E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

অতলান্ত পিতৃস্মৃতি পর্ব ১০

২০১৪ জুলাই ০৭ ১৭:৫৮:২৫
অতলান্ত পিতৃস্মৃতি পর্ব ১০

প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

বাবা আমাদেরকে অভয় দিল। আমরা ঘরবন্দী হয়ে রইলাম। শুরু হলো মরা-বাঁচার মাঝখানে অনিশ্চিত এক জীবনের। জানালা দিয়ে বারান্দা থেকে পুকুরের দক্ষিণ পাড়, জেলখানারোড এবং পশ্চিম পাড়ের দৃশ্য দেখা যায়---কেউ কোথাও নেই। একটি কাকপক্ষী পর্যন্ত উড়ছে না। মনে হল পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে আমাদের বাসাটি। দুপুরে ডালভাত খেলাম কিন্তু মা কিছুই খেলো না। খোলা গেট থেকে আমাদের পুকুর ঘাট দেখা যায়। তাই মা স্নানও করতে পারল না।

জানালার ফাঁক দিয়ে দেখলাম পেছনের উঁচু বাঁশের বেড়ার উপরে এধার ওধার পর্যন্ত বন্দুকের মাথায় চকচকে ছুরির মতো কী যেন নড়ে নড়ে চলে যাচ্ছে আবার আসছে গেট পর্যন্ত। খট খট জুতোর শব্দ। এক কাপড়ে সবার সারাদিন ও রাত কাটলো আমাদের। ছোটভাই ও বোন দুটো পর্যন্ত কেমন যেন নীরব হয়ে গেল। বাইরে খেলাধুলা বন্ধ। উঠোনে ধুলোর মধ্যে গড়াগড়ি যাচ্ছে মাটির ও সিলভারের তৈরি হাঁড়িপাতিলগুলো, খেলনা গাড়ি। এই রাতও কেটে গেল আমাদের তিনজনের প্রায় নির্ঘুম। বাবা একাধিকবার ঘরবার করেছে আমি টের পেলাম নিজের ঘরে শুয়ে থেকে।

কোনোকিছুই ভাবতে ইচ্ছে করছিল না। একটা ধোঁয়াটে ঘোরের মধ্যে আমি বন্দি হয়ে পড়লাম। পরের দিন সকালে উঠে বাবা বলল, ‘আর্মিরা চলে গেছে। আর আসবে না বলল।’ শুনে মা কিছুটা স্বস্তিবোধ করল। বালতি দিয়ে জল তুলে এনে পেছনে রান্নাঘরের সামনে কাকস্নান করল। বাবা আমাদেরকে পুকুরের জলেই স্নান করালো তারপর নিজে করল। দাড়ি আর কাটল না। আর্মিরা চলে যেতেই এক এক করে পেছনের এলাচির মা এসে মাকে বলল, ‘বহু পুলিশ মেরেছে আর্মিরা। শহরে অনেক হিন্দুকে মেরেছে ঘর থেকে বাইরে এনে রাস্তার উপর দাঁড় করিয়ে। বৌ-ঝিদের নিয়ে গেছে ধরে ক্যান্টনমেন্টে। চারদিকে লাশ আর লাশ। পুলিশ লাইন থেকে ঝাউতলা পর্যন্ত পুলিশের লাশের স্তুপ। আহারে হিন্দু পরিবারগুলোর কাউকেই ছাড়েনি কীভাবে যে মেরেছে! বাড়িঘর, দেকানপাট জ্বালিয়ে দিয়েছে। সোনাদানা টাকা পয়সা লুট করেছে বিহারি আর পশ্চিম পাকিস্তানিরা।’ মা বলল, ‘তুমি জানলে কীভাবে? তুমি কি দেখেছ? এখনো তো কার্ফ্যু জারি করা আছে।’ ---‘আরে আমি যাই কীভাবে! বিহারিক্যাম্পের একজন বলল। সে নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে শহরে গিয়ে দেখেছে। নিজেও লুটপাট করে অনেক কিছু এনেছে। সেই তো বলল। বিহারিরা লুটপাট শুরু করেছে শহরে। তোরা সাবধানে থাকিস। জামাই যখন এই এলাকার লোক, আবার পুলিশ অফিসার আশা করি বিহারিরা কিছু করবে না।

