E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অতলান্ত পিতৃস্মৃতি পর্ব ৮

২০১৪ জুলাই ০৫ ১৮:০০:৪৩
অতলান্ত পিতৃস্মৃতি পর্ব ৮

প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

বাসার পাশ দিয়ে বয়ে চলে গেছে খাল। এটা আগের বাড়ির পেছনের খালটিরই ধারা, তবে পৌরসভার লোক এসে প্রতি সপ্তাহে পরিষ্কার করে দিত বলে ময়লা অত জমতো না, দুর্গন্ধও ছিল না। বর্ষার সময় টলটলে জল থাকতো, ছোট ছোট মাছও ধরেছি গামছা পেতে, কখনো বড়শি দিয়ে। খালের পাড়টাই কাঁচারাস্তা। এই রাস্তাই জেলখানা রোড পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। এখানে একটি টেপকল ছিল। এখানে দাঁড়ালে দেখা যায় ডান দিকে কালিয়াজুড়ির রাস্তা আর বামদিকে জেলখানা রোডের মোড় যা চিটাগাং গ্রান্ড ট্রাঙ্করোডের সঙ্গে মিশেছে। এই তিভূজ মোড়ে একটি বিশালাকার বট গাছ ছিল। তার নিচে পান-সিগারেটের দোকান, চা-স্টল ছিল; ফলমূল, গামছালুঙ্গি ইত্যাদি বিক্রি হতো। এখানে একটি পুলিশ ফাঁড়ি।

ফাঁড়ির সামনে দিয়ে ডানদিকে চলে গেছে গ্রান্ড রোডটি পুলিশ কোর্ট, জেলাবোর্ড অফিস, কেন্দ্রীয় জেলখানা, কুমিল্লা টেকনিক্যাল কলেজ, পৌরসভা, ঝাউতলা ওয়াপদা অফিস, লাশকাটাঘর, পুলিশলাইন মোড়, কুমিল্লা কলেজ, পুলিশলাইন প্রাইমারি স্কুল, পাসপোর্ট অফিস, শাসনগাছা, ক্যান্টনমেন্ট হয়ে ঢাকার দিকে। আর বামদিকে সড়কের দুপাশে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, হাজতঘর, চা-মিষ্টির দোকান, বিহারিকলোনীর গেট, মসজিদ, রেজ্জাক মিয়ার পুকুর, জেলা পুলিশকোর্ট (বাবার অফিস), পুলিশকোর্টের উকিলদের বার, ভানুমামার আদর্শ হিন্দু হোটেল, চৌমাথার বাঁ পাশ দিয়ে মিশনারি স্কুল, পুলিশ স্টেশন কাব, ক্যাথলিক র্গীজা, সরকারি গৃহনির্মাণ অফিস, এএসপির বাসভবন, ঈদগাহ মোড় বা সার্কিট হাউস মোড়, ডাকঘর, মোগলটুলি, রাজগঞ্জ বাজার মোড় হয়ে ছাতিপট্টি, চকবাজার হয়ে ফেনি, চট্টগ্রামের দিকে। এই জেলখানা রোডের মোড়ে এখনো আছে জেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, হাজতখানা অর্থাৎ যাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলে ফৌজদারি বা কাচারিপাড়া। এর পেছনে মাঠ এবং পাইক পুকুর। পুকুরের উত্তর পাড়েই আমাদের বাসা। বাসা থেকে বৃটিশ আমলে তৈরি লাল সাব-রেজিস্ট্রি অফিসভবন দেখা যায়। এই দালান বাড়িতে আসার পরে বাবার আসা-যাওয়ার রাস্তা হলো এই জেলখানারোড এবং খালের এপারের স্যাতস্যাতে কাঁচাপথ। খালের ওপারেই ছোটরা সরকারি অফিসারদের কলোনীপাড়া। এলিট শ্রেণীর জন্য সংরক্ষিত ঝকঝকে ভবনসমূহ। চমৎকার পরিবেশ ছিল।

এপারে সারিবদ্ধভাবে যাদের বাসা ছিল, জীবনবীমার সেলসম্যান, জজকোর্টের পেশকার আবদুল মান্নান, তারপর উকিল, আবার জজকোর্টের পেশকার তারপর প্রাক্তন পুলিশ অফিসার সরদার সাহেবের দোতলা বাড়ি। এই বাড়িগুলোর সকল ছেলেমেয়ের সঙ্গেই খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল আমার। বছর খানেকের বড় কিশোর, তার ছোট বোন হেনা, উকিলের ছেলে দীদার, আমার এক বছরের বড় খুকু, তার ছোটভাই খোকা, পুলিশ অফিসারের ছেলে মধু একসঙ্গে খেলাধুলা করতাম। পুকুরে সাঁতারকাটা, ডুব দিয়ে মাছ ধরা, দাপাদাপি কম করিনি! রোডের পাশেই বলে মধুদের বাসায় বিদ্যুৎ লাইন ছিল। সরকারি কলোনীর কিছু ছেলের সঙ্গেও ভাব হয়েছিল। কিশোরদের বাসার সামনে ছিল বড় একটি শিমুলগাছ। তার তলেই বেশির ভাগ সময় আমরা খেলতাম--ফুটবল, ক্রিকেট, কানামাচি ভোঁ ভোঁ, মার্বেল, তাসখেলা ইত্যাদি। বনভোজনও করেছি। এই পাড়ার সকলকেই বাবা চাকরিসূত্রে আগে থেকেই চিনতো।

