E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে সাংবাদিক আহম্মদ ফিরোজের খোলা চিঠি : রক্ষা করুন ফরিদপুর প্রেসক্লাব

২০১৭ মে ১৫ ২৩:১৪:০৮
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে সাংবাদিক আহম্মদ ফিরোজের খোলা চিঠি : রক্ষা করুন ফরিদপুর প্রেসক্লাব

উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ ডেস্ক : ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সিনিয়র সাংবাদিক আহম্মদ ফিরোজ ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক উম্মে সালমা তানজিয়ার কাছে একটি খোলা চিঠিতে ঐতিহ্যবাহী ফরিদপুর প্রেসক্লাব রক্ষার আবেদন জানিয়েছেন। চিঠিটি উত্তরাধিকার ৭১ নিউজের সকল পাঠকের জন্য হুবহু প্রকাশ করা হল :

মাননীয় জেলা প্রশাসক মহোদয়, আপনি আমাদের আধাঁর রাতে জোনাকির আলো। আমি ফরিদপুরবাসী হিসেবে সৌভাগ্যবান যে, সাম্প্রতিক কালের মধ্যে সবচেয়ে সৎ ও নিষ্ঠাবান একজন জেলা প্রশাসক পেয়েছি আমরা। তাই আমরা আশায় বুক বেঁধেছি; আমাদের বিশ্বাস আপনার হস্তক্ষেপে ঐতিহ্যবাহী ফরিদপুর প্রেসক্লাবটিতে আবারও প্রাণ ফিরে আসবে ও ফরিদপুরে সুস্থ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠিত হবে।

মাননীয় জেলা প্রশাসক মহোদয়, অত্যন্ত বেদনাহত চিত্তে বলছি যে, ফরিদপুর প্রেসক্লাবটি বর্তমানে অবৈধ দখলদারদের কবলে মৃতপ্রায়; ফরিদপুরের সাংবাদিকতা আজ বিপন্ন। সাংবাদিকতার নামে যা চলছে তা ফরিদপুরবাসীকে ক্ষুব্ধ করছে। সাংবাদিকগণ তাদের বিশ্বাসের প্লাটফর্ম প্রেসক্লাবের এই হীনদশায় কলম চালাতে ভয় পায়। এই সুযোগই নিচ্ছে অবৈধ দখলদাররা। তারা তাদের সুদূরপ্রসারী নীলনকশা বাস্তবায়ন করে চলেছে। এতে ভুক্তভোগী হচ্ছে ফরিদপুরের সাংবাদিক ও সাধারন মানুষ। কারণ, একসময় প্রভাবশালীদের অবৈধ কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কলম ধরতেন এই সাংবাদিকেরা। সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে প্রভাবশালীরা কোন ষড়যন্ত্র করতে চাইলে ফরিদপুর প্রেসক্লাব সাংবাদিকদের পাশে দাড়াতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণই উল্টো। প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কলম ধরলে প্রেসক্লাবের অবৈধ দখলদারেরাই এখন সাংবাদিকের শত্রু হয়ে দাড়ায়। এই অবৈধ দখলদারেরা তাদের যাবতীয় অন্যায় কর্মকান্ড, লুটপাট, ভাগবাটোয়ারার মাধ্যম হিসেবে ফরিদপুর প্রেসক্লাবকে ব্যবহার করছে; তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি।

