E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অতলান্ত পিতৃস্মৃতি দ্বিতীয় অধ্যায়, পর্ব ১

২০১৪ জুলাই ১১ ১৯:৩৩:৫৯
অতলান্ত পিতৃস্মৃতি দ্বিতীয় অধ্যায়, পর্ব ১

প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

যুগে যুগে বিশাল পরিবর্তন আসে দেশে-দেশে, অঞ্চলে-অঞ্চলে। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। আমূল পরিবর্তন যাকে বলে। এরকম বাংলাদেশকে দেখবো কেউ কোনোদিন চিন্তাই করিনি! বাবাও নয়। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। বিধ্বস্ত দেশের অবর্ণনীয় অবস্থা দেখে কেঁদে ফেললেন। তারপর সাহস সঞ্চয় করে দেশ গঠনের লক্ষ্যে নিজেও নামলেন, জনগণকেও নামতে উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন। চতুর্দিকে কেবল ধ্বংসস্তুপের দৃশ্য। স্বজন হারানোর সীমাহীন ব্যথাবেদনা হাহাকারের সঙ্গে খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের সঙ্কটাপন্ন জরাজীর্ণ, দরিদ্রতম এক বাংলাদেশের জন্ম দিল।

চতুর্দিকে দুর্নীতি, চুরি-ডাকাতি, আত্মসাৎ, ছিনতাই, খুন, গুম, রাজনৈতিক অস্থিরতা বঙ্গবন্ধুকে ক্রমে ক্রমে নাজেহাল করতে লাগলো। যে বাঙালি জাতি ন্যায়-নীতি-নৈতিকতা-দেশপ্রেমের শুভপরিচয় দিয়েছিল বৃটিশ-ভারতে, ভারতভাগের পর থেকে সেই জাতিই স্বাধীনতার পর পর মাত্রার অধিক অসভ্য আর অসহিষ্ণু হয়ে উঠলো! এই বাঙালিকে চেনাই গেল না! একটা হঠাৎ পরিবর্তন আমার মধ্যেও এলো যেন। হঠাৎ করেই যেন বড় হয়ে গেলাম আমি। প্রচুর ভাঙচুর সত্ত্বেও নতুন করে আবিষ্কার করতে লাগলাম পারিপার্শ্বিকতাকে। সবকিছুতেই একটা বেপরোয়া---টালমাটাল পরিস্থিতি। বাবাও দেখলাম কেমন যেন হয়ে গেছে। ব্যস্ততা, ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা!

১৭ ডিসেম্বর থেকেই বাবা সেই পুরনো পুলিশের ইউনিফর্ম পরে অফিসে যেতে লাগলো। আগের জীবনে ফিরে গেলেও বাবা যেন আগের বাবা নেই! তেজদীপ্ত চাঞ্চল্যটা আর নেই! আশ্চর্য! সন্ধ্যেরাতেই বাসায় ফিরে এসে একা নীরবে বসে থাকে। প্রতি সপ্তাহে আহাম্মদ আলী দারোগা, নতুন বদলি হয়ে আসা লতিফ দারোগা, বীরেন্দ্র দারোগা প্রমুখ বাসায় এসে দেশের পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। আমি পাশের কে বসে পড়তাম আর তাঁদের দুশ্চিন্তাপ্রসূত কথাবার্তা শুনতাম। বঙ্গবন্ধু যে এদেশ শাসন করতে পারবেন না এটাও তাঁরা বলাবলি করতেন। কারণ মানুষের চরিত্র আমূল পাল্টে গেছে। রাজনীতিক আর মুক্তিযোদ্ধারা নানা দলে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। কারো মধ্যেই আর দেশগঠনের মনোভাব নেই, বরং খাই খাই নামক নৃশংস এক ক্ষুধা নিয়ে অবাধে লুটাপাটে নেমে গেছে। কে কাকে রুখে? কে কাকে নিচে টেনে ফেলে দিয়ে উপরে উঠবে এই দুর্মর প্রতিযোগিতায় অন্ধ হয়ে গেছে বাঙালি!

এ এক অচেনা অন্যরকম বাঙালি! তখন প্রতিদিন এখানে সেখানে মাটির নিচে খানসেনাদের পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরিত হতো। আমরা সচকিত হতাম। কত মানুষ যে এই গুপ্ত মাইনের দ্বারা আঘাত পেয়ে মৃত্যুবরণ এবং পঙ্গু হয়েছে সেই হিসেব কেউ রেখেছে বলে মনে হয় না। প্রায় প্রতিদিন বিহারিকলোনী তথা রিফিউজি ক্যাম্পের লোকজন এসে বাবার কাছে আবদার করতো চাকরি, টাকা দিয়ে সাহায্য করার জন্য।

