E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ভারত উপমহাদেশ ও বাংলার চলচ্চিত্রের ইতিহাস

২০১৫ জুন ০৯ ১৫:০০:৩৭
ভারত উপমহাদেশ ও বাংলার চলচ্চিত্রের ইতিহাস

উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ ডেস্ক : প্রায় ১০০ বছর পূর্বে ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্যারিস নগরীতে অগাস্ট লুমিয়ের (১৮৬২-১৯৫৪) ও লুই লুমিয়ের (১৮৬৪-১৯৪৮) নামে দুই ভাই বায়োস্কোপের প্রথম সফল বাণিজ্যিক প্রদর্শনী করেন। এ ঘটনার মাত্র ছয় মাস পরই লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের একজন প্রতিনিধি মুম্বাইয়ের ওয়াটসন হোটেলে ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই উপমহাদেশে প্রথম বায়োস্কোপের প্রদর্শনী করেন।

ওই বছরের শেষ দিকে কলকাতায় শুরু হয় বায়োস্কোপের প্রদর্শনী। ঢাকায় প্রথম বায়োস্কোপ প্রদর্শনের প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় সাপ্তাহিক ঢাকা প্রকাশ সূত্রে। ১৮৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল বায়োস্কোপ দেখানো হয় ঢাকার সদরঘাট পাটুয়াটুলীর ক্রাউন থিয়েটারে (এখন অবলুপ্ত)। কলকাতা থেকে আগত ব্রেডফোর্ড বায়োস্কোপ কোম্পানি এ প্রদর্শনীর আয়োজন করে। ঢাকায় নিয়মিতভাবে বায়োস্কোপ প্রদর্শন শুরু হয় ১৯১৩-১৪ সালের দিকে আরমানিটোলার পাটের গুদামে। পরে এখানে স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ স্থাপিত হয় ‘পিকচার হাউজ’ (পরবর্তীকালে শাবিস্তান) নামে। এটিই বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা হল।

১৮৯৮ সালে কলকাতায় বাঙালিদের মধ্যে প্রথম বায়োস্কোপ কোম্পানি গঠন করেন মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরী গ্রামের হীরালাল সেন (১৮৬৬-১৯১৭)। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির নাম দ্য রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানি। তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতাও। তাঁর তোলা খন্ডচিত্র (নাটক থেকে) সীতারাম, আলীবাবা, দোললীলা, ভ্রমর, হরিরাজ বুদ্ধ ১৯০১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ক্ল্যাসিক থিয়েটারে প্রদর্শিত হয়। তিনি প্রামাণ্য চিত্র, বিজ্ঞাপন চিত্র এবং সংবাদচিত্রও নির্মাণ করেন।

১৯১৩ সালে মুম্বাইতে মুক্তি পায় উপমহাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাক চিত্র দাদাভাই ফালকের পরিচালনায় রাজা হরিশচন্দ্র। আর কলকাতায় ১৯১৬ সালের দিকে ম্যাডান থিয়েটারস কোম্পানি চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করে। এ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে প্রথম বাংলা নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চিত্র বিল্বমঙ্গল মুক্তি পায় ১৯১৯ সালের ৮ নভেম্বর। এ ছবির পরিচালক জ্যোতিষ ব্যানার্জি (মতান্তরে রোস্তমজী দুতিওয়ালা) হলেও নেপথ্য স্থপতি ছিলেন ঢাকার নওয়াব এস্টেটের ম্যানেজারের পুত্র পরবর্তীকালের বিখ্যাত প্রযোজক-পরিচালক প্রিয়নাথ গাঙ্গুলি। ১৯২১ সালে বরিশালের ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি (ডি জি) কলকাতায় বিলাত ফেরৎ নামে চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও তাতে অভিনয় করেন।

১৯২৭-২৮ সালে ঢাকায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। নওয়াব পরিবারের কয়েকজন তরুণ সংস্কৃতিসেবী নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র সুকুমারী। এর পরিচালক ছিলেন জগন্নাথ কলেজের তৎকালীন ক্রীড়াশিক্ষক অম্বুজপ্রসন্ন গুপ্ত। চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা ছিলেন খাজা নসরুল্লাহ ও সৈয়দ আবদুস সোবহান। উল্লেখ্য তখন নারীদের অভিনয়ের রেওয়াজ চালু হয়নি। নাট্যমঞ্চের নারীচরিত্রেও পুরুষেরাই অভিনয় করতেন।

সুকুমারীর সাফল্যের পর নওয়াব পরিবারের তরুণরা ঢাকা ইস্ট বেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন এবং অম্বুজ গুপ্তের পরিচালনায় ও খাজা আজাদের ক্যামেরায় দ্য লাস্ট কিস নামে একটি নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন খাজা আজমল, খাজা আদিল, খাজা আকমল, খাজা শাহেদ, খাজা নসরুল্লাহ, শৈলেন রায় বা টোনা বাবু। অভিনেত্রীদের মধ্যে ছিলেন লোলিটা বা বুড়ি (নায়িকা), চারুবালা, দেববালা বা দেবী এবং হরিমতি। প্রথমোক্ত তিনজন অভিনেত্রীকে পতিতালয় থেকে আনা হয়। ছবির বাংলা ও ইংরেজি সাব টাইটেল রচনা করেন পরিচালক নিজে এবং উর্দু সাব টাইটেল রচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আন্দালিব শাদানী। ১৯৩১ সালের দ্য লাস্ট কিস মুক্তি পায় ঢাকার মুকুল (বর্তমানে আজাদ) হলে। ছবিটির প্রিমিয়ার শো-র উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার

অখন্ড বাংলার চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ব্যতিক্রর্মী সংযোজন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। ১৯৩১ সালে তিনি চলচ্চিত্রে জড়িত হন কলকাতার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ম্যাডান থিয়েটারসের সুরভান্ডারি হিসেবে। পরে তিনি চিত্র পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার, গায়ক, গীতিকার, অভিনেতা, কাহিনীকার, সংগঠক হিসেবে অবদান রাখেন। ১৯৩৪ সালে তিনি সত্যেন্দ্রনাথ দে-র সঙ্গে যৌথভাবে ধ্রুব চিত্র নির্মাণ করেন। ১৯৪১ সালে তিনি শেরে বাংলার নামে বি.টি পিকচার্স গঠন করেন। নজরুলের পর আরও কয়েকজন সাহসী মুসলমান ধর্মীয় ও সামাজিক কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি এড়িয়ে চলচ্চিত্রে জড়িত হন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন আববাসউদ্দীন আহমদ, হিমাদ্রী চৌধুরী (ওবায়েদ-উল হক), কিরণকুমার বা ফতেহ লোহানী, স্বপনকুমার বা কাজী খালেক, উদয়ন চৌধুরী বা ইসমাইল মোহাম্মদ, বনানী চৌধুরী বা বেগম আনোয়ারা, আবদুল আহাদ, নাজীর আহমদ, ইনাম আহমদ, বেবী ইসলাম, কিউ.এম জামান প্রমুখ। এঁদের মধ্যে হিমাদ্রী চৌধুরী দুঃখে যাদের জীবন গড়া (১৯৪৬) প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন। উদয়ন চৌধুরী মানুষের ভগবান (১৯৪৭) চিত্র নির্মাণ করে অভিযুক্ত হন ও জেলে যান। দেশ বিভাগের পর কলকাতার চিত্রকর্মীরা ঢাকায় এসে চলচ্চিত্রের ভিত্তি স্থাপনে সক্রিয় অবদান রাখেন।

১৯৪৭ সালে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের নতুন প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান নতুন প্রত্যাশার সৃষ্টি করে। রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে নতুন করে শুরু হয় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চলচ্চিত্র প্রযোজনা, পরিবেশনা এবং স্টুডিও নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এলে বেতার-ব্যক্তিত্ব নাজীর আহমদকে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি কলকাতার কুশলীদের সহায়তায় ইন আওয়ার মিডস্ট নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এটিই পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের প্রথম তথ্যচিত্র। চলবে...

গ্রন্থনা : পরিতোষ বড়ুয়া তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া এবং আমরা ঢাকা

পাঠকের মতামত:

১৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test