এই বাসায় আসার পর পরই ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে ছোটবোন প্রতিমা তথা বুড়ির জন্ম হয়। পূর্বদিকে আমাদের বাসার সাথেই ছিল ‘এলাচির মা’ নামে এক দজ্জাল মহিলার বাড়ি। তার বাড়িতে বাঁশের বেড়া এবং ফটক দেয়া ছিল বলে আগের বাসায় যাওয়া-আসা করতে পারতাম না। তবে মাঝেমাঝে খোলা পেলে গোপনে পার হয়ে যেতাম। কিন্তু বাবা যখন যেতে আসতে চাইত হেসে গদগদ হয়ে খুলে দিত ওই মহিলা না হয় তার শান্ত ভদ্র জামাই। তবে বেশির ভাগ সময়ই মা, আমি ও ছোটভাই সরকারি কলোনী না হয় কাচারিপাড়া হয়ে অনেক পথ ঘুরে বিহারিকলোনীর ভিতর দিয়ে আগের বাসায় যেতাম লক্ষ্মীমাসি, মেসোমশাই, দুলালমামা, কল্যাণীমামী, দিদিমণি, দীপু, কৃষ্ণ ও আভা রানীর সঙ্গে দেখা করতে। ওই বাড়ির পাশের বাড়ি আবার জজকোর্টের একজন পেশকারের, তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়ে সঞ্জু, রওশন, মঞ্জু, রঞ্জু ও ছোট মেয়ে মিলুর সঙ্গে খুবই ভাব ছিল আমার।

রওশন আপা ফর্সাদেহী এবং দারুণ সুন্দরী ছিলেন। তীক্ষ্ণ সুন্দরী মিলুকে খুব ভালোলাগতো বলে পেশকার সাহেব আমাকে জামাই বলে ডাকতেন। এই পরিবারটি আমাকে খুবই আদর করতো। কত অলস সময় যে এই বাড়িতে কাটিয়েছি নানা রকম খেলাধুলা করে ভাবলে মনটা কেমন শূন্য শূন্য লাগে আজ। কত আকাম-কুকামও করেছি রঞ্জুদের গাছগাছালিভরা বৈঠক ঘরের পেছনে নির্জনে কারো কারো সঙ্গে, অবশ্য সেটা ছিল বয়োসন্ধিকালের প্রশ্রয় মাত্র। প্রকৃতির শিকার বলে কথা! কেউ কেউ দেখে ফেললেও কখনো কিছু বলেনি। এক রকম উদারই ছিল তখনকার সামাজিক পরিবেশ। রঞ্জুর বাবা ফর্সাদেহী মৌলভী পেশকার সাহেব খুব কড়া মেজাজের মানুষ ছিলেন কিন্তু বাবাকে খুব সমীহ করতেন। নতুন বাসায় উঠে আসার পর কেন যেন বাবার প্রতি আগে যে দুশ্চিন্তাটা ছিল সেটা দ্রুত কেটে গেল। সম্ভবত আগের গিঞ্জি, নোংরা বিহারিকলোনী এবং ওই ময়লা জঙলামতন খালসংলগ্ন স্যাঁতস্যাঁতে জায়গাটা ছেড়ে আসার ফলেই হবে। অর্থাৎ পরিবেশ পরিবর্তনের ফলেই এটা হয়েছে।

কথায় বলে, সুপরিবেশে পড়লে অমানুষ মানুষ হতে বাধ্য। অসুন্দর সুন্দর হয়ে যায়। তারপরও বাবা প্রতি মাসে কয়েকবারই বিহারিকলোনীর ভিতর দিয়ে বাসায় ফিরতো তাদের ভালোমন্দ খোঁজ-খবর নেয়ার জন্যই। কারণ অনেক দিনের পুরনো সম্প্রীতি বলে কথা। আর এই কারণেই এরাও মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা আর স্থানীয় বাঙালি রাজাকার, আল-বদরদের হাত থেকে বাঁচাতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। যা আমরা কোনোদিন ভুলতে পারবো না। তারাই আমাদের পাঁচটি মানুষের নবজীবনদাতা। এই বাসায় উঠে আসার প্রায় দুবছরের মাথায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। ছোটবোন বুড়ির বয়স তখন মাত্র চার মাস। তখন তো রাজনীতি, আন্দোলন, যুদ্ধ এত কিছু বুঝতাম না। বাবা ও হরেন জেঠু প্রায়ই আমাদের ঘরে বসে যখনই সময় হতো আলাপ করতেন। ৭ মার্চের পর থেকেই শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, পাকিস্তানি সেনা বাহিনী যে কোনো সময় আক্রমণ করতে পারে, পুলিশ লাইন তাদের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। কারণ অধিকাংশই বাঙালি পুলিশ, তাদের হাতে অস্ত্র আছে। বাঙালি পুলিশ যে কোনো সময় সরকারের বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। ফলে শহরের মানুষজন বেশ সন্ত্রস্ত ছিল। অনেকেই বিপদের আশঙ্কা টের পেয়ে পরিবার-পরিজনকে নিরাপদ আশ্রয় গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছিল। বাবা তখন কুমিল্লার উপজেলা বরুড়া থানায় কর্মরত।

