E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অতলান্ত পিতৃস্মৃতি পর্ব ২

২০১৪ জুলাই ০১ ০৮:৪২:১০
অতলান্ত পিতৃস্মৃতি পর্ব ২

প্রবীর বিকাশ সরকার :  [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

অনেকের মতো আমারও প্রশ্ন: বাঙালি পরিবারে পিতাপুত্রের সম্পর্ক কী রকম? আমার দেখা ও জানামতে সুসম্পর্ক খুবই কম। সেই দিক দিয়ে বাবার সঙ্গে শৈশব থেকে তিরোধানকাল পর্যন্ত সমান্তরালভাবে সুসম্পর্কই বজায় ছিল। মাঝেমধ্যে যে পরস্পর বিরক্ত হইনি, রাগারাগি করিনি, নানা ছুতোয় খিটিমিটি বাঁধেনি, মার খায়নি বাবার হাতে তা কিন্তু নয়।

বাবার সঙ্গে ২৫ বছর ধরে আমি বিচ্ছিন্ন ছিলাম যেহেতু জাপান প্রবাসী। কয়েক বছর অন্তর অন্তর বাংলাদেশে ফিরলেও বাবার সঙ্গে ক্ষণকালের জন্য সাক্ষাৎ ঘটতো। কিন্তু প্রকৃত অর্থে বাবার সঙ্গে সংসর্গ ছিল কমই। কেননা পুলিশ অফিসার হওয়ার কারণে সারাবছরই ছিল বাবা ব্যস্ত। এখানে সেখানে বদলি হয়ে একাই গিয়েছে কর্মস্থলে, সন্তানদের পড়ালেখার বিঘ্ন ঘটবে বলে আমরা কুমিল্লাতেই ছিলাম। তবে বাবা জীবনের অধিকাংশ সময়ই কুমিল্লা সদর পুলিশ কোর্টেই ছিল। দয়ালু আর বন্ধুবৎসল বলে তাঁর খ্যাতি ছিল তুঙ্গে। তাঁর কোনো “শত্রু” আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। বাবার প্রতিন্দ্বন্দ্বীও কেউ ছিল কোনোদিন শুনিনি। এমনকি পাকিস্তান আমলে অনেক বিহারি, পাঠান, পাঞ্জাবি পুলিশ কর্মকর্তা এবং সেনাঅফিসার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। সারাজীবনই বাবা কর্মধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে যথাসম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। পরিশ্রমী, পড়ুয়া এবং স্বল্পবাক এই মানুষটি মানুষের যেরকম শ্রদ্ধা, ভক্তি এবং ভালোবাসা পেয়েছে এমনটি আমার জীবনে আর কাউকে দেখিনি। কী পরিমাণ সমীহ করতেন মানুষ তাঁকে যাঁরা জানার তাঁরা জানেন।

পাকিস্তান আমলে বাবার সমসবয়সী বন্ধুরা ছিলেন আওয়ামী লীগার, বামপন্থী এবং মুসলিম লীগার। বাবা নিজে আওয়ামী লীগের কট্টোর সমর্থক ছিল প্রচন্ড জাতীয়তাবাদী চেতনাবোধ থেকে। আওয়ামী লীগার হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম লীগের বন্ধুরা যাঁরা অধিকাংশই ছিলেন আইনজীবী কিন্তু কোনোদিন তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কিংবা সামান্য তর্কবিতর্কও হতে দেখিনি। সেই সময় সকলের মধ্যেই সদ্ভাব ছিল যা এখন চিন্তাই করা যায় না! বাবার এই বন্ধুভাবাপন্ন চারিত্রিক গুণাগুণের কারণে আমরা তাঁর সন্তানেরা আজও সম্মান পাই।

বাবা শুধু যে বাইরের লোকদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিল তাই নয়, আমরা পাঁচ ভাইবোনের সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল, আত্মীয়দের সঙ্গেও। বাবা স্বাধীনচেতা বলেই ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিল। তবে কখনো কখনো আমরা দায়িত্ব, কর্তব্যের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন এবং দস্যিপনার সীমানা অতিক্রম করলেই তাঁর অগ্নিমূর্তি ধারণ করতে বিলম্ব হতো না। সার্বক্ষণিক ব্যবহৃত বেতের তৈরি পুলিশি লাঠির মারও খেয়েছি আমি আর আমার পরের ছোট ভাই পীযূষ ডাক নাম যার কুটু। ছোট তিন বোন বরাবরই ছিল শান্ত ফলে তাদের ওপর বিরাগ হতে দেখিনি কখনো। বাবা আমাদেরকে ছেলেবেলাতেই বলেছিল, ‘জীবনটা তোমাদের নিজের, বাবা-মার নয়। সুতরাং তাকে গড়ে নিতে হবে তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টার জোরে। তাই জীবনটাকে দশ বছর দশ বছর করে ভাগ করে নিতে হবে ছককাটা পরিকল্পনা অনুযায়ী। সঠিক উপলক্ষ স্থির করে নিতে হবে কৈশোরেই। কী করবে? কেন করবে? খুব বড় মানুষ হতে হবে এমনটি আমি বলি না, কেননা সমাজে সবাই রাজা হতে পারে না। যতখানি দরকার ততটুকুই অর্জন-উপার্জন করবে, লোভ-লালসা করবে না। কেউ চুরির টাকায়, ঘুষের টাকায় বাড়ি-গাড়ি করেছে তোমাকেও তাই করতে হবে এটা কখনোই ভাববে না। সবসময় ভিন্ন কিছু করার চিন্তা করবে যেমনটি মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, থিঙ্ক ডিফরেন্ট। আমার এই উপদেশ শোনা না শোনা সম্পূর্ণ তোমাদের ব্যাপার, এই নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। তোমাদের কর্মফলই তোমাদের জীবনের আয়ুরেখা।’

