E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অতলান্ত পিতৃস্মৃতি পর্ব ৩

২০১৪ জুলাই ০২ ০৮:০১:০১
অতলান্ত পিতৃস্মৃতি পর্ব ৩

প্রবীর বিকাশ সরকার :  [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

শৈশব থেকেই আমার ছিল ভীষণ পেটব্যথা। এই অসুখে আমি ৫ বছর পর্যন্ত প্রচণ্ড ভুগেছি। ৩/৪ বছরের সময় এই পেটের অসুখে আমার বাঁ পা আক্রান্ত হয়। ক্রমশ শুকিয়ে অবশ হয়ে যেতে থাকে। বাবা তখনকার নামকরা কয়েকজন ডাক্তারকে দিয়ে চিকিৎসা করালো। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। তখন বুঝতে শিখলাম বাবার কাছে তাঁর সন্তান কত অমূল্য ধন! দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনায় সবাই অস্থির। দাদু-দিদিমাও গ্রাম থেকে এসে বসবাস করতে লাগল একমাত্র আমার কারণে। তাঁদের দ্বিতীয় মেয়ের প্রথম সন্তান বলে কথা! এর আগে আমার এক বোন জন্ম নেবার পর পরই মারা গিয়েছিল। সেই ভয়েই তাঁরা আরও বেশি ভেঙ্গে পড়েছিল। কিন্তু বাবা দুশ্চিন্তা করলেও হাসিখুশি মুখে আমাকে প্রতিদিন আদর করতো, পুকুরে স্নান করাতো, ভোরবেলা বাড়িসংলগ্ন পাইক পুকুরের দক্ষিণ পাড়ের সাব-রেজিস্ট্রি বিল্ডিং এর সবুজ মাঠে হাঁটতে সাহায্য করতো। নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার পরও ভালো হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। দাদু-দিদিমা এবং মা মন্দিরে, মাজারে মানত দিয়েছিল কিন্তু বাবা যায়নি। কারণ অত্যন্ত বাস্তববাদী বাবার ঈশ্বরজ্ঞান ছিল অন্যরকম। আমার অবস্থা দ্রুত শঙ্কটাকার ধারণ করলো, হাঁটা বন্ধ এবং বাঁকাও হয়ে গেল পা। কোনো ডাক্তারই কারণ খুঁজে পেল না এই অসুখের। অবস্থা বেগতিক দেখে বাকি ছিল প্রবীণ ডাক্তার সুরেশচন্দ্র বসু, বাবা তাঁর কাছে গেল। ডাক্তার সুরেশ তথা ডাক্তারদাদু অসুখের কারণ খুঁজে পেয়ে এক নাগারে ১৮টি ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন আমার বাঁ পায়ে। কিছুই বুঝতে পারিনি মনে হয় কারণ আমি নাকি কোনো নড়াচড়া করতাম না, কান্নাতো দূরের কথা, পরে বড় হয়ে বাবার কাছে শুনেছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে পায়ে শক্তি ফিরে আসতে লাগল। ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও বাবার উৎকন্ঠার সীমা ছিল না। সময় করে কোনো-কোনোদিন আমাকে ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়ে গিয়েছে। এভাবে ধীরে ধীরে আমার পেটের ব্যথাও দূরীভূত হতে লাগল। সুস্থ হয়ে উঠলাম ঠিকই কিন্তু বাঁ পা’টা আর সোজা হয়নি, অনেকটা বাঁকাই রয়ে গেল। ধরে নিলাম এটা আমার অদৃষ্ট। তবুও ডাক্তারদাদুর বদৌলতে সুস্থ পা তো ফিরে পেয়েছি এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! ডাক্তারদাদুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালাম আমরা সবাই।

