি’র দলীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে উদ্ধার করতে হবে এবং সদস্যপদ পাওয়ার উপযুক্ত সকল সাংবাদিককে সদস্যপদ প্রদান করতে হবে। দীর্ঘকাল থেকে প্রেসক্লাব জামায়াত-বিএনপি সমর্থিত সাংবাদিক নেতারা নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং ক্লাবের সদস্যপদ প্রদানের ক্ষেত্রে জামায়াত-বিএনপির সমর্থক কিংবা ওইসব নেতার আস্থাভাজনরা অগ্রাধিকার পান। যদি ১০০ জনকে সদস্যপদ দেয়া হয় তবে তার ৭০ জনই জামায়াত-বিএনপি’র পরিক্ষিত লোক।

জামায়াত-বিএনপি সমর্থক অথচ প্রেসক্লাবের সদস্যপদ পাননি -ঢাকা শহরে এরকম সাংবাদিক বিরল। দু’বছর আগে সাংবাদিকতা পেশায় এসেছেন এমন ব্যক্তিও দলীয় আনুগত্যের সুবাদে সদস্যপদ পেয়েছেন; অথচ দু’দশকের অধিককাল থেকে সাংবাদিকতায় নিয়োজিত প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ সদস্যপদ পাননি। যেসব সাংবাদিক আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন, যারা কোনও দলীয় আনুগত্যে বিশ্বাস করেন না, কোনও নেতার বিশেষ আস্থাভাজন হতে চান না, কিংবা কোনও নেতার কাছে সদস্যপদের জন্য তদ্বির করতে আগ্রহী নন -তাদের সদস্যপদ পাওয়া দুস্কর। ঢাকায় কর্মরত তিন হাজারের অধিক সাংবাদিক আছেন যারা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রেসক্লাবের সদস্য হতে পারেননি। অথচ হাওয়া ভবনের পিয়ন এবং বিএনপি চেয়ারপার্সনের ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফারের ক্যামেরা বহনকারী ব্যক্তিবিশেষও প্রেসক্লাবের সদস্যপদ পেয়েছেন। এটা পুরো সাংবাদিক সমাজের জন্য অবমাননাকর।

জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাচন বরাবরই একপেশে। যেহেতু ভোটার তালিকায় অধিকাংশই বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক, তাই প্রায় সকল পদেই তাদের নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা পূর্ব নির্ধারিত। আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ফোরাম নির্বাচনে প্রতিবার প্যানেল দেয় এবং হেরে যায়। এই প্যানেলের দু’একজন প্রার্থী, যারা কৌশলে জামায়াত-বিএনপি সমর্থকদের ভোট আদায় করতে পারেন তারা জয়ী হন। এটা সংখ্যায় নগণ্য। সুতরাং সদস্যপদ উন্মুক্ত করে দিয়ে প্রেসক্লাবের ভোটার তালিকা দলীয়করণমুক্ত করা না হলে সেই নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিক ফোরামের অংশগ্রহণ করা মানে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি গঠনের আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নেয়া। এই বাস্তবতায় প্রায় প্রতিটি ফোরাম মিটিংএ নির্বাচন বয়কট করার জন্য সাংবাদিকরা জোরালো দাবি উত্থাপন করে।

সদস্যপদ উন্মুক্ত করার জন্য আমাদের দীর্ঘ আন্দোলন এবং সদস্যপদ প্রদানের আগে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার দাবিকে আমলে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ফোরাম নেতারা এবার নির্বাচন বয়কট করার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়। ফলে প্রেসক্লাবের ম্যানেজিং কমিটি এবং বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ফোরামের নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ফোরামের নেতৃত্বের সাথে আলোচনায় আসতে বাধ্য হয়। আলোচনায় তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ফোরামকে সভাপতিসহ ৭টি পদ প্রদানে সম্মত হয়। সমঝোতা অনুযায়ী বিএনপি-জামায়াত ফোরাম পাবেন সাধারণ সম্পাদকসহ ১০টি পদ। ১৭ জন প্রার্থী ১৭টি পদে বিনা প্রতিদ্বন্দীয় নির্বাচিত হবেন। উভয় ফোরামের আর কেউ মনোনয়নপত্র জমা দিবেনা। নির্বাচিত হওয়ার পর নতুন কমিটির প্রথম কাজ হবে সাংবাদিকদের পেশাদারিত্বকে অগ্রাধিকার দিয়ে নতুন সদস্যপদ প্রদান করে প্রেসক্লাবের একচেটিয়া দলীয়করণের অবসান ঘটানো।