তবুও তো মা মানুষের মন বলে কথা।’ এলাচির মা এক কাপ চা খেয়ে চলে গেল। চলে যেতেই মা বলল, ‘করলে তোরাই আমাদের ক্ষতি করবি। তোর গোষ্ঠীই তো চোর। জামাই কম উপকার করেছে তোর চোরচোট্টা ছেলেমেয়েগুলোর! মনে থাকলেই হয়।’ এরপর এলেন সঞ্জুর বাবা। তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে এসে বাবাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘বাবু ভয় করবেন না। আমরা আছি কিন্তু।’ কিশোরের বাবা মান্নান সাহেবও ভিতর দিকের দেয়াল টপকে এসে আমাদের ঘরে এলেন। মাকে বললেন, ‘পটুর মা এলাচির মা এসেছিল না? এই মহিলা আর বিহারি কলোনীর লোকজন জোট হয়ে দেখবেন ক্ষতি করতে চাইবে। এখন আর বেরিয়ে পালিয়ে যাবার উপায়ও নেই। কার্ফ্যু যে কবে পর্যন্ত থাকে কে জানে? ঘরে খাবারদাবারও তো নেই। চিন্তা করবেন না বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেলে চালডাল অন্তত কিনে নিয়ে আসতে পারব। বাবুরও ঘর থেকে না বেরোনোই ভালো। আর কিছু মনে করবেন না, মুসলিম লীগের লোকজন তো হিন্দুদের উপর ক্ষ্যাপা তাই আর সিন্দূর ব্যবহার করবেন না।’ তিনি বাবাকে বললেন, ‘আপনি দাড়ি-গোঁফ ছাঁটবেন না। আর একটি টুপি আমি দেব পরে থাকবেন মাথায়।’ মাকে আবার বললেন, ‘পরিস্থিতি কিছুটা ঠান্ডা হলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আসব গ্রাম থেকে তখন বাসায় আসবেন একলা লাগবে না।

আর যদি দেখেন জীবনের নিরাপত্তার উপর হুমকি এসেছে, তাহলে বাবু আপনাদের পালিয়ে যাওয়াই উত্তম হবে। আপনি তো জানেনই কীভাবে যেতে হবে ওপারে।’ খুবই ভালো মানুষ ছিলেন কিশোরের বাবা মান্নান সাহেব। বাবা-মা তাঁর কথাই শুনল। তাতে খুব উপকারও হল। বিকেলবেলার দিকে চারদিকে লোকজনের বেশ হাঁটাচলা লক্ষ করলাম। কলোনীর মাঠে লোকজন জটলা করেছে। কলোনীর ছাদেও লোকজনকে দেখলাম। প্রতি কোয়ার্টারের ছোট্ট বারান্দায় মানুষের নড়াচড়া। তারপর অবাক হয়ে দেখলাম জেলখানারোড ধরে মানুষ হাঁটছে। ছুটছে লোকজন মালামাল নিয়ে, সাইকেলে, রিক্সায় করে---গন্তব্য গোমতী নদীর দিকেই মনে হল। বাবাও দেখল বারান্দায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য। আপন মনেই বলল, ‘কার্ফ্যু কি তাহলে উঠল?’ বাবা গেট দিয়ে বেরিয়ে কলোনীর দিকে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল, ‘দু-তিন ঘন্টার জন্য কার্ফ্যু তুলেছে মানুষের বাজারহাট করার জন্য।’ মা চিন্তিত কন্ঠে বলল, ‘আপনার যাবার দরকার নেই। চালডালতেল যা আছে চলবে। আপনি তো দয়ার সাগর রেশনের সব কিছু দান করে দিয়েছেন গরীব পুলিশদের!

এখন সেগুলো থাকলে তো কাজে লাগত।’ এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে মা মনে হয় বিরক্ত হচ্ছিল তাই বাবাকে কড়া কথাগুলো বলল যা এই প্রথম শুনলাম আমি। এর আগে কোনোদিন শুনিনি।’ পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়। বাবা বলল, ‘সেসব বলে এখন লাভ নেই। দান করলে কমে না। আমি একটু কাচারির দিক থেকে আসি। দেখে আসি কী পরিস্থিতি।’ বাবা সিভিল ড্রেসেই মাথায় টুপি পরে বেরোলো। কর্মপাগল মানুষটাকে যে ধরে রাখা যাবে না মা খুব ভালো করেই জানে। তাই কিছু বলল না, শুধু গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘তাড়াতাড়ি ফিরবেন। ঠাকুর, তোমার ইচ্ছে ঠাকুর!’ বাবা তো বাইরে গেল না বরং আমার দুশ্চিন্তার ঝাঁপি খুলে দিয়ে অজস্র কালো সরীসৃপ ছেড়ে দিয়ে গেল!