আপনার সদয় জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, ফরিদপুর প্রেসক্লাবকে নিজেদের লুটপাটের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের জন্য সম্পূর্ণ অবৈধভাবে দখল করা হয় প্রেসক্লাবকে। একটি নির্বাচিত কমিটিকে উপেক্ষা করে ভয়ভীতি দেখিয়ে ও বহিরাগত ক্যাডারদের এনে দখল করা হয় ফরিদপুর প্রেসক্লাবকে। তৎকালীন প্রেক্ষাপটটি আপনার সামনে তুলে ধরার জন্যই আমার আজকের এই লেখা।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সভার পর নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছিল একটি নির্বাহী কমিটি। তার আগে থেকেই এই অবৈধ দখলদারদের শ্যেণ দৃষ্টি ছিল প্রেসক্লাবের দিকে। কারণ তাদের অন্যায় কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করার একমাত্র ভরসাস্থল ছিল এই প্রেসক্লাব। এটিই ছিল তাদের ভয়ের অন্যতম কারণ। এছাড়া ফরিদপুর প্রেসক্লাবের জমি দখল করে বহুতল ভবন তৈরির নামে দোকান বাণিজ্য করবারও অভিলাষ ছিল এই দখলদারদের।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে থেকেই এই দখলদারদের তৎপরতা শুরু হয়েছিল। সেসময় থেকেই অনেক সাংবাদিককে ভয়ভীতি দেখানো হয়। কাউকে গ্রেফতার করানো হয় পুলিশ দিয়ে। কাউকে লং ড্রাইভে নিয়ে নানাভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা চালানো হয়। এতদসত্বেও সবকিছু উপেক্ষা করেই সেবার ফরিদপুর প্রেসক্লাবের নির্বাচন হয়েছিল। তবে ক্ষমতার মোহাবিষ্ট এই অবৈধ দখলবাজদের অপতৎপরতা থেমে থাকেনি।
ওই অপতৎপরতার অংশ হিসেবে বেছে বেছে ফরিদপুরের সাংবাদিকদের টার্গেট করা হয়। প্রথম আলোর ফরিদপুর প্রতিনিধি পান্না বালাকে শারিরীকভাবে লাঞ্চিত করার ঘটনাটি এরমধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য। মূলত: সাংবাদিক পান্না বালার উপর হামলার এই ঘটনার মাধ্যমে অন্য সকল সাংবাদিককে ভীতিকর ম্যাসেজ দেয়া হয়। সাংবাদিক পান্না বালার উপর হামলার ঘটনায় ফরিদপুর প্রেসক্লাব এক সপ্তাহের আল্টিমেটাম দিয়েছিল; সাংবাদিকেরা সম্মানজনক সমাধান দাবি করেছিল। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে ওই ঘটনার একটি সম্মানজনক সমাধান হয়েছিল ফরিদপুর প্রেসক্লাবের বলিষ্ট ভূমিকার কারণেই।

ওই ঘটনাটি কুচক্রিমহলকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। তারা তখনই বুঝতে পেরেছিল ফরিদপুর প্রেসক্লাবকে দখল করতে না পারলে তাদের অন্যায় কর্মকান্ড নির্বিঘ্ন হবে না। তাই তারা ফরিদপুর প্রেসক্লাবটিকে দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ফরিদপুরের এলজিইডি রেষ্ট হাউজ ও ঢাকার একটি হোটেলে একাধিক বৈঠক করা হয় প্রেসক্লাব দখলের। সঙ্গতভাবেই দু’টি ধারায় বিভক্ত ফরিদপুর প্রেসক্লাবের ক্ষমতার বাইরের ধারাটিকে তারা সহজেই হাত করতে সক্ষম হয়। এদের মাধ্যমে এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অপর সাংবাদিককে লেলিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করা হয়।

২০১৫ সালের ১ এপ্রিল একটি মিথ্যা চাঁদাবাজি মামলা দেয়া হয় ফরিদপুর প্রেসক্লাবের তৎকালীন সভাপতি কবিরুল ইসলাম সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে। মামলাটি করেছিলেন বর্তমান অবৈধ কমিটির কথিত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল ইসলাম পিকুল। ফরিদপুর প্রেসক্লাবের চারবারের নির্বাচিত সভাপতি কবিরুল ইসলাম সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত চাঁদাবাজি মামলাটি সকলের নিকটই হাস্যকর ছিল। মাত্র ৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ওই মামলাটি করা হয়েছিল। আপনার কর্মকালীন দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় নিশ্চয়ই অনুভব করতে পারবেন যে, চারবারের নির্বাচিত ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে সন্ত্রাসী ষ্টাইলে ৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করার ঘটনাটি কতোটা হাস্যকর। তারপরেও অদৃশ্য ইশারায় পুলিশ হাস্যকর ওই মামলাটি গ্রহণ করেছিল। সেসময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এনিয়ে সাধারণ ফরিদপুরবাসীর মন্তব্য প্রমাণ করে বিষয়টি কতোটা হাস্যকর ও ষড়যন্ত্রমূলক ছিল।

তারপর কতিপয় সুবিধাবাজ সাংবাদিককে মোটা অংকের টাকা ও অবৈধ সুবিধার বিনিময়ে ম্যানেজ করা শুরু হয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন ছিলেন তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক হাসানুজ্জামান। তৎকালীন জেলা প্রশাসক সরদার সরাফত আলীর নাম ভাঙিয়ে হাসানুজ্জামান নির্বাচিত কমিটির মিটিংয়ে জানায় যে, ডিসি সাহেব কমিটি ভেঙে দিতে বলেছেন। অন্যথায় তিনি আমাদের সাদা কাগজ ধরিয়ে দেবেন বলে জানিয়েছেন। একজন নামধারী সাংবাদিক বলেন যে, বর্তমান কমিটি ভেঙে না দিলে আমাদের গলা ধাক্কা দিয়ে প্রেসক্লাব থেকে বের করে দিতে পারেন ডিসি সাহেব। এভাবে একটি আতঙ্কিত পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। পরে অবশ্য তৎকালীন জেলা প্রশাসক জানান, এসবের কিছুই তিনি বলেননি। তৎকালীন সেক্রেটারী হাসানুজ্জামান প্রেসক্লাবের নির্বাহী কমিটির একটি ভুয়া রেজুলেশন তৈরি করেন। যেখানে কবিরুল ইসলাম সিদ্দিকী পদত্যাগ করেছেন বলে লিপিবদ্ধ করা হয়। কমিটির মিটিং না করেই এই রেজুলেশন তৈরি করা হয়। তৎকালীন নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য হিসেবে যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি নিজেই।

