E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অতলান্ত পিতৃস্মৃতি পর্ব ১১

২০১৪ জুলাই ০৮ ১৮:৩৬:১৬
অতলান্ত পিতৃস্মৃতি পর্ব ১১

প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

মাঝে মাঝে বাইরের জমাটবাঁধা ভারী অন্ধকারের পর্দাকে ছিঁড়ে ফেলতো ঠাস, ঠুস, টা টা শব্দ। বন্দুকের গুলির শব্দ সন্দেহ নেই। বাবা সচকিত হয়ে বুঝতে চেষ্টা করতো কোন্ দিক থেকে শব্দটা আসছে। মা বললো, ‘আবার গুলির শব্দ হলো! আবার কাকে মারলো কে জানে!কার মায়ের বুক খালি করলো বর্বর পশুরা কে জানেগো!’ মা যে ক্রমশ ভয়ে চুপসে যাচ্ছে তা সহজেই প্রতিভাত হলো আমার কাছে। হওয়াই স্বাভাবিক এমন পরিস্থিতি তো জীবনে এই প্রথম। যদিওবা ’৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে বাঙালির কিন্তু এমন ভয়াবহ, বাঁচা-মরার সঙ্কটময় পরিস্থিতি ছিল না পূর্ব পাকিস্তানে।

মনে আছে যুদ্ধের সময় যখন-তখন সাইরেন বাজতো। ব্ল্যাক আউট মানে সারারাত অন্ধকার থাকতো শহর। সীমান্তে মাঝেমাঝে গোলাগুলি হতো ঠিকই তাতে মানুষ কোনো ভয় পেতো না। কেউ কাউকে মারেওনি। আমরা দিব্যি বাইরে খেলাধুলা করেছি যতখানি মনে পড়ে। রাতে খেতে খেতে বাবা বললো, ‘আর তো পালিয়ে যাওয়ার পথ নেই মনে হচ্ছে। পাকিস্তানিরা এ্যাতখানি বর্বরতা করবে এটা স্বপ্নেও ভাবিনি! এমন হলে তোমাদের সিলেটের গ্রামেই রেখে আসতাম। সেখান থেকে আসামে মেজদার বাড়িতে চলে যাওয়া কোনো ব্যাপারই ছিল না। তবু দেখা যাক, আমি এদেশে জন্মেছি এদেশেই মরবো। এভাবে তো চলবে না বেশিদিন একটা কিছু সমাধান তো হবেই। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা যেভাবে অকাতরে মানুষ মারতে শুরু করেছে সেটাই ভয়। হিন্দুদের উপর সবচেয়ে বেশি আক্রোশ ভারতের কারণে। কিন্তু হিন্দুরাও তো এই দেশেরই জন্মগত নাগরিক। চিন্তা করো না।’ মা বিশেষ কিছু বললো না। চোখ দুটো শুধু ছলোছলো করছিল।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শুধু। বাবার ধারণাকে আমল না দিয়ে পরিস্থিতি ক্রমশ অন্যরূপ ধারণ করলো। মাস খানেক চলে গেল এভাবে। বাবা ঘর থেকে বেরোলোই না। চেহারাও হয়ে গেছে একেবারে খাস মুসুল্লির মতো। মারও কপালে সিঁদুরের লাল আভা মিলিয়ে যাচ্ছে প্রায়। ঘরের বাইরে বেরোলেই ঘোমটা মাথায়। একদিন সঞ্জু এসে আমাকে কলমা শিখিয়ে দিল। কেউ জিজ্ঞেস করলে ‘লাই লাহা ইল্লাহ্ হু মোহাম্মদুর রসুল্লাহ্’ বলতে বললো। হাফপ্যান্ট খুলে পরীক্ষা করাটাই শুধু ভয়---সঞ্জুর ভাষ্য। নানা রকম খবরাখবর আসতে লাগলো চারদিক থেকে। এলাচির মা প্রায় প্রতিদিন নানা রকম দুঃসংবাদ দিয়ে মাকে ক্রমশ দুর্বল করে দিতে লাগলো। বাবা অসহ্য হয়ে একদিন তাকে ধমক দিয়েছিল, ‘শোনো এলাচির মা, আমি এখনো এই দেশের একজন পুলিশ অফিসার। তুমি যেভাবে পটুর মাকে ভয় দেখাচ্ছো তাতে তুমি সফল হবে না। আমরা এই বাসা এই দেশ ছেড়ে কোথাও যাবো না বলে রাখলাম। বেশি বাড়াবাড়ি করলে উল্টো তুমিই বিপদে পড়বে!’ এই কথায় থতমত খেয়ে গেল এলাচির মা। তার মূল্য উদ্দেশ্য আমাদেরকে ভয় দেখিয়ে এখান থেকে বিদায় করা তারপর মালসম্পত্তি হস্তগত করা। ইতিমধ্যেই রাতের অন্ধকারে শিখাদের বাসা খালি করে ফেলেছে তার চোর ছেলে বাদশা আর চোর মেয়ে এলাচি কিশোরের বাবা নিজে দেখেছেন।