আমার ৫ বছরের সময় দাদু হঠাৎ করেই ইহলোকের মায়াত্যাগ করলো। তার আগেই দিদিমা পাঘাতে আক্রান্ত হয়েছিল। দাদুর মৃত্যুর তিন মাসের মাথায় দিদিমাও চলে গেল। শেষকৃত্য করে ফিরে এসে বাবা পুলিশ লাইনের কোয়ার্টারে এসে উঠল দুবছরের জন্য একটি ট্রেনিং-এ অংশগ্রহণ করার জন্য। তিন কক্ষ, রান্নাঘর, স্নানঘর, বারান্দা, বাগানসহ ঘেরদেয়ালের টিনের চালের দালানবাড়ি। একেবারে অনন্য সাধারণ! আমার দারুণ ভালো লেগেছিল। বাড়ির পেছনে দিগন্তব্যাপী সবুজ জলাধানীজমি, বড় বড় গাছের তলে লাল ইটের ভূমি রেজিস্ট্রি অফিস, অবৈধভাবে ধৃত মালামালের মালখানাঘর, তারও পেছনে গ্রাম---উঁচু-নিচু ঘনসবুজের রেখা---সারাদিন সাদা সাদা বকপাখির ওড়োওড়ি, ঘুঘুর ডাকাডাকি, হলদে কুটুমপাখির ঝাঁকবেঁধে উড়ে আসা, হলদে রঙের বৌপাখির অদ্ভুত সুরে ডাকা স্বপ্নের মতো মনে হতো। বাড়ির সামনে একটি শাপলাফোটা পুকুর। মুখোমুখি বাড়ির সমসবয়সী কাউসারের সঙ্গে হাঁটুজল অব্দি নেমে ছোট ছোট মাছ ধরেছি। পুকুরের পূর্বপাড়ে বড় রাস্তার ধারে বিশাল খেলার মাঠ, পুলিশের কুচকাওয়াজ, হকি-ফুটবল খেলা, ব্যায়াম করা দেখতাম। পাঞ্জাবি পুলিশ অফিসাররা টমাটোর চাটনি খেতো চেয়ারে আরাম করে বসে। ব্যারাকের দিকেও মাঝামাঝে যেতাম, তখনকার পুলিশরা ছিল ভদ্র এবং ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকে খুব আদরযত্ন করতো। চকোলেট, বকুল ফল, আম, জাম, কাঁঠালের মুচি, বড়ই ইত্যাদি দিত। বাবা তখন পুলিশ লাইনের ভিতরেই অফিস করতো। একজন বুড়ো আর্দালি ছিলেন তিনি প্রতিদিন বাজার করে এনে দিতেন, রেশনে পাওয়া রান্নার কাঠ কুড়াল দিয়ে চিরে চিরে ফালি করে দিতেন, কেরোসিন এনে দিতেন বাবার অনুরোধে বাজার থেকে। এই বাসাতেই জন্ম হয় আমার ছোট ভাই পীযূষের।

চমৎকার পরিবেশ ছিল পুলিশ লাইনে যখন ছিলাম। দারুণ কাটিয়েছি সেই সময়টা। বাবা প্রায়ই দেরি করে ফিরতো, ১১টা-১২টা তো হয়ে যেতোই। বাসায় শুধু আমি আর মা। ছোটভাই যখন মার পেটে একদিন রাতে মা বারান্দার দরজা খুলতেই দেখে একটি কালো মোটা মেটে সাপ শুয়ে আছে। মা বরাবরই ছিল সাহসী। আমাকে ডেকে তুলল ঘুম থেকে, বলল, ‘একটা সাপ বারান্দায়। মনে হয় পেটে বাচ্চা আছে না মেরে ওটাকে কিছু একটা দিয়ে ঠেলে ঠেলে ড্রেনের কাছে নিয়ে যা তারপর চলে যাবে। মনে হচ্ছে রাতে দেখতে পায় না।’ মার সহানুভূতি আমি বুঝতে পারলাম ঠিকই কিন্তু সাপ আর ব্যাঙে আমার চিরকালের ভয়! ভীষণ ভয়! বললাম, ‘আমি পারব না, তুমিই ওটাকে সরিয়ে দাও।’ আমার উপর রেগে বলল, ‘আমি তো পারছি না যদি সাপটা ব্যথা পায় তাহলে অমঙ্গল হবে।’ পরে নিজেই মা কাউসারকে ডেকে আনল। কাউসার ছিল খুবই সাহসী ছেলে। একটি লাঠি দিয়ে ঠেলে ঠেলে সাপটাকে নালার মধ্যে নিয়ে ফেলল ধীরে ধীরে যাতে ব্যথা না পায়। পরে সেটি গড়িয়ে গড়িয়ে চলে গেল পেছনের জলাজমির দিকে। মেটে সাপ জলাজমিতেই বেশি থাকে। তারপর মা রশুন বেটে জলের সঙ্গে মিশিয়ে কয়েক বালতি উঠোন, বাগান ও নালার মধ্যে ছিটিয়ে ছিটিয়ে দিল যাতে সাপ আর না আসতে পারে। তারপর আর কোনোদিন কোনো সাপ দেখিনি অবশ্য মা নিয়মিত রশুনজল ছিটিয়ে রাখতো।