যারা শান্তি কমিটিতে নাম লিখিয়েছিল, রাজাকার, আল-বদর হয়েছিল তাদেরকে ধরে ক্যাম্পের মধ্যেই অমানুষিক নির্যাতন করেছে মুক্তিযোদ্ধা এবং অমুক্তিযোদ্ধারা। তারাও হয়তো এভাবে বাঙালিকে অত্যাচার করেছে। তবুও মানুষ হিসেবে খুব অসহায় লাগছিল তাদেরকে দেখে। যারা আসলেই নির্দোষ বা মানুষ খুন করেনি বাবা চেষ্টা করেছে তাদেরকে রক্ষা করতে। পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডরদেরকে অনুরোধ করেছে বাবা বিবেচনা করার জন্য। বেকার কাউকে কাউকে রিক্সা চালানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে মালিককে বলে, গাড়ির গ্যারেজের মালিককে বলে কাজ জুটিয়ে দিয়েছে। শহরের শান্তি বাহিনীর অন্যতম প্রধান সহযোগী দালাল উকিল হাসমত উল্যাহকে নির্মমভাবে মেরে ফেলেছিল মুক্তিযোদ্ধারা। বাঘা বাঘা উকিল যারা মুসলিম লীগার এবং শান্তি বাহিনী গঠন করেছিলেন তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।

বিহারিদের বিরুদ্ধেও হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মামলা করে পুলিশ তথা সরকার। অনেককে জেলে ঢুকিয়ে রাখা হয় মাসের পর মাস। তাদের পরিবারগুলো না খেয়ে মরার উপক্রম হয়েছিল। তাদেরকেও বাবা-মাকে খাবার-দাবার, পুরনো কাপড়-চোপড় দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করতে দেখেছি। বাবা-মা দুজনেরই এক কথা, এরাও তো মানুষ। কোথায় যাবে এরা? এদেরকে ব্যবহার করেছে পাকিস্তান সরকার আর অসৎ রাজনীতিকরা, কী এদের দোষ? উদারমনস্ক মানুষ বাবা কৃতজ্ঞতার খাতিরে একদিন থানায় গিয়ে মোহাম্মদকে দেখতে যায়। জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে ভুখা মোহাম্মদ অঝর ধারায় কেঁদে কেঁদে বাবার হাত ধরে প্রাণভিক্ষা চাইছিল।

তিনদিন ধরে কোনো খাবার পেটে পড়েনি বলে কথাও বলতে পারছিল না। বাবা ছুটে গিয়ে থানাসংলগ্ন রাজগঞ্জ বাজার থেকে কিছু রুটি আর হালুয়া কিনে এনে তাকে হাজত থেকে বের করে কাছে বসিয়ে খাওয়ালো। বাবা বললো তাকে, ‘মোহাম্মদ কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হয় মানুষকে এবার যে যতই বড় হোক, শক্তিশালী হোক। আর ফোর্স বেশি দিন থাকে না মানুষের এটাও নিশ্চয়ই আজকে বুঝতে পেরেছো।’ এই কথা শুনে নাকের জলে, চোখের জলে একাকার হয়ে মোহাম্মদ বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে গেছে। তারপর যুদ্ধবন্দির চুক্তি অনুসারে একদিন মুক্তি পেয়ে তার দ্বিতীয় জন্মভূমি ইস্ট পাকিস্তান তথা বাংলাদেশকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য পাকিস্তানে চলে গেছে। বাবা তার প্রতি দয়া দেখালেও মন থেকে ক্ষমা করেনি এটা বলাই বাহুল্য। যারা আসলেই মানুষের তি করেছে, হত্যা করেছে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সেইসব রাজাকারদেরকে ক্ষমার চোখে দেখেনি বাবা কোনোদিন।

আইনজীবী যারা মুসলিম লীগ করতেন রাজাকারি করেছেন, তাদের কাউকে কাউকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে মুক্তিযোদ্ধারা বাবা কোনো প্রকার সহানুভূতিই প্রকাশ করেনি। পরবর্তীকালেও যারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েছে তাদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করলেও মন থেকে শ্রদ্ধাভক্তি করতো না, সেটা আমি বাবার আচরণেই প্রত্যক্ষ করেছি। কুমিল্লা শহরের বেশ কয়েক জন প্রভাবশালী উকিল যারা রাজাকার আইনে ধরা পড়ে মাসের পর মাস জেলখানায় থেকে মামলা লড়েছে তাদেরকে বাবা কীভাবেই না সাহায্য-সহযোগিতা করেছে, তাদের স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের খোঁজ খবর নিয়েছে, তারাও প্রায় প্রতিদিন বাবার কাছে এসে আবদার করতো একটা কিছু করার জন্য সেসব বাবা আমাদেরকে বলেছে। বাবা তাদের জন্য যথাসাধ্য করেছে। হাকিমদের বুঝিয়েছে দিনের পর দিন। তারপর অভিযুক্তরা খালাস পেয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, মুক্তি পেয়ে কেউ কোনোদিন সামান্য ধন্যবাদটুকুও বাবাকে জানায়নি! তাদের স্ত্রী ছেলেমেয়েরাও না!