এলাচির মা বাবার ধমকে অপমানিত বোধ করেছিল তাই খারাপ বিহারিদের সঙ্গে আঁতাত করে একদিন কয়েকটি বিহারি যুবককে দিয়ে বাবাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এলাচির মা জানতো না যে বহু বিহারি, পাঠান আর পাঞ্জাবি যারা বহু বছর এদেশে বাসবাস করে আসছে বা জন্ম নিয়েছে বাবাকে যে কী পরিমাণ ভক্তিশ্রদ্ধা করতো! বিহারিদের লিডার ছিল এক পাঠান র্সদার আসগর খান পাহাড়ের মতো তাঁর দেহ ধবধবে ফর্সা। কতবার তাঁর বাসায় আমরা নিমন্ত্রণ খেয়েছি। খুব আদর করতেন তিনি আমাকে। বাবাও তাঁর তিন ছেলেকে খুব স্নেহ করতো। পাঠান সর্দারজী এসে এলাচির মাকে এমন শাঁসিয়ে গেল যে যুদ্ধের পুরো ন’ মাস আর কোনো জ্বালাতন করার সাহস পায়নি সে। সর্দারজী মাকে দেখিয়ে এলাচির মাকে বলেছিল, ‘এই বেলা (আমার মায়ের নাম) বেটি, আমি ওকে ওর শিশুকাল থেকে চিনি। যখন ওর বাবা জলধরবাবু ছিলেন সাব-ইন্সপেক্টার পুলিশ কোর্টের। খুব বড় দিলওলা মানুষ ছিলেন বাবু। বেলা বেটি আমার মেয়ের মতো, কোনো ঝামেলা করলে আমি সহ্য করবো না। আমরা পাঠান মানুষহত্যায় বিশ্বাস করি না। চুরিচামারি পছন্দ করি না। গাদ্দারি আমল দিই না। পাঠান, পাঞ্জাবি, বিহারি যারা চুরি করছে, খারাপ কাজ করছে আমি বিচার করতে না পারি আল্লাহ্ মালিক বিচার করবে। পাপ করলে আল্লাহ্ কাউকে ছাড়বে না। এই পরেশবাবু আমাদের কাকে সাহায্য করেনি বলো? তোমার ছেলে বাদশাকে কতবার জেল থেকে বের করে আনলো মনে নেই?