শরৎকালে যখন দুর্গাপুজোর সময় ঘনিয়ে আসতো, স্বচ্ছ নীল আকাশে থোকবাঁধা জলবতী সাদা মেঘের দল উড়ে উড়ে যেতো, নাশিতোষ্ণ বাতাসে দারুণ সুগন্ধী শিউলি-শিউলি আমেজ। পাখির কিচিরিমিচির সারাদিন। সন্ধ্যেবেলায় বাড়ির পেছন দিকের জলাভূমি থেকে ওঠা ধোঁয়া-ধোঁয়া হালকা ধূসর রঙের একটা জাল ছড়িয়ে যেতো চারদিকে---কী যে দারুণ ভালো লাগতো আমার বলে শেষ করা যাবে না! চারদিকটা শিল্পীর আঁকা ছবির মতো মনে হতো। শীত এলে পরে বাবা ঘরে ফিরে না আসা পর্যন্ত মা আমাকে পড়ানোর পাশাপাশি ছোটভাইকে দুধ খাওয়াতো, ঘুম পাড়াতো। ভাইটি যখন ঘুমিয়ে যেতো মশারি ফেলে বেতের সোফায় বসে মা উলের কাজ করতো চাদর মুড়ি দিয়ে আর কোলের উপর খোলা অসম্ভব প্রিয় ডাঃ নীহাররঞ্জন গুপ্তের রহস্যেপন্যাস। আমি পড়ছি না হয় খেলনা গাড়ি নিয়ে মেতে আছি। ঘুম এলে ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুম না এলে বাবা এলে পরে একসঙ্গে ঘুমুতাম। বস্তুুত এই বাসায় আসার পর আমি বাবাকে অন্যরকমভাবে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। কারণ কিছুটা বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে এমন সুন্দর, ভদ্র এবং কাব্যিক পরিবেশে থাকার অভিজ্ঞতা এই প্রথম এবং এটা একমাত্র সম্ভব হয়েছে বাবার জন্যই। বাবার চাকরিসূত্রে এই বাড়ি বরাদ্দ ছিল তাতো জানতাম না বরং আমার বিশ্বাস জন্মেছিল: বাবা সত্যি আমাদের ভালোবাসে না হলে এরকম স্বর্গীয় জায়গায় বাসা নিতে পারে! তাই বাবাকে মনে মনে অজস্র ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি।

দুবছর পর অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে সংঘটিত প্রথম পাক-ভারত যুদ্ধের পর বাবার ট্রেনিং শেষ হলো। আমরা আবার ছোটরা তথা বিহারি কলোনীর পেছনে অবস্থিত নোংরা, দুর্গন্ধময়, বস্তিবস্তি আর্দ্র নিচুভুমির ভানুমামার বাড়ির সেই ঘরে ফিরে গেলাম। তাতে করে মার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমারও। তবে সেটা সাময়িক, কয়েক মাসের মধ্যেই সেই আবার হৈহল্লা, চেঁচামেচি, মেয়েলি ঝগড়া, হাসিঠাট্টা, আনন্দ-বেদনা, পুজো-পার্বণ, বিয়ে, ধর্মীয় গানবাজনামিশ্রিত যৌথ বসবাসের সঙ্গে মিশে গেলাম। এখানকার জীবনেরও একটি আলাদা মাত্রার মাধুর্য আছে, আছে আনন্দ, আছে উন্মাদনা যেটা ক্রমশ আমাকে আচ্ছন্ন করতে লাগল। এই পরিবেশের সঙ্গে খণ্ডকালীন পুলিশ লাইনের স্বর্গীয় অনুভূতির কোনো মিল নেই, একেবারে সম্পূর্ণ আলাদা। এর জন্যও বাবাকে আমি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানালাম মনে মনে।

একদিন রাতে ঘরে ফিরে বাবা খেতে বসে মাকে বলল, ‘তোমাদের মন খারাপ হয়েছে জানি পুলিশ লাইন থেকে চলে আসার কারণে। কিন্তু এটা চাকরির জন্য হয়েছে। অন্যত্র একটি ভালো বাসা নিতে পারি কিন্তু ভেবে দেখলাম আরও কিছুদিন এখানে সস্তায় থাকতে পারলে বেশ কিছু টাকা জমানো যাবে কারণ সিলেটের গ্রামে জমি কেনা দরকার, ঘরগুলো নতুন করে তৈরি করা দরকার, দাদাকে সাহায্য করতে পারলে কয়েক বছরের মাথায় ভালো চাষবাস করতে পারবেন। শেষ বয়সে আমাকে তো গ্রামেই ফিরে যেতে হবে। ওটাই শেষ আশ্রয়, পূর্বপুরুষের ঠিকানা।’ মা কিছু বলল না। আমি বাবার চিন্তাচেতনা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা শুনে অভিভূত হলাম! কেননা গ্রামের প্রসঙ্গ তুলতে পুলিশ লাইনের সেই বাড়ির পেছনের অবারিত সবুজ সবুজ জলাভূমি এবং ছায়াছায়া ধূসর দূরবর্তী গ্রামের ছবিটি মনে পড়ে গেল।... চলবে

আলোকচিত্র : তরুণ বয়সে বাবা। ডিসি অফিসের সামনে এবং ফৌজদারি ভূমি রেজিষ্ট্রি অফিসের কাছে পুলিশ ফাঁড়ি শতবর্ষে এখন জরাজীর্ণ। পুলিশ ফাঁড়ির পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ছোটরার রাস্তা সে রাস্তা আমরা চলাচল করতাম। পুলিশলাইনের সেই পাশাপাশি দুটি বাড়ি আজও আছে।
লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ০২, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test