E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

হাইব্রিড রাজত্ব ও একজন আহম্মদ ফিরোজ

২০১৭ এপ্রিল ০৮ ১৮:৪৫:২১
হাইব্রিড রাজত্ব ও একজন আহম্মদ ফিরোজ

প্রবীর সিকদার


আচমকাই খবরটা পেলাম, সাংবাদিক আহম্মদ ফিরোজকে ফরিদপুর প্রেসক্লাব থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আমি সরাসরি ফোন করলাম সাংবাদিক আহম্মদ ফিরোজ তথা ফিরোজ ভাইকে। ফিরোজ ভাই অবলীলায় বললেন, 'হাঁ তেমনই খবর শুনেছি। এখনো চিঠিপত্র দেয়নি। চিঠি দিলেই মামলা; জবরদখলকারী অবৈধ কমিটি, ফরিদপুর প্রেসক্লাবকে লুটপাটের হাওয়াই ভবন বানিয়েছে!'

এমনিতেই ফরিদপুরের সংবাদকর্মীরা আমার ফোন এড়িয়ে চলেন। এক পুলিশ কর্তা ফরিদপুরের সাংবাদিকদের নাকি বলেছেন, প্রবীর সিকদারের ফোনের কথোপকথন ২৪ ঘণ্টা রেকর্ড করা হয়, সাবধান! খবরটির সত্যতা জানতে অনেকটা ইতস্তত করেই ফোন করলাম ফরিদপুরের এক সংবাদ কর্মীকে। তিনি ফিরোজ ভাইয়ের বহিষ্কারের বিষয়টি নিশ্চিত করলেন। আমি কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, 'সম্প্রতি ফিরোজ ভাই এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে ফরিদপুরে কর্মরত কোনও কোনও সংবাদকর্মীর নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ওই স্ট্যাটাসে ফরিদপুর প্রেসক্লাবের বর্তমান নেতৃত্ব খুব চটেছেন; তাই বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।' আমি প্রশ্ন করলাম, ফেসবুক স্ট্যাটাসে ফিরোজ ভাই কি কোনও ভুল বলেছেন? ওপর প্রান্ত থেকে উত্তর পেলাম, 'আমি ওই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না।' আমি ওর অসহায়ত্ব অনুভব করে ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করলাম। ভাবতে থাকলাম কে এই আহম্মদ ফিরোজ!

১৯৭৯-৮০ সালে আমি ঢাকা থেকে ফিরে রাজেন্দ্র কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হয়েছি। ছাত্রলীগের রাজনীতি করি আর গল্প কবিতা লিখি; বের করি সাহিত্য পত্রিকাও। পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়েই ফরিদপুরের থানা রোডের ওরিয়েন্টাল প্রেসে পরিচয় সুবলদার সঙ্গে; সুবলদা এখন মাদারিপুরে দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিনিধি। ওই প্রেস থেকেই ছাপা হতো সাপ্তাহিক জাগরণ। ইচ্ছে হল, সাংবাদিক হবার। সুবলদা আমাকে সেই সুযোগও করে দিলেন। সাপ্তাহিক জাগরণের স্টাফ রিপোর্টারের কার্ড পকেটে ঢুকিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মজাটাই আলাদা! মাঝে মধ্যে ফরিদপুরে প্রেসক্লাবে উঁকি মারি আর সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের খবর ঢাকায় পাঠানোর ব্যস্ততায় বিমোহিত হই; কবে যে আমি ওই ব্যস্ততায় ঢাকার কাগজে খবর পাঠাতে পারবো! সেইখানে একদিন মমিন ভাইয়ের মাধ্যমে পরিচয় হয় সাপ্তাহিক ফরিদপুর বার্তার সম্পাদক রুনু ভাইয়ের সঙ্গে। তারপর ফরিদপুর বার্তায় প্রকাশ হতে থাকল আমার লেখা গল্প-কবিতা। তারপর হটাত করেই লেখালেখি বাদ দিয়ে আমার পারিবারিক স্কুল কানাইপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়া।

১৯৯০। স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন তুঙ্গে। একদিন নজরে এলো, ফরিদপুর হেলিপোর্টের পাশের একটি ভবনে 'দৈনিক ঠিকানা' লেখা একটি সাইনবোর্ড ঝুলছে। মাথায় ঢুকে গেল আবার সাংবাদিকতার পোকা। সেইদিনই ঠিকানা কার্যালয়ে ঢুকে পড়লাম। পরিচয় হলো পত্রিকাটির মালিক-সম্পাদক মীর আবুল হোসেনের সাথে। তিনি আমার আগ্রহ দেখে সাদরে গ্রহণ করলেন। বসিয়ে দিলেন বার্তা সম্পাদকের চেয়ারে। আমার সহকর্মী নির্মলেন্দু চক্রবর্তী শংকর ও বেলাল চৌধুরী। আমাদের তিন জনের আন্তরিক চেষ্টায় দৈনিক ঠিকানা হয়ে উঠেছিল স্থানীয় এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মুখপাত্র। প্রতিদিন স্কুল শেষ করে বিকেলে ঠিকানায় ঢুকি আর ভোরে দৈনিক ঠিকানা বগলদাবা করে বাড়িতে ফিরি। মাঝেমধ্যে এরশাদের ফরিদপুরের অনুসারীরা ঠিকানা কার্যালয়ে এসে হুমকিধামকি দিতে থাকেন।