তুমি বহুত বেঈমান আছো এলাচির মা, সাবধান বলছি! কোনো ঝুটঝামেলা করবে না বলে দিলাম, এ্যাঁ!’ তবে সর্দারজীর দুছেলে হিন্দুদের মালামাল লুটপাট করেছিল রাজাকারদের সঙ্গে। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে কীভাবে পাকিস্তানে চলে যায়। স্বাধীনতার পর সর্দারজীকে মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে বাবাই রক্ষা করেছিল। পরে পাকিস্তান চলে যান তিনি। এরপর সর্দারজীর আদেশে দিনে রাতে বয়স্ক বিহারিরা, পাঠানরা এসে আমাদের খোঁজখবর নিত। হাট-বাজার করে দিত। এই এত বড় শহরে একমাত্র আমরাই কি হিন্দু এরকম সংশয় ছিল! সে কথা তখন ভাবনারও অতীত ছিল! মাঝেমাঝে এমনও দেখেছি বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিহারি, পাঞ্জাবি পুলিশ অফিসাররা লোক পাঠিয়ে আমাদের খবরাখবর নিতেন। কিন্তু ভয় আমাদের মনছাড়া হয়নি। বরং যখন শান্তি কমিটি গঠিত হলো তাতে মুসলিম লীগার এবং অর্থলোভী-হিন্দুবিদ্বেষী এক শ্রেণীর মানুষ যোগ দিল পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায়---বিহারিকলোনীতে, কালিয়াজুড়িতে তখন ভয়ের মাত্রা এক লাফে এবার আমাদের মগজের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়লো! বিহারি যুবকরা দলে দলে রাজাকার, মিলিশিয়া বাহিনী, আল-বদরে যোগ দিল টাকার বিনিময়ে। পাঠান সরর্দারজী এটা মেনে নিতে পারেননি।

তিনি একদিন দুঃখ করে বললেন, ‘বাবু, কী বলবো বলো। বহু বছর এই দেশে আছি। এই দেশের বহুত রুটি খেয়েছি, নুন খেয়েছি, পানি পান করেছি---বাঙালির সঙ্গে বেঈমানি করতে পারবো না বাবু। নেতাজি তো ভারত ভাগ করতে চায়নি! ভাগ করেছে নেহেরু, গান্ধী আর জিন্নাহ্। সাধারণ মানুষ ভাগ হতে চায়নি বাবু! পাকিস্তানের পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ তো হিন্দু-মুসলমানকে সমান অধিকার দিয়েছেন। তাহলে কেন পাঞ্জাবি, বিহারিরা নিরাপরাধ বাঙালি হিন্দুকে খুন করছে? কেন নিষ্পাপ মুসলমানকেও অত্যাচার করে মারছে? ঘরে ঘরে আগুন দিচ্ছে? সেই ঘরে কুরআন পুড়ছে এই কি মুসলমানের কাজ! তোওবা তোওবা! মুসলমান হয়ে জেনানাদের ইজ্জৎ লুটছে! এসব খাঁটি মুসলমানের কাজ নয় বাবু! এসব পাপ! এই পাপের আগুনে বরবাদ হয়ে যাবে পশ্চিম পাকিস্তানিরা দেখে নিও বাবু এই বুড্ডা বলে গেল আজকে! আমি সুযোগমতো পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাবো বাবু আমার জন্মস্থানে। তাগদ আছে শরীরে কিছু করে খাবো। তোমার কোনো ক্ষতি না হয় সে আমি দেখভাল করছি বাবু সেটা নিয়ে চিন্তা করো না। আলবৎ ভালো থাকবে......।’

যদিওবা আমাদের উপর আর কোনো হামলা বা তির তেমন কারণ ঘটেনি তথাপি বাঁচা-মরার সীমাহীন দুশ্চিন্তায় বাবা-মা দুজনেই অনেক শুকিয়ে গিয়েছিল। মাঝেমাঝে বাবা পোস্টাফিসে গিয়ে টাকা তুলে আনতো। বাজার করতো। আমিও কয়েকবার গিয়েছি সঙ্গে। তখন সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত সান্ধ্যআইন জারি থাকতো। সারাদিন অফিসকাচারি, ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো স্বাভাবিকভাবেই। পথেঘাটে, বাজারে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে, সার্কিট হাউজে গিজ গিজ করতো পাকিস্তানি সৈন্যতে। ট্রাক, খোলা ভ্যান আর জিপ গাড়িতে করে অস্ত্র হাতে অলিগলি টহল দিত। কালো পোশাক পরা পাগড়িবাঁধা রাজাকারদের গাড়িও পাশ কেটে যেতে দেখেছি। বুকটা ধুক ধুক করলেও না দেখার ভান করে সব দেখার সুযোগ নিয়েছি। অনেক পরিচিত বাঙালি বড়ভাইকে, বিহারিকে রাজাকার, আল-বদর হতে দেখেছি। আবার মুক্তিযুদ্ধের পর রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধাও বনে যেতে দেখেছি।