আগাম বিপদাশঙ্কা টের পেয়ে ছুটি নিয়ে কুমিল্লা চলে আসে। কুমিল্লার দিকবিদিক তখন হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনে একেবারে অগ্নিভূমি! স্কুল-কলেজ, কারখানা, অফিস আদালত সব বন্ধ একমাত্র সদর হাসপাতাল, মুদির দোকান আর কাচাবাজার ছাড়া। প্রতিদিনই ছাত্রছাত্রীদের মিছিল, মশাল মিছিল, সভা ইত্যাদি চলছেই। এভাবে ২৫ মার্চের দিনও আমরা শিখাদের উঠোন থেকে পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অর্থাৎ জেলখানারোড হয়ে ঘনঘন ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আশপাশ প্রকম্পিত করে জঙ্গি মশাল মিছিল ছোটরা সরকারি কলোনীর ভিতর দিয়ে জজকোর্টের দিকে চলে যেতে দেখেছি। মিছিলকারীদের হাতে মশাল ছাড়াও থাকতো ইয়াহিয়া, ভুট্টোর অঙ্কিত বিকট-বিকৃতমুখ, বিভিন্ন স্লোগান লিখিত এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিওয়ালা ফেস্টুন। স্বাধীন বাংলার পতাকা। বাবা একদিন বলল, ‘এই সবুজ-লাল-হলুদ মেশানো পতাকাটির নকশা করেছেন কুমিল্লারই সন্তান তুখোড় ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাস।’ তখন তো চিনতাম না, স্বাধীনতার পরে আলাপ হয়েছিল। তার ছোটভাই কমল ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অনুজপ্রতিম বন্ধু। এখন আমেরিকা প্রবাসী।

যতদূর মনে পড়ে সেই উত্তাল দিনগুলোতে মিছিলের সামনের সারিতে থাকতো সাদা ও কালো কাপড়ের বড় ব্যানার তাতে ‘স্বাধীনতা’; ‘কুমিল্লা স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ’; ‘ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ইত্যাদি লেখা থাকতো। স্লোগানগুলো আমাদের মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল যেমন ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’; ‘ইয়াহিয়ার গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে’; ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’; ‘ঢাকা না পিণ্ডি, পিণ্ডি, পিণ্ডি’; ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’; ‘বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই, এ লড়াইয়ে জিততে হবে’ ইত্যাদি। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও থাকতো। মিছিলের মাঝখানে হারমোনিয়ম বাজিয়ে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে গেয়ে মিছিলের সঙ্গে চলতো গাইয়ের দল। আমরা অনেক সময় মিছিল আসার শব্দ শুনেই দৌড়ে যেতাম জেলখানারোডের মোড় পর্যন্ত যে মিছিলগুলো এই রোডে ঢুকতো না, কাচারিপাড়া হয়ে চলে যেতো জজকোর্ট কিংবা মোগলটুলি, রাজগঞ্জ বাজারের দিকে। যেগুলো ঢুকতো মধুদের বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। আমারও মিছিলের সঙ্গে চলে যাওয়ার দারুণ ইচ্ছে হতো।

এক রকম চাপা উত্তেজনায় রক্তের প্রবাহ দ্রুত হয়ে যেতো, ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়তো। কিন্তু বাবার সাবধানবাণীর কথা স্মরণ করে যেতে পারতাম না। কিশোর, মধু, খোকা এরা চলে যেত যতদূর যাওয়া যায়। মিছিলের শেষে দেখতাম পুলিশ ভ্যানের বহর। বাঙালি পুলিশ আর কালো রঙের পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা মিলিশিয়া পুলিশ দেখে বুঝতে পারতাম দুয়ের পার্থক্য। বুকের কাছে গুলির বাক্সো, পায়ে বুটজুতো, মাথায় জাল জড়ানো লোহার হেলমেটপরা হাতে বন্ধুক, শর্ট মেশিন গান বা এসএমজি জাতীয় আধুনিক অস্ত্র থাকতো। এই অস্ত্রগুলোর নাম বাবাই শিখিয়ে দিয়েছিল আমাকে।... চলবে

আলোকচিত্র : এই সেই চিরচেনা জেলখানা রোড। ঐতিহাসিক রাজগঞ্জ কাচাবাজার।

লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ০৫, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test