হটাত একদিন পরিচয় হলো দৈনিক মিল্লাতের ফরিদপুর প্রতিনিধি আহম্মদ ফিরোজের সঙ্গে। তিনিই আমাকে অনুপ্রাণিত করলেন ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সদস্য হতে। তার সহযোগিতা নিয়ে ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সদস্য পদের জন্য আবেদন করলাম। ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সদস্য পদের জন্য সে কী উত্তেজনা! কিন্তু আমার সদস্য পদের আবেদন খারিজ করা হলো। বলা হলো, দৈনিক ঠিকানার পরিচয়ে সদস্যপদ পাওয়া যাবে না। আমাকে অন্য একটি দৈনিকের ফরিদপুর প্রতিনিধি হতে হবে। হাতে গোনা গুটি কয়েক দৈনিক, সব কাগজেরই ফরিদপুরে প্রতিনিধি রয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকে শেখ মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, দৈনিক বাংলার বাণীতে মন্টু গোপী, দৈনিক বাংলায় লিয়াকত হোসেন, দৈনিক ইনকিলাবে সালাউদ্দিন বাবলু...। এখন উপায়! মিল্লাতের সাংবাদিক আহম্মদ ফিরোজ পরামর্শ দিলেন, যশোর থেকে কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা বের হয়; সেখানে হানা দেন। যেমন কথা তেমন কাজ। টেলিফোনে কথা বলে চলে গেলাম যশোরে দৈনিক কল্যাণ অফিসে। সেখানকার নিউজ এডিটর রুকনউদদৌলা ভাই, তিনি দৈনিক সংবাদের হয়ে যশোরে কাজ করেন। তখনই তিনি দেশের নামকরা একজন সাংবাদিক। আমাকে তিনি সাদরে গ্রহণ করে দৈনিক কল্যাণের ফরিদপুর জেলা প্রতিনিধি করে নিলেন এবং একটি আইডি কার্ড করে দিলেন। আমি ফরিদপুরে ফিরে এলাম।

পরদিন ফরিদপুর প্রেসক্লাবে সদস্যপদের জন্য আবেদন করতে গেলে সালাউদ্দিন বাবলু জানালেন, শুধু আইডি কার্ডে হবে না; সাথে লাগবে তিন মাসের পেপার কাটিং। আবার অপেক্ষা তিন মাসের। তিন মাস পর দৈনিক কল্যাণের পেপার কাটিং সহ আবেদনপত্র জমা দিলাম। কার্যকরী কমিটির মিটিং-এ আমার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হলো এবং আমাকে জানিয়ে দেওয়া হলো, ঢাকা থেকে প্রকাশিত কোনও জাতীয় দৈনিকের ফরিদপুর প্রতিনিধি হতে হবে। এখন উপায়! ফিরোজ ভাই জানালেন, ঢাকা থেকে দৈনিক আজকের কাগজ বের হচ্ছে; সেখানে যান। চলে গেলাম ঢাকায় আজকের কাগজ অফিসে। মফস্বল সম্পাদক ছিলেন সমর সরকার। তিনি আমাকে দৈনিক আজকের কাগজের ফরিদপুর প্রতিনিধি করে নিলেন। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র নিয়ে ফরিদপুর ফিরলাম। আবার আবেদন করলাম সদস্যপদের জন্য ফরিদপুর প্রেসক্লাবে। এবার আমার আবেদন গৃহীত হলো এবং আমি প্রেসক্লাবের সদস্য হয়ে গেলাম। খুব মনে আছে, সেদিন ফিরোজ ভাই আমাকে হাত ধরে টানতে টানতে পাশের খোন্দকার হোটেলে ঢুকিয়ে মিষ্টি ও চা খাইয়েছিলেন।