ভেলকিবাজি যাকে বলে! বেশি ভয় করতো পাঞ্জাবি সেনাদের দেখলে পরে। বিশাল বিশাল গোঁফ, তাগড়া দেহ, মাথায় জালবাঁধা লোহার টুপি, সদাসতর্ক দৃষ্টি। বিকট চেহারার সেনাও অনেক দেখেছি। গাছের পাতা নড়লেও টা টা করে গুলি ছুঁড়তে দেখেছি, মনে করতো সেখানে তাদের যম ‘মুক্তি’ লুকিয়ে আছে। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পাকিস্তানি সেনারা এমনই ভয় করতো যে কোনো সৈন্য একা থাকতে বা চলতে পারতো না রাস্তায়। তাদেরকে সাহস যোগাতো রাজাকাররা। বাজারে বাবার সঙ্গে রিক্সায় যেতে আসতে দেখতাম সারিবদ্ধ ট্রাকের ভিতরে অসহায় যুবকদের ঠাসা ভিড়, তাদেরকে রাস্তাঘাট থেকে লাঠি না হয় বন্দুক দিয়ে মেরে মেরে তুলে নিয়ে যেত বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে ক্যাম্প বানানো, রান্নাবান্না করানো, ট্রেঞ্চ খোঁড়ানো আর মৃতদেহের খবর খুঁড়িয়ে মাটিচাপা দেবার কাজের জন্য। এভাবে যাদের নিয়ে যেতো অধিকাংশই ফিরে আসতো না বলে পরে বাবার বন্ধুর মুখে শুনেছি। যারা ফিরে আসতে পেরেছেন তারাও বলেছেন।

কোনো-কোনোদিন দেখেছি বিবিরবাজার সীমান্ত থেকে গাছের লতাপাতায় আচ্ছাদিত মৃতসেনার শবভর্তি ট্রাকগুলো ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাচ্ছে সারিবদ্ধভাবে। রাস্তায় রক্ত পড়ে থাকতো। ট্যাঙ্কের, কামানের বহর দেখে ভয়ে শিউরে শিউরে উঠেছি! যুদ্ধের সময় কুমিল্লা শহরের আতঙ্ক ছিল মেজর বোখারি নামে পশ্চিম পাকিস্তানি এক পাঞ্জাবি সেনা অফিসার। খোলা জীপে বসে থেকে সে দুহাতে বন্দুক ছুঁড়ে অকাতরে মানুষ মেরেছে প্রথম দিকে। মানুষ হত্যা করাই তার ছিল নেশা। কত তরুণী এবং গৃহবধূর যে সম্ভ্রম কেড়েছে রাজাকার আর আল-বদরদেরকে দিয়ে ধরিয়ে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে তার হিসেব নেই। বহু মেয়েকে বোখারি পাকিন্তানি সেনাদের ব্যাঙ্কারে ব্যাঙ্কারে দিয়েছে। কিন্তু বাংলার মাটি কোনোকালেই বিদেশীদের অবাধ অত্যাচার সহ্য করেনি---বোখারিকেও ঝাঁঝরা হতে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার স্টেনগানের গুলিতে শালদা নদীর ওপর এক ডজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাসহ। স্বাধীনতার পর তার লাশ তুলে নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে।

পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। সেপ্টেম্বর মাসের দিকে বেশ জোরেসোরেই যুদ্ধ পরিস্থিতি ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে লাগলো। বিবিসি, আকাশবাণীর খবরে জানা গেল দেশের বহু জায়গায় পাকসেনা, খানসেনারা মরছে। কারণ বাংলার দুর্দান্ত বর্ষাঋতুর সঙ্গে দখলদার বাহিনীর পরিচয় ছিল না। বৃষ্টি, বন্যায় কাবু হয়ে গিয়েছিল তারা। জানতো না তারা সাঁতার। ফলে ডুবেও মরেছে বহু নদী-নালায় নৌকো, লঞ্চ, স্টিমারে টহলরত অবস্থায়---যখন বৃষ্টির মতো ঝাঁঝাঁ গুলি ছুঁড়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। সারা দেশের সঙ্গে তো যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটাই অকেজো করে দিয়েছিল মুক্তিবাহিনীর দামাল ছেলেরা। প্রতিদিন মরতে লাগল পাকসেনা সীমান্তেও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে। সারাদিনরাত চলত গোলাগুলি, রকেট, মর্টারগোলার সশব্দ ছোঁড়াছুঁড়ি। একবার তো মরতেই বসেছিলাম! একদিন দুপুরের পরে সঞ্জু, রঞ্জু, খোকা, কিশোরদের সঙ্গে পুকুরের দক্ষিণ পাড়স্থ রেজিস্ট্রি বিল্ডিং এর মাঠে ঘুড়ি উড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ করে বিকট শব্দে অনেকগুলো রকেট সেল সীমন্তের ওপার থেকে নাকি পাকিস্তানিদের কামান থেকে এসে পুকুরে এবং জেলখানার দেয়ালে ছিটকে পড়ল! অমনি লাটাই ফেলে আমি, খোকা আর কিশোর জেলখানারোড ধরে ভোঁ ভোঁ দৌড়। সঞ্জু ও রঞ্জু দুভাই বিহারিকলোনীর দিকে ছুটলো। দৌড়ের মধ্যে টের পেলাম সাঁ সাঁ শব্দ করে কী যেন কানের পাশা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে! কী যে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম সেদিন! ঘরে ঢুকে খাটের তলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। বাবার ভীষণ গালমন্দ শুনতে হয়েছিল। সেদিনটি ছিল রবিবার।

বলা দরকার জুন-জুলাই মাসের দিকে কিশোর ও খোকারা ফিরে এসেছিল বাসায় বোনগুলো ছাড়া। তখন প্রায়ই খেলতাম শিখাদের ঘাস গজিয়ে ওঠা উঠোনে। মাছ ধরতাম বড়শি ফেলে। বাবাও বেশ সাহস নিয়ে সপ্তাহে দু-তিনদিন কয়েক ঘন্টার জন্য অফিস যেতে লাগলো। মাসে মাসে রেশন তুলে নিয়ে আসতো নিজেই। ফলে রক্ষা পেয়েছিলাম প্রাণে। টাকার খুব সংকট দেখা দিয়েছিল। রাতের বেলা প্রতিদিন রেডিও শুনে শুনে বাবা বলতো, ‘এই যুদ্ধ আর বেশিদিন টিকবে না।’ বেশ উৎফুল্ল হতে দেখতাম বাবাকে। সেই চিরদিনের মুচকি হাসিটা বাবার ঠোঁটে ফিরে আসতে লাগলো যেন। মাঝেমাঝে কিশোরের বাবা ছাড়াও সরকারি কলোনীতে থাকতো আহাম্মদ আলী দারোগা তিনিও এসে আড্ডা দিতেন বাসায়। তিনি একা থাকতেন ছেলেমেয়ে স্ত্রীকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে। কার্ফ্যু জারির পূর্বে সন্ধ্যেবেলা বাসায় ফিরে যেতেন। তাঁদের কথাবার্তা থেকে বুঝতাম ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে, এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় প্রদান ছাড়াও। ত্রিমুখী যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে।