ব্যাস, এইই ছিল আমার বাবার শিক্ষাদান। পড়ালেখার ব্যাপারে মা যতখানি ভেবেছে, চাপ প্রয়োগ করতো সকাল-সন্ধ্যা বাবা তেমনটি করেনি। বাবা বলতো, ‘মাথা তথা জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে তোমাকে উপার্জন করতে হবে একইসঙ্গে হাত-পা চালু রেখে।’ কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর দেখলাম বাবা একটি কথাও মিথ্যে বলেনি। জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা বাবাকে ক্রমে ক্রমে দার্শনিক করে তুলেছিল বলে মনে হয়।

বৃটিশ আমলে ১৯২৯ সালে সিলেটের প্রত্যন্ত এক গ্রামের দরিদ্র এক কৃষি পরিবারে তিন নম্বর সন্তান হিসেবে বাবার জন্ম। মাইলকে মাইল হেঁটে হেঁটে সিন্দ্রাকোণা গ্রাম থেকে বালাগঞ্জ থানার স্কুলে যেতে হতো। কোনোরকমে মেট্রিকুলেশন পাশ করে গ্রামেগঞ্জে অনেক চেষ্টা করেও যখন কিছু করতে পারল না তখন শেষমেষ শহরে এসে টিউশনি করতে হয়েছে। এরপর চাকরির আশায় কুমিল্লা শহরে এলে পরে সাক্ষাৎ ঘটে আমার মাতামহ জলধর সরকারের সঙ্গে। দাদু তখন কুমিল্লা পুলিশ কোর্টের সাব-ইন্সপেক্টর। দাদু বাবার ইংরেজি, বাংলা এবং অঙ্কের মেধাবুদ্ধির পরিচয় পেয়ে বলল, ‘তুমি আমার মেয়েকে পড়াও আমার বাসায় থেকে।’ মা তখন নবাব ফয়জুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। দাদুর বাসায় থাকার সময় একবার দাদুর অসুখ হলে তাঁর সেবা-শুশ্রুষা করে বাবা। তারপর দাদু সুস্থ হলে পরে তাঁর চেষ্টায় বাবা পরবর্তীকালে পুলিশ বিভাগে চাকরি পায় ১৯৫৩ সালে এবং দাদুর ইচ্ছে অনুযায়ী মা বেলা রানীর সঙ্গে বিয়েও হয়ে যায় এক সময়। যদিও বাবার পছন্দ ছিল আমার মাসি প্রমিলাকে।

বাবার চাকরির প্রথম পোস্টিং হয়েছিল বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার কসবা থানায়। শারীরিক অসুস্থতার কারণে দাদু স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে চলে গেল জন্মভূমি সিলেটের সুনামগঞ্জের পাগলা থানার সদরপুর গ্রামে। সেখানেই আমার জন্ম ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ২০ তারিখ রোববারে। জন্মের এক বছর পর কর্মস্থল ফরিদপুর জেলার শরীয়তপুর মহকুমার পালং থানায় মা ও আমাকে নিয়ে যায় বাবা। আমার তিন বছরের সময় ফরিদপুর থেকে বাবা কুমিল্লা সদরে বদলি হয়ে আসে ১৯৬৪ সালে। প্রবীণ আইনজীবী এবং বাবার দীর্ঘ কর্মজীবনের বন্ধু অজিতকুমার চৌধুরীর মুখেই শোনা যে, বাবার বাংলা ও ইংরেজিজ্ঞানের কারণেই তৎকালীন এসপি বাবাকে কুমিল্লা সদর কোর্টে নিয়ে আসেন কাজের সুবিধার্থে। অজিতকাকা আরও বলেন, ‘পরেশদা ছিলেন প্রখর মেধাবী এবং স্মরণশক্তিসম্পন্ন মানুষ। শহরের বিখ্যাত দারোগাবাড়ির খ্যাতিমান আইনজীবী আলী ইমাম তাঁকে ‘মিনি কম্পিউটার’ বলে অভিহিত করেছিলেন। বাবার খুব প্রিয় ছিল একটি ইংরেজি কবিতা: ‘ডেথ্ ইজ লেবেলার’ প্রায়ই আমাদের শোনাতেন।’ যাহোক, ফরিদপুর থেকে ফিরে এসে দাদু যে বাসায় ভাড়া ছিল সেই ভানুবাবুর বাসাতেই উঠল। একটি বড় উঠোনযুক্ত অনেকগুলো ঘর নিয়ে এই গুচ্ছবাড়ি। ভানুমামা ও তার দুবোন লক্ষ্মী ও চায়নামাসি ছাড়া আরও পাঁচটি পরিবার ভাড়া থাকতো। এখানে আমার ১০ বছর বয়স পর্যন্ত ছিলাম। কত যে অম্লমধুর স্মৃতি এই বাড়িতে থাকাকালীন জন্ম নিয়েছে এখনো সেসব চোখে
ভাসে জলতরঙ্গের মতো! ... চলবে

লেখক : জাপানপ্রবাসী
(এএস/জুলাই ০১, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test