শুরু হল ফিরোজ ভাইয়ের সঙ্গে পথচলা। আমার শুভাকাঙ্ক্ষী কয়েক সাংবাদিক আমাকে সতর্ক করলেন, 'ওর সঙ্গে সাবধানে মিশবে, ও কিন্তু ফ্রিডম ফিরোজ, ও কিন্তু খাস বিএনপির লোক। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি আমার খুবই অপছন্দের দল। কিন্তু আহম্মদ ফিরোজের কিছু কিছু বিষয় আমার খুবই পছন্দের মনে হল। তিনি নিউজে কাউকে ছাড় দেন না। যে নিউজটি তার পত্রিকা ছাপবে না, সেটি তিনি সতর্কতার সাথে আমাকে দিতেন। গ্রাম থেকে ফরিদপুরে সাংবাদিকতা করতে এসেছি, এই বিষয়টি পুরনো সাংবাদিকদের অনেকেই মানতে পারতেন না। সেই একাকী সময়ে ফিরোজ ভাই আমার সাথে ছিলেন, এই কৃতজ্ঞতার কথা অস্বীকার করি কি করে! এরই মধ্যে আমি দৈনিক আজকের কাগজ ছেড়ে দৈনিক জনকণ্ঠের ফরিদপুর প্রতিনিধি হয়েছি। কিন্তু মজার বিষয় হলো, সারা বছর জুড়ে এক সাথে খবরের পেছনে দৌড়ালেও প্রেসক্লাবের রাজনীতিতে আমি ফিরোজ ভাইয়ের বিরোধী শিবিরে থাকতাম। লিয়াকত ভাই, আলী ভাই, বাবু ভাই শিবিরে আমি আর হারুন মুনশী শিবিরে আহমেদ ফিরোজ। আমি প্রেসক্লাবের যুগ্ম-সম্পাদক পদে প্রার্থী হতাম, ঠিক আমার বিরুদ্ধে প্রার্থী হতেন আহমেদ ফিরোজ। নির্বাচনের সময় দুই শিবিরেই থাকতো অবিশ্বাসের নানা অনুষঙ্গ। এক প্যানেলের প্রার্থীরা যেন অপর প্যানেলের প্রার্থীদের ভোট না দিতে পারেন, তার জন্য ব্যালট পেপারে বিশেষ চিহ্ন ব্যবহার করা হতো। ভোটের পরে সঙ্গোপনে মিলিয়ে দেখা হতো কেউ গোপন আঁতাত করে বিরোধীদের ভোট দিয়েছে কি না! আমার খুব মনে পড়ে, আমি অন্তত তিনবার ফরিদপুর প্রেসক্লাবের নির্বাচনে যুগ্ম সম্পাদক পদে দাঁড়িয়েছি। প্রত্যেক বারই আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ফিরোজ ভাই। মজার বিষয় হলো, ওই তিনবারই আমার প্যানেল জয়লাভ করলেও আমি হেরেছি ফিরোজ ভাইয়ের কাছে। ভোটের পরদিন সকালে আমি ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির হতাম ফিরোজ ভাইয়ের বাসায়, ওকে অভিনন্দন জানাতে। অভিনন্দন-কোলাকুলি শেষে ফিরোজ ভাই আমাকে নিয়ে যেতেন খোন্দকার হোটেলে, চলতো নাস্তা ও চা। এই খবরটি জানাজানি হলে একবার আমাদের প্যানেলের বাবু ভাই প্রশ্ন তুলেছিলেন, আমি কেন ফিরোজের বাসায় ফুল নিয়ে যাই। আমার উত্তর ছিল, আমার প্যানেলের সবাই জয়লাভ করে, আর আমি হেরে যাই কেন, সেই কৈফিয়ত চাইনি কখনো আপনাদের কাছে; কিন্তু যে লোকটির কাছে আমি বার বার হেরে যাই তার যোগ্যতাকে আমি সম্মান জানাতেই ফুল নিয়ে তার বাসায় যাই। আর কথা বাড়াননি বাবু ভাই।

ফরিদপুরে কথাকৃষ্ণকলি নাটক নিয়ে যখন চূড়ান্ত উত্তেজনা, তখন পত্রিকার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় আমার বিরুদ্ধে খবর লিখেছেন ফিরোজ ভাই। কিন্তু গোপনে নানান খবর ও বিরোধীদের নানা পরিকল্পনার কথা আমাকে সরবরাহ করতেন। আমি ফরিদপুরের বাসায় অলিখিত গৃহবন্দী হয়েও কলম চালিয়েছি মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে। আমার খবরের নানান তথ্যে অনেকে বিস্মিত হতেন, বাসায় বসে বসে প্রবীর সিকদার এই তথ্য পায় কি করে, কে তাকে সরবরাহ করে! আমি কোনও দিন এই সত্য প্রকাশ করিনি, করতেও চাইনি। কিন্তু আজ যখন ফরিদপুর প্রেসক্লাবের হাইব্রিড নেতৃত্ব আহম্মদ ফিরোজকে বহিষ্কার করবার ধৃষ্টতা দেখায়, তখন চোখ-কান বন্ধ করে বসে থাকাটাকে বড় অকৃতজ্ঞতা বলেই বিবেচনা করি। আর তাই পুরনো স্মৃতিচারণ করে আহম্মদ ফিরোজ তথা ফিরোজ ভাইকে বলতে চাই, হাইব্রিড রাজ আর কতো, শেষ হলো বলে! আমি আপনার পাশে আছি, থাকবো; সেই সঙ্গে প্রকাশ্য কিংবা পর্দার আড়ালে সততার সঙ্গে বহমান থাকবে আপনার সাথে আমার মিষ্টি-মধুর বন্ধুতা। জয় আহম্মদ ফিরোজের জয়।

(পিএস/এএস/এপ্রিল ০৮, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

০৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test