মহাশক্তি আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পাবলম্বন করেছে। আরেক মহাশক্তি সোভিয়েত রাশিয়া ভারতের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে চলেছে। যতই যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ছে ততই মানুষের মধ্যে একটা চাপা উল্লাস লক্ষ করতাম এখাসে সেখানে, হাটে-বাজারে। সেপ্টেম্বর মাস থেকে অনেকটাই যুদ্ধ পরিস্থিতি সয়ে আসতে লাগলো আমাদের মনে। বাবা-মা রাতের বেলা খুব গোপনে মিহি শব্দে কলকাতা থেকে সম্প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দেশাত্মবোধক গান, সংবাদ, নাটক আর এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ মনোযোগ দিয়ে শুনতো। দেশাত্বাবোধক অনেক গানই বাংলার মানুষকে অভূতপূর্ব সাহস ও উদ্দীপনা যুগিয়েছিল পাকসেনাকে বাংলা থেকে তাড়াতে আর রাজাকারদেরকে ঘৃণার চোখে দেখতে। বিবিসির খবর ছিল সবচেয়ে নির্ভুল এবং বিশ্বাসযোগ্য তাই ঘরে ঘরে রাতের বেলা হুমড়ি খেয়ে পড়তো রেডিওর সামনে সাধারণ মানুষ।

অক্টোবর মাসের দিকে খুবই টাকার অভাব দেখা দিল সংসারে বাবা নিয়মিত বেতন না পাওয়ার কারণে। বাড়ির মালিক জুনাব আলী সাহেব বললেন, ‘অন্য ভাড়াটে দেবো আপনি বরং পাশের টিনের ঘরটা নিতে পারেন ভাড়া খুবই সস্তা। হরেনবাবুর মালামাল যা আছে সেগুলো আমি এই বাসার একটি কামরায় রেখে দেবো না হয়। সবই তো নাকি লুটপাট হয়ে গেছে। দুটো চকি আর দুটি টেবিল ছাড়া কিছুই নেই। তাছাড়া তাঁরা কবে ফিরবেন তারও তো ঠিক নেই।’ মার খুব পছন্দ ছিল এই বাসাটি। কী আর করা। আমরা শিখাদের পরিত্যক্ত ঘরেই গিয়ে উঠলাম। দুটি বড় কক্ষ আর পাকের ঘর, মন্দ নয়। পুকুর থেকে খোলা বাতাসও সরাসরি আসে। কিন্তু ঘাটটি উন্মুক্ত বিধায় বাবা তড়িঘড়ি করে লোক লাগিয়ে বাঁশের ঘের দেয়ালো। প্রথম কটিতে আমি আর বাবা ভিতরের কে মা ছোটভাই ও বোনকে নিয়ে থাকতো।

আমাদের খাটের পাশেই ছিল টেবিল ও চেয়ার সেখানেই বাবা ও আমি পড়ালেখা করতাম। উঠনোর কোণে আমগাছ, তার লাগোয়া পুকুর পাড়ে নারকেলগাছ, আর একটি ডুমুর গাছ কয়েকটি কলাগাছের মাঝখানে। বেশ শান্ত ঘুমঘুম পরিবেশ। সারাদিনই চমৎকার বাতাস থাকে। মা এই বাসায় থাকতে খুশি হল না ঠিকই কিন্তু বাবা দিব্যি মানিয়ে নিল। বাবার এই সহনীয় মনোভাব বরাবরই ভালো লাগে আমার। জীবন যখন যেমন। এই বাসাতে আসার পর মা প্রায়ই বলতো, ‘একদিন সাব-রেজিস্ট্রি বিল্ডিং এর ছাদে দেখবো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে!’ বাবা বলতো, ‘তোমার আশা তাড়াতাড়িই পূর্ণ হবে।’... চলবে।

লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ০৮, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test