সেই যে আগে বাবার জন্য দুশ্চিন্তা হত আমার----সেটা যেন ঝট্ করে কপাট খুলে দাঁড়ালো মনের মধ্যে। বাবা ঠিকমতো ফিরে আসবে তো! আসতে পারবে তো? পথে যদি কিছু হয়! আর্মিরা যদি ধরে নিয়ে যায়? কী হবে তাহলে আমাদের? নানান দুশ্চিন্তা, উৎকন্ঠা শুরু হয়ে গেল। আমি বৈঠকখানার জানলা দিয়ে শিখাদের পরিত্যক্ত নির্জন বাসাটির দিকে তাকালাম। মা বিড় বিড় করে রাজরাজেশ্বরী কালীদেবীর নাম জপতে লাগল। আমি পাশের বাসাটি দেখতে লাগলাম। কয়েকদিন আগেও কত প্রাণবন্ত ছিল বাসাটি! শিখারা চলে যেতে না যেতেই এখন অখন্ড শূন্যতা পরিত্যক্ত বাসাটিকে দখল করে ফেলেছে। আমি জানালার কাছে বসে থেকে বাবার ফিরে আসার পথের দিকে চেয়ে রইলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর কানে ভেসে এলো একটি কন্ঠস্বর। পেছনের কলোনী থেকে মাইকে কে যেন বলছে, ‘প্রিয় কুমিল্লা শহরবাসী, আস্সালামু আলাইকুম। আপনাদের কারো কোনো ভয় নেই। আপনারা নির্ভয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করুন। কেউ শহর ছেড়ে যাবেন না। আপনাদের জরুরি কেনাকাটা, হাট-বাজার করার জন্য সাময়িকভাবে সান্ধ্যআইন তুলে নেয়া হয়েছে। সান্ধ্যআইন বলবৎ থাকা অবস্থায় কেউ ঘরের বাইরে যাবেন না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সিলেটি ভাষার সুরে পরিণত বয়সের কণ্ঠ শুনে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল ঘোষককে।

বেশ কয়েকবার এই ঘোষণা দেবার পর আর শোনা গেল না ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সম্ভবত কালিয়াজুড়ির দিকে চলে গেছে। কিন্তু সন্ত্রস্ত মানুষের ত্রস্ত চলাচল বন্ধ নেই। সবাই শহর ছেড়ে পালাচ্ছে গ্রামের দিকে। কারণ কালিয়াজুড়ি পেরোলেই তো গ্রাম শুনেছি, যদিও কোনোদিন সেদিকে যাওয়া হয়নি আমার। আধঘন্টা পার হওয়ার পর দেখতে পেলাম বাবাকে দ্রুত পায়ে হেঁটে আসতে। মাথায় সাদা টুপি, গায়ে সাদা হাওয়াইই-শার্ট আর ঘিরঙা প্যান্ট। হাতে একটা ব্যাগ সদৃশ কিছু। দেখে প্রাণের মধ্যে শীতল জলস্রোত টের পেলাম। গেটের কাছে অপেক্ষা করতে লাগলাম। যেই দেখলাম বাবা বাসার দিকে আসছে তখন আমি ত্রস্ত পায়ে হেঁটে বাবাকে এগিয়ে আনতে ছুটে গেলাম। বাবার হাত ধরার পর নির্ভার হয়ে গেল মনটা নিমিষে। আগ্রহসহকারে বললাম, ‘অফিসে গিয়েছিলে বাবা?’ বাবার হাত থেকে চটের ব্যাগটি নিলাম। ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখি সওদা। ডিম, ময়দা, চিনি, লবন আর মোমবাতি। বাবাকে দেখলাম চমৎকার মানিয়েছে মুখভর্তি খোঁচা-খোঁচা দাড়ি আর মাথার গোলটুপিতে। একেবারে মুসলমান-মুসলমান লাগছিল। কিন্তু বাঙালিত্বের আদল একটুকুও বদলায়নি। বাবা বলল,‘ কেউ এসেছিল?’ বললাম, ‘না, কেউ না। অফিস বন্ধ ছিল নাকি বাবা?’