যারা পরবর্তীকালে এই শহরেই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং বিএনপির কল্যাণে প্রচুর ধনসম্পত্তি আর কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। আবার এইসব রাজাকারদের মামলা লড়ে আরও কিছু স্বনামধন্য আওয়ামীলীগপন্থী উকিল কোটি কোটি টাকা বানিয়েছে। কিন্তু বেশি দিন কেউই বাঁচেনি। অথচ আমার বাবা ৮৪ বছর বেঁচে থেকে ইতিহাসের উজ্জ্বল সাক্ষী হিসেবে, মহানুভবতার দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আর স্বাধীনতাবিরোধীরা ইতিহাসের কলঙ্ক নিয়ে বিদায় নিয়েছে, সেই কলঙ্ক ক্রমাগত তাদের বংশধরদেরকে কলঙ্কিতই করে যাবে। কেননা রাজনৈতিক ভুল বংশ পরাম্পর সকলকেই ধ্বংসই করে যায় এটা অলংঘনীয়। টাকা দিয়ে অপরাধ আর কলঙ্কের ইতিহাস ঢাকা যায় না। স্বাধীনতার পর কুমিল্লা হাই স্কুলে গিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলাম আমি আর দীপু। কিন্তু সে বছর অটো প্রমোশন দেয়া হল সব স্কুলে ফলে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র হয়ে গেলাম আমরা।

একদিন স্কুলে যাওয়ার সময় হঠাৎ করে এলেন হরেন জেঠু। আমি তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। বললেন, ‘কেমন আছো তোমরা? তোমার বাবা কি চলে গেছেন অফিসে?’ আমি বললাম, ‘না। এখন কাপড় পরছে, তারপর যাবে।’ তিনি ভেবেছিলেন আমরা বুঝি ঐ দালান বাড়িতেই আছি। সেদিকে যাচ্ছিলেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘জেঠু ও বাসায় নয়, আমরা আপনাদেরটায় এখন থাকি।’ তিনি থমকে দাঁড়ালেন। আমি বললাম, ‘আপনি বাসায় যান। আমার সময় নেই।’ বলে গেটের বাইরে গিয়ে আবার ফিরে এলাম, জিজ্ঞেস করলাম, ‘শিখারা আসেনি জেঠু? শিখা ভালো আছে তো?’ তিনি ভারী চশমাটি চোখ থেকে খুলে বললেন, ‘হ্যাঁ, ভালো আছে বাবা। আমরা সবাই এসেছি গত পরশুদিন। আগরতলাতেই ছিলাম। বাসা নিয়েছি ডিগম্বরিতলা। ছাতিপট্টির দিকে।’ বললাম, ‘তাই নাকি?

ছাতিপট্টি আমার মামার বাসা ও ওষুধের দোকান আছে। তালুকদার ফার্মেসি।’ বললেন, ‘ও তাই নাকি? তাহলে তো ভালোই হলো। ঠিকানা দিয়ে যাবো বেড়াতে এসো।’ তারপর একটু থেমে বললেন, ‘শিখা প্রায়ই তোমার কথা বলতো। খুব দুশ্চিন্তা করেছি আমরা তোমাদের জন্য। তোমরা ভালো আছো দেখে সত্যি আনন্দ হচ্ছে।’ তাঁকে নমস্কার জানিয়ে আমি গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। যেতে যেতে খুব আনন্দ হচ্ছিল এই ভেবে যে, শিখা আমাকে ভুলে যায়নি। মনে রেখেছিল, মনে রেখেছিল। হঠাৎ খুব ইচ্ছে হলো ওকে একটিবার দেখার। আহা, কতদিন তাকে দেখি না! কিন্তু কিভাবে যাবো? মা কি নিয়ে যাবে? শিখাও কি আসতে পারে না আমাদেরকে দেখতে? একটু অভিমান হলো আমার তার ওপর। শিখাকে যে আমার ভালো লেগেছে প্রথম পরিচয় থেকেই সেটা কী ও জানে না? স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক অস্থিরতা অনেক গুণ বেড়ে গেল। প্রতিদিনই হরতাল, ধর্মঘট, মিছিল। স্কুল, কলেজে যখন তখন সভা। মনে হলো একাত্তর তো শেষ হয়নি একটু বিশ্রাম নিয়ে যেন আবার ফিরে এসেছে। রাস্তাঘাটে নিরাপত্তা নেই। চুরিডাকাতি বেড়ে গেছে সর্বত্র। বাবা বললো, ‘রাজনীতির ধারেকাছে যাবে না কিন্তু। তোমার পেশা হচ্ছে ছাত্র---কেবল পড়ালেখা করা। বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশলে আমি ভীষণ রাগ করবো।’...চলবে।

আলোকচিত্র : বামে, কুমিল্লা হাইস্কুল। ডানে, বাবার সঙ্গে মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে শিখার সেজদা স্বপন দাস।

লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ১১, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test