E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অতলান্ত পিতৃস্মৃতি পর্ব ০৯

২০১৪ জুলাই ০৬ ১৮:০৪:০১
 অতলান্ত পিতৃস্মৃতি পর্ব ০৯

প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সংঘর্ষের খবর দৈনিক পত্রিকায় দেখতাম। বাসায় দৈনিক সংবাদ রাখতো বাবা। বড় বড় ছবি দেখেছি সংগ্রামরত মানুষের। বঙ্গবন্ধু, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বা ভুট্টোর। তখন একটা থমথমে ভাবও শহরব্যাপী নেমে আসছিল যেন। কিছু একটা হবে এরকম শঙ্কিত ভাব, উৎকন্ঠা মানুষের চোখেমুখে লক্ষ করতাম। শহর ছেড়ে ধীরে ধীরে মানুষ চলে যেতে লাগলো গ্রামের দিকে বা নিরাপদ আশ্রয়ে। দূরদর্শী হিন্দুরা তো আরো আগেই। বাবা বললো, ‘পাকিস্তানিরা হামলা করতে পারে সেরকম ঘোট পাকাচ্ছে।’

আগেই বলেছি বাবার সঙ্গে বহুবছরের বন্ধুত্ব ছিল বিহারি, পাঞ্জাবি, পাঠান এবং নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে। নেতাদের অধিকাংশই ছিলেন উকিল। বেশ কিছু পাঞ্জাবি আর্মি অফিসার যারা অনেক বছর বাংলাদেশে ছিলেন তাঁরা হিন্দু বা মুসলিম বাঙালির সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। তাঁরা মানুষ মারা বা অত্যাচার করেছেন কমই। তাঁরা যে পাকিস্তানি শাসক ও শোষিত বাঙালির মূল সমস্যা-সঙ্কটের কথা ভালো করেই জানতেন, এটা বাবার কথায় জানতে পেরেছিলাম।

ইচ্ছে করলে পাকিস্তানিরা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধটা এড়াতে পারতো। তা তারা করেনি তার প্রধান কারণই ছিল বিলাসী সেনা শাসকদের ক্ষমতার লোভ। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে সকল পাঞ্জাবি অফিসার ও সেনা এসেছিল তারাই ছিল বাবার ভাষায় ‘নরখাদক’ আর ‘ফেরোসাস’! তবে বেলুচিস্থানের পাঠান সেনা বা প্যারামিলিটারি বাহিনীর সদস্যরা পাঞ্জাবিদের প্রচন্ড ঘৃণা করতো। তারা বিনা কারণে মানুষ মারার বিরোধী ছিল। সম্ভবত বাবা এসব তাঁর বিজাতীয় বন্ধুদের কাছেই শুনে থাকবে।

হরেন জেঠু, কিশোরের বাবা মান্নান সাহেব প্রমুখের সঙ্গে বাবা এসব বলতো শুনতাম। বাবা এটাও বলেছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, যারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসেছিল প্ররোচিত হয়ে তারাই ২৫শে মার্চ রাত থেকে বিজয় দিবস পর্যন্ত অকাতরে মানুষ মেরেছে, ধর্ষণ, অত্যাচার করেছে। রাজাকার, আল-বদর, আল-সামস, শান্তিকমিটির লোকজন এমনকি মুসলিম লীগের নেতারাও পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করেছে প্রকাশ্যে, নিজেরাও নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। বেশি মানুষ মেরেছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনীত পাঞ্জাবি, মোজাহের তথা বিহারিরা।

অবশ্য এদেশের বিহারিরাও বাঙালি মেরেছে প্রচুর। ২৫শে মার্চের আগেই এক এক করে আগের অর্থাৎ ভানুমামার বাড়ির সবাই চলে গেল গ্রামে। লক্ষ্মীমাসি এসে মাকে বললো, ‘তোর মেয়েটি একেবারেই ছোট এখনই এদের নিয়ে নদীর ওপারে চলে যাওয়া ভালো। কখন কী হয় বলা যায় না। সিলেট তো আর যেতে পারবি না। শুনলাম পথঘাট বন্ধ করে দিয়েছে সংগ্রামের লোকেরা।’ মা যে এসব বোঝে না তা নয়। বললো, ‘রীনা, বুড়ি এত ছোট যে ওদের নিয়ে পথে ঘাটে কোন্ বিপদে পড়ি এটাই ভাবছি। তবুও পটুর বাবা লোক লাগিয়ে রেখেছে বেশি বিপদ টেরে পেলে সুযোগমতো আমাদের ওপারে পাঠিয়ে দেবে। ত্রিপুরায় ঘনিষ্ঠ লোকজন আছে ওখানে থাকতে অসুবিধে হবে না। অবস্থা বুঝে পটুর বাবা পরে যাবে।’ ইতোমধ্যে হরেন জেঠু, কট্টোর হিন্দু জেঠিমা, দুই মেয়ে, তপনদা ও স্বপনদাকে রেখে এসেছেন নদীর ওপারে নিরাপদ জায়গায় এক আত্মীয়র বাড়িতে। যে কোনো সময় ভারতে চলে যাওয়া যাবে।