বাবা গম্ভীরকণ্ঠে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, তালামারা। কৃষ্ণ মনে হয় গতকাল রাতেই চাবি নিয়ে পালিয়ে গেছে। কেউ নেই অফিস পাড়ায়। পরে বাজার করে নিয়ে এলাম। দু/একটি দোকান খোলা ছিল কিন্তু অনেক মানুষ ভিড় করেছিল বলে দেরি হল।’ বুঝলাম যে বাবা আরও আগে ফিরতে চেয়েছিল, জেনে খুব ভালো লাগল। কৃষ্ণদা পালিয়ে যেতে পেরেছে শুনেও স্বস্তি পেলাম। স্বাধীনতার বহু বছর পরে বাবার মুখে শুনেছিলাম ২৭-২৮ মার্চের কিছু স্মৃতি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। বাবা বলেছিল, ‘রাস্তায় রাস্তায় কত মানুষ যে মেরেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা পাখির মতো! প্রচুর রক্ত চতুর্দিকে তখনো শুকায়নি। রক্তের ওপর দিয়ে লাশগুলো টেনে-হ্যাঁচড়ে নেয়ার দাগ রয়ে গেছে। রাস্তায় মানুষজন আছে, তবে সবাই মালামাল নিয়ে ছুটছে কালিয়াজুড়ির দিকেই। দু-চারটি মুদির দোকান খোলা ছিল। ঈমান আলীর দোকানে গেলে বললেন, ‘বাবু আপনি যখন যেতে পারেননি খুব সাবধানে থাকবেন।

আর কিছু তো নেই, এক সের লবন নিয়ে যান।’ বাবা হাসল, ‘শুধু লবন দিয়ে কি হবে?’ ---‘যুদ্ধের সময় লবন, তেল আর ডিম মজুত রাখতে হয়। কাজে লাগবে।’ বাবা বলল, ‘কত দাম?’ ---‘দশ আনা।’ বাবা অবাক হয়ে বলল, ‘দশ আনা! অন্যরা অনেক বেশি দামে বিক্রি করছে।’ ---‘তারা করুক। আমার এই লবন যুদ্ধের আগে কেনা তাই সামান্য লাভে বিক্রি করছি। এটাই আমার নীতি। বেশি নিতে পারব না বাবু। শুনুন, টাকা পয়সা না থাকলে যখন তখন বলবেন, কিছু হলে আমার নাম বলবেন যে-ই আসুক। আপনার মতো ভালো মানুষকে যাঁরা জানে তাঁরা কেউ মারতে আসবে না এই শহরে। তবুও আপনি বিহারিকলোনীর ভিতর দিয়ে না গিয়ে জেলখানা রোড দিয়ে যান সেটাই নিরাপদ।’ বাবা তাঁর কথাই শুনেছিল। ফেরার পথে পুলিশ ফাঁড়িতে দেখা হয়েছিল পাঞ্জাবি পুলিশ মোহাম্মদ আলী খানের সঙ্গে। সে অভয় দিয়ে বলল, ‘বাবু, তুম্ সাচ্চা আদমী। তোমার কোনো ভয় নাই তুমি ওই বাসাতেই থাকো।

কেউ এলে চিৎকার দিয়ে আমাকে ডাকবে। কোনো বাজে লোক, আর্মি তোমার বাসায় যাবে না বাবু আমি থাকতে। কিন্তু ইন্সপেক্টর প্রফল্লু কুমার দে খুব বেঈমান লোক আছে। তার ভালো হবে না।’ বাবা বিষয়টি জানতো না বলে তখন কিছু বলেনি। শুধু বলেছে, ‘মোহাম্মদ তোমার ইচ্ছা বাবা।’ বেশ কয়েকদিন পরে বাবা পুলিশ লাইন হাসপাতালে গেলে পরে সেই মোহাম্মদ আলীই বাবাকে বলেছে, ‘প্রফল্লুবাবুকে আমিই ধরিয়ে দিয়েছি আর্মির কাছে। বেঈমান খতম হয়ে গেছে।’ বাবা তো এই কথা শুনে পৃথিবীসুদ্ধ টলে উঠেছিল! বিশ্বাসই করতে পারেনি মোহাম্মদের কথা! খোঁজ নিয়ে জানলো, আসলেই তাই। আরেকজন কোর্ট সাব-ইন্সপেক্টর অর্জুন দেব, আর.আই. বা রিজার্ভ ইন্সপেক্টর আবদুল হালিমকেও সে-ই আর্মির হাতে তুলে দিয়েছিল। আরও বেশকিছু হিন্দু ও মুসলমান আওয়ামী লীগ পন্থীকে হত্যার জন্য সে-ই দায়ী।

পাঞ্জাবি পুলিশ ও বিহারিদেরকে লেলিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কোর্ট ইন্সপেক্টর প্রফুল্লকুমার দে যাঁকে দাদু ডাকতাম তাঁকে হত্যা করার পেছনে মূল কারণ ছিল একটি রিপোর্ট। মোহাম্মদ আলী খান ছিল আসলে পাক সেনাবাহিনীর গুপ্তচর। আন্দোলনের সময় যখন কুমিল্লার বাঙালি ডিসি, এসপি, আওয়ামী লীগ নেতারা গোপন বৈঠক করতেন তার সব খবর পুলিশ লাইন থেকে গোপনে পাচার করত এই মোহাম্মদ। এটা পুলিশ লাইনের অফিসাররা ধরে ফেলে এসপিকে জানায়। এসপি সাহেবের বাসভবনে সরকারিভাবেই চারটি বড় বড় দুধেল গাভী থাকত। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করত মোহাম্মদ। কাজেই এসপির বাসভবনে কারা আসাযাওয়া করত, কী কথাবার্তা হত সবই সে পাচার করে দিত ক্যান্টনমেন্টে।

তখন এসপি কবিরউদ্দিন আহমেদ কোর্ট ইন্সপেক্টর প্রফুল্ল দে’কে আদেশ দেন, মোহাম্মদ আলী খানের বিরুদ্ধে একটি তদন্তমূলক রিপোর্ট দেবার জন্য, দিলে পরে তাকে পুলিশ লাইন থেকে কোর্টে বদলি করে দেয়া হবে। আদেশপ্রাপ্ত প্রফুল্ল দে সেই রিপোর্ট লিখে পাঠিয়েছিলেন এসপির কাছে। এই গোপন রিপোর্টের কথা মোহাম্মদ জেনে গিয়েছিল। এটাই ছিল তার আক্রোশ। পাঞ্জাবিদের এই আক্রোশ থেকে শুধু প্রফুল্লবাবুই নন, জেলা প্রশাসক শামছুল হক খান এবং পুলিশ সুপার কবির উদ্দিন আহমেদও বাদ পড়েননি। আর্মিরা এসে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আজও তাঁরা নিখোঁজ। প্রফুল্ল দাদুকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ভানুমামাকেও ধরে নিয়ে যায়। দিদিমা ছোট মামা বাবুল, গীতা, চামেলী, মমতা, নোমিতা মাসিদের নিয়ে বহু কষ্টে আসামের দিকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। আজও অনেকেই জানে না কেন জনদরদী বিদ্বান মানুষ কোর্ট ইন্সপেক্টর প্রফুল্লকুমার দে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিখোঁজ হলেন? যাইহোক, বাবার ফিরে আসার আধঘন্টা পর হঠাৎ করে লোকজনের চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। সন্ধ্যাও উৎরে গেছে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে কোনো বাতি জ্বলল না।

এত বড় কলোনী পাড়াটিও অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেল প্রায়। টিম টিম আলো জ্বলছিল এখানে-সেখানে। ভূতুড়ে অন্ধকারে ডুবে গেল সারা পৃথিবী। দরজা-জানালা সব বন্ধ। হারিকেন জ্বালানো হল। কুপির স্বল্প আলোয় মা রান্নাঘরে রাতের খাবার তৈরি করছে। বড় ঘরটা জুড়ে দমবদ্ধ একটা অসহ্য গুমোট আবহ। বাবা নিচু স্বরে রেডিও শুনতে লাগল সিগারেট টানতে টানতে। তার কপালে দুশ্চিন্তার কয়েকটি রেখা সুস্পষ্ট চোখে পড়ছিল আমার। আমি বিছানায় ভাইবোনকে নিয়ে খেলছি। খেলার মধ্য দিয়ে ওরা ক্লান্ত না হলে রাতে ভালো করে ঘুমুবে না। মাঝরাতে কান্নাকাটি, চিৎকার করা বিপজ্জনক---বাবা মাকে সাবধান করে দিয়েছে।... চলবে

আলোকচিত্র : (বামে) রাস্তার ডান পাশে যে টিরেন ঘরটি দেখা যাচ্ছে সেটা আগে ছিল না। আর যে উঁচু দালানটি দেখা যাচ্ছে সেটা পাইক পুকুর ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে। (ডানে) বাবা ও মা।

লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ০৭, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test