এখানে উল্লেখ করা জরুরী যে, সভাপতির অবর্তমানে শুধুমাত্র সভাপতি পদেই উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের নিয়ম রয়েছে ফরিদপুর প্রেসক্লাবের গঠনতন্ত্রে। কিন্তু সেটি না করে পুরো কমিটিই ভেঙে দেয়া হয় অবৈধ দখলদারদের নির্দেশনা মতে। এই কাজটি সূচারুরুপে সম্পন্ন করেন সুবিধাবাজ কতিপয় ব্যক্তি।

তারপর শুরু হয় নানা নাটকিয়তা। সম্পূর্ণ অগঠণতান্ত্রিক ও অবৈধ উপায়ে র‌্যাফেলস ইন হোটেলে কথিত একটি সভা করা হয়। সেখানে সাংবাদিকদের পরিবর্তে বহিরাগতদের উপস্থিতিই ছিল বেশি। ছিল সন্ত্রাসীরাও। সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী কায়দায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেই সভায় একটি নিজস্ব মনগড়া আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, যারা তখনও ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সদস্যই ছিল না, তাদেরও কয়েকজন এই অবৈধ আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হয়। এরপর নিজেদের মতো করে চলে অসাংবাদিকদের সদস্যভুক্তি ও সদস্যদের বহিষ্কার। তবে এইসব বহিষ্কারাদেশ ছিল শুধুই মুখে মুখে। বহিষ্কৃত কাউকেই কোন চিঠি দেয়া হয়নি। কারণ দর্শানোর নোটিশও দেয়া হয়নি। কেননা এর কোন কিছু করারই আইনত ও নৈতিক ভিত্তিক ছিল না তাদের। এভাবেই অবৈধ দখলদাররা ফরিদপুর প্রেসক্লাবটিকে দখল করে নেয়।

এখন এই অবৈধ দখলদারদের ত্রাসের রাজত্ব ও বেপরোয়া কার্যক্রম চলছে ফরিদপুর প্রেসক্লাব ঘিরে। গত দুই বছর ধরে তারা এভাবে দখল করে রেখেছে ক্লাবটিকে। মুড়ির মতো উড়ছে কালো টাকা। এহেন কর্মকান্ডে ফরিদপুর প্রেসক্লাবের ভাবমূর্তি এযাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক অবস্থায় পৌছেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, হামলা-মামলাসহ গুম-খুন ও নিগৃহিত হওয়ার ভয়ে কোন সাংবাদিকই মুখ খুলছেন না এসব নিয়ে।

সম্মানিত জেলা প্রশাসক মহোদয়, ফরিদপুর প্রেসক্লাবটি একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। আপনি এই ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষকও। এখানে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ এসেছেন। তাদের পদধুলিতে ফরিদপুর প্রেসক্লাব শুধু ফরিদপুরেই নয়; এই অঞ্চলের মধ্যে একটি অভিভাবকতুল্য প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছিল। ফরিদপুরের নির্যাতিত মানুষের শেষ ভরসাস্থল ছিল এটি। সেই ফরিদপুর প্রেসক্লাবের গৌরব আজ লুপ্ত। মানবতাবিরোধী অপরাধে দন্ডিত অপরাধী ও লিবিয়াফেরত ফ্রিডম পার্টির নেতার নিকটাত্মিয়রা বিস্ময়করভাবে এই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির আমলে ফরিদপুর প্রেসক্লাব অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে। এদের বিরুদ্ধে কারো কিছুই কি বলার নেই?

এমতাবস্থায় মাননীয় জেলা প্রশাসক, প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আপনিই ফরিদপুরের সাংবাদিকদের আশ্রয়স্থল ফরিদপুর প্রেসক্লাবের অন্ধকারের আশার আলো। আপনি একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। তাই এক বুক ভরসা নিয়ে আপনার দুয়ারে হাজির হয়েছি।আমি নিশ্চিত, আপনি আমাদের হতাশ করবেন না। আপনার সাহসী পদক্ষেপে ফরিদপুর প্রেসক্লাব তার হারানো গৌরব ফিরে পাবেই।

(পিএস/এএস/মে ১৫, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test