কিন্তু সমঝোতা হওয়ার পর থেকেই বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ফোরাম তা ভেঙ্গে দেয়ার জন্য নানা অজুহাত তৈরি করতে থাকে। তারা নতুন নতুন শর্ত ও দাবি উত্থাপন করে, যা মূলত: রাজনৈতিক এবং প্রেসক্লাবের নির্বাচনের সাথে সম্পর্কিত নয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ফোরাম তাদের ৭ জন প্রার্থীর নাম চুড়ান্ত করে এবং বৃহত্তর ফোরাম মিটিংএ তা সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন করার পরার পর জমা দেয়। এই ৭ জনের প্রায় সকলেই স্বনামে খ্যাত এবং দেশের সংবাদপত্র শিল্পের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি। এরা হলেন সভাপতি পদে দৈনিক সমকাল সম্পাদক গোলাম সরওয়ার, সিনিয়র সহসভাপতি পদে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান, যুগ্ম সম্পাদক পদে দৈনিক ইত্তেফাকের ফরিদা ইয়াসমিন, সদস্য পদে প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি হাসান শাহরিয়ার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক স্বপন সাহা, বিএফইউজে সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল এবং যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম। কিন্তু দু’মাস যাবত বিএনপি জামায়াত ফোরাম তাদের ১০ জন মনোনিতের নাম না দিয়ে নানাভাবে কালক্ষেপন করতে থাকে এবং নতুন নতুন শর্ত আরোপ করতে থাকে। অবশেষে তারা তাদের ফোরামের নেতা রুহুল আমীন গাজীকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনিত করে ১০ জনের নাম জমা দেয়। অন্যরা হলেন সহসভাপতি পদে এম এ আজিজ (বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত বিএফইউজের মহাসচিব), যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে আব্দুস শহীদ (বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত ডিইউজের সাবেক সভাপতি), কোষাধ্যক্ষ্য পদে কাদের গণি চৌধুরী, সদস্য পদে শওকত মাহমুদ (ক্লাবের সাবেক সভাপতি), মাসুমুর রহমান খলীলী (নয়া দিগন্তের উপ সম্পাদক), হাসান হাফিজ, একেএম মহসীন (ফটো সাংবাদিক), নুরুদ্দিন আহমেদ নুরু (বিএনপি চেয়ারপার্সনের ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফার এবং মোসাদ্দেক আলী ফালূর বড় ভাই) এবং নুরুল হুদা (ক্লাবের সাবেক সহসভাপতি)।

এরপর শুরু হল নতুন খেলা। বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শওকত মাহমুদ (যিনি বিএনপি পক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী অন্যতম প্রধান নেতা) নিজেই সমঝোতার শর্ত ভঙ্গ করে সভাপতি পদে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন। তার সাথে উভয় পক্ষের কিছু বিদ্রোহী প্রার্থী মনোনয়ন জমা দেয়ার কারণে সর্বসম্মত সমঝোতা পুরোপুরি ভেস্তে গেল। বিদ্রোহী প্রার্থীরা প্রচার করতে শুরু করল যে আওয়ামীলীগ-জামায়াত ঐক্য হয়েছে এবং সেই ঐক্য প্যানেলের বিরুদ্ধে তারা প্রার্থী হয়েছেন। অথচ তারা নিজেরাই সমঝোতা প্রক্রিয়ায় সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। তারা মূলত: প্রেসক্লাবে জামায়াত-বিএনপির একচেটিয়া কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য সমঝোতা ভেঙ্গে দেয়ার ঘুটি হিসেবে কাজ করেছেন। প্রাপ্ত তথ্য মতে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রেসক্লাবের উপর একচেটিয়া কতৃত্বের অবসান হতে যাচ্ছে- এটা জেনে ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। মূলত: তার নির্দেশেই সমঝোতা থেকে সড়ে গেছে বিএনপি-জামায়াতের সাংবাদিক ফোরাম।

বর্তমানে প্রেসক্লাব একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বৈধ কমিটি না থাকায় সাংবাদিকরা অনেকেই সরকারের কাছে এ্যাডমিনিস্ট্রেটর নিয়োগের দাবি জানাচ্ছেন। অনেকেই বলছেন তলবি সাধারণ সভা ডেকে দলীয়করণকৃত কমিটির অবসান ঘটিয়ে সর্ব সাধারণের আস্থাভাজন একটি কমিটি গঠন করার জন্য। যে পন্থাতেই সমাধান আসুক, তাতে বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজের অংশগ্রহণ দরকার। সদস্যপদ পাওয়ার যোগ্য সকল সাংবাদিককে ভোটার না করে প্রেসক্লাবের নির্বাচন দেয়া উচিৎ হবে না। প্রেসক্লাবকে সাংবাদিক সমাজের বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলুন। আমরা এই দাবিতেই আন্দোলন করছিলাম। প্রেসক্লাবের উপর পেশাদার সাংবাদিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা এই আন্দোলন থেকে সরে যাব না। অধিকাংশ সাংবাদিককে বাইরে রেখে অল্প কিছু মানুষ প্রেসক্লাবের হাতে ন্যস্ত রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভোগ-দখল করবেন -এটা হওয়া উচিৎ নয়।

লেখক : সাংবাদিক

পাঠকের মতামত:

১৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test