এক এক করে কিশোর, দীদার, খুকু, মধুরাও চলে গেল গ্রামে। ওদিকে সঞ্জু-রঞ্জু-মিলু এবং কলোনীর বন্ধুরাও। তবে বিহারিকলোনীর দু-একজন বন্ধু ছিল যেমন শামীম, ইয়াসিন, চাঁদ ওরা ছিল, ওরা তো থাকবেই যেহেতু ওরা বিহারি, পূর্ব পাকিস্তান তাদের মাতৃভূমি। রাজনীতি নিয়ে তারা আদৌ মাথাও ঘামাতো না। ছোট-ছোট ছেলেমেয়ে না থাকলে যে কোনো বসতি, পাড়া ভূতুড়ে হয়ে যায়। তেমনি হয়ে গেল এত বড় ছোটরা মহল্লাটি। পুকুরসংলগ্ন এই পাড়ায় একমাত্র আমিই ছেলে এবং একা।

ছোটভাইটি তখনো ছোট সে বালি দিয়ে, খেলনা নিয়ে একা একাই খেলে, ছোট দুটো বোনকে কোলে নিয়ে বসে থাকে। আমিও মার মতো একা হয়ে গেলাম। যেমনটি একাকী শান্ত পুকুর, তার পাড়ে দাঁড়ানো ডুমুরগাছ, শিখাদের উঠোনের আমগাছ কিংবা বাঁকা সুদীর্ঘ নারকেলগাছটি। শিখারা যেদিন চলে যায় ঠিক দুপুরের আগে, সেদিনও খুব ভোরবেলা জেলাবোর্ড অফিসের প্রাঙ্গণ থেকে শিউলি ফুল কুড়িয়ে নিয়ে এসেছি। মালা গেঁথেছি, তখন আমরা মালা গেঁথে গলায় বা হাতে পরে স্কুলে যেতাম। মৌ মৌ গন্ধে মনটা ফুরফুরে থাকতো। বাবারও হাতে পরিয়ে দিয়েছি মাঝে মাঝে, বাবা গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে অফিসে চলে যেতো। সেই মালা শুকিয়ে বিবর্ণ হওয়ার আগেই শিখারা চলে গেল।

ওদেরকে কিশোরদের বাসার সামনের বড় শিমুল গাছটা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছি আমি। মনটা এত বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিল যে বিশাল একটি পাথর যেন মাথার উপর কেউ চাপিয়ে দিয়েছিল সেদিন। শিখা বলেছিল, ‘তোমরা কবে যাবে বাড়িতে? আগামীকাল?’ আমি চুপ করেছিলাম। কী উত্তর দেব! আমাদের আর যাওয়া হলো না। আর শিখার সঙ্গে এটাই ছিল আপাত শেষ দেখা। ২৫ তারিখ মধ্যরাতে বিকট রকম দ্রাম, দ্রুম, ঠাস ঠাস, টা টা টা শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল সবার। লাফ দিয়ে উঠে বসলাম বিছানায়। কোথা থেকে এই শব্দ আসছে সহসা বুঝতে পারলাম না ঘুমের ঘোরে। রাতের বাতাসে একটু হিম। আধখোলা জানালা দিয়ে দেখলাম পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের আকাশ ভীষণ লাল! ক্ষণে ক্ষণে হলদে আর কমলা রঙের আগুন কুণ্ডুলি পাকিয়ে উঠছে উপরের দিকে শব্দ করে আবার নিভে যাচ্ছে। পুরো শহরই মিসমিসে কালো অন্ধকার। অনবরত শব্দ করে বোমা না কি যেন ফাটছে আর চারদিক ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। মানুষের হৈহল্লাও অস্পষ্টভাবে ভেসে আসছে।

বারুদের তেজস্ক্রিয় খুশখুশে গন্ধ বাতাসে ধেয়ে আসছে এদিকেই। বাবা গায়ে শার্ট চড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। আমিও গেলাম বারান্দায়। মাও উঠে এসেছে পেছনে পেছনে। ছোটভাই ও বোন দুটো গভীর ঘুমে। দেখলাম শিখাদের উঠোনে হরেন জেঠু ও কালীদা দাঁড়িয়ে। বাবা হরেন জেঠুকে বললেন, ‘পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে।’ হরেন জেঠু বললেন, ‘হ্যাঁ। পুলিশ লাইনই হবে। শেষ পর্যন্ত নামলো সামরিক জান্তারা!....স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না কিন্তু জেলখানারোড ধরে মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে, ছুটছে, দেখুন।’ বাবা বলল, এরা পুলিশই হবে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধই লেগে গেল দেখছি! কালীদা কালো চাদর গায়ে জড়িয়ে একটা বড় রামদা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল দেখে বাবা বললো, ‘কালী পাগলামি করো না। সকাল পর্যন্ত দ্যাখো কী হয়।

অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। সাবধান!’ জেঠু আবার বললেন, ‘কালী বেরোবি না ঘর থেকে। অবস্থা বুঝে সকালের আগেই শহর ছাড়তে হবে।’ এমন সময় কিশোরের বাবা এগিয়ে এলেন, বললেন, ‘সকালের মধ্যেই মিলিটারি ছড়িয়ে পড়বে শহরে। যে যেভাবে পারছে পালাচ্ছে। আপনারাও সরে পড়ুন এখনই। কী হয় বলা যায় না।’ হরেন জেঠু বললেন, ‘কী বলেন বাবু, পরিস্থিতি আমার কাছেও ভালো ঠেকছে না। চলুন আপাতত নদীর ওপারে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাই।’ কত ঘন্টা পর্যন্ত চললো প্রচন্ড গোলাগুলি তা মনে নেই। আমার তখনো বদ্ধমূল ধারণা পুলিশ ছাড়া আর কাউকে মারবে না পাকিস্তানি মিলিটারিরা। মা কখন যে ঘরে চলে গেছে ঘরের ভেতরে জানি না।

বাবা বললো, ‘দেখি কী করা যায়। আপনারা গেলে এখনই বেরিয়ে পড়ুন।’ কালীদা তো তখনই বেরিয়ে গেছে। এর পর হরেন জেঠু দরজা লাগিয়ে একটি ঝোলা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন অন্ধকারে। তাঁদের চলে যাওয়া দেখে ভীষণ খারাপ লাগতে শুরু করলো আমার। অসহায় হয়ে গেলাম মনে হলো। স্তব্ধ চারদিক। কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। মৃতপুরী যেন শহরটা। বাতাসে পোড়া বারুদের ভীষণ দুর্গন্ধ। ঘরে ফিরে বাবা নিজে নিজেই বললো, ‘পুলিশ তো সরকারি কর্মচারী। পুলিশ লাইন আক্রমণ করলো কেন মিলিটারিরা? তাহলে কী বাঙালি পুলিশকেও মারবে ওরা?’ বাবা কেবলি ঘরবার করতে লাগলো। মা যদিওবা বরাবরই সাহসী তবুও কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল। এভাবে আর না ঘুমিয়ে সকালবেলা মা যথারীতি জলখাবারের ব্যবস্থা করছিল। বাবা রেডিও শুনছিল বৈঠকঘরে। এমন সময় মা হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, ‘বাইরে কালো পোশাকপরা লোকজন ঘোরাফেরা করছে! আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছে একজনের।’ মার মুখ একেবারে রক্তশূন্য সাদা।

মুখটা গত রাত থেকেই শুকিয়ে আছে। বাবা কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে মার দিকে তাকিয়ে থেকে পরে রেডিওটা বন্ধ করে শার্ট চড়িয়ে বাইরে গেল। আমরা ঘরে। এবার আমি ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম! মা আমাদের তিনজনকে আগলে বিছানায় বসে রইল। আমার বুক ভীষণ ধুকধুক করছিল। ভয় হচ্ছিল বাবা যদি আর ফিরে না আসে! আর মেরে ফেললে বন্দুকের শব্দ তো হবে। সেই শব্দটাই যেন অধীর প্রতীক্ষার ল্ক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ালো আমার মনে। মা অনবরত ঈশ্বরকে ডাকতে লাগলো। দুচোখ তাঁর ছলোছলো। কিছুক্ষণ পর বাবা মাঝখানের করে দরজার কড়া নেড়ে বললো, ‘পটুরে দরজা খোল আমি।’ আমি দ্রুত উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। বাবা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললো, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের আর্মি গার্ড দিচ্ছে এই এলাকা। দুদিন আর্মিরা গার্ড দেবে দিনের বেলা।

ভয়ের কিছু নেই উর্দু ভাষায় জানালো ওরা।’ ভয়ের কিছু নেই বললেই ভয় চলে যায়? আমরা জলখাবার গেলাম। গলা দিয়ে কি আর নামতে চায় খাবার! বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ‘ভয় করিস না বাবা। আমি যেভাবেই পারি তোদেরকে বাঁচাবোই। এই শহরে এত বছর আছি, মানুষের জন্য তো কম করিনি কে আমাদেরকে মারবে? মারলে মিলিটারিরাই মারবে। যেহেতু যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ভবিষ্যতের কথা বলা যায় না।’ ...চলবে

আলোকচিত্র : (বামে) জেলা পরিষদ প্রাঙ্গণের এই কোণায় ছিল কয়েকটি বড় বড় শিউলি ফুলের গাছ। শিউলি ফুলের আলোয় আলোকিত হয়ে থাকত জায়গাটা। এখানেই রোজ ভোরে ফুল কুড়োতে যেমান আমি ও শিখা। (ডানে) বিহারিকলোনীর রহমত চাচা, একাত্তরে তরুণ ছিলেন, আমাদেরকে বাঁচিয়েছিলেন রাজাকারদের হাত থেকে। তারা কারো ক্ষতি করেননি। এখন তিনি চকবাজারের গর্জন খোলায় ইলেকট্রিক মিস্তিরির কাজ করেন। স্বাধীনতার পর বাবা এদেরকে আগলে রেখেছিল।